রাজ্য

‘লক্ষীর ভান্ডার’ প্রকল্পটি সাধারণের মধ্যে সাড়া ফেললেও কিছু প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়

রেবাউল মন্ডল, টিডিএন বাংলা: রাজ্যের প্রতিটি পরিবারের প্রাপ্তবয়স্ক মহিলা সদস্যদের জন্য ন্যূনতম মাসিক আর্থিক সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে লক্ষীর ভান্ডার প্রকল্পটি মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের মধ্যে অন্যতম। রাজ্য সরকারের নারী ও শিশু বিকাশ এবং সমাজ কল্যাণ দপ্তর নিয়ন্ত্রণাধীন এই প্রকল্পে বিপুল সমারোহে ইতিমধ্যে আবেদন জমা কোটি ছাড়িয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি মত রাজ্যব্যাপি প্রকল্পটি ব্যাপক সাড়া ফেললেও কিছু প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে।

১৬ই আগস্ট থেকে শুরু হওয়া প্রতিটা ‘দুয়ারে সরকার’ ক্যাম্পের প্রথম দিনেই তৃণমূল সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার অনুসারে ‘লক্ষীর ভান্ডার’ এ ফর্ম তুলতে করোনা বিধি উপেক্ষা করেই ব্যাপক ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। কোথাও কোথাও চরম বিশৃংখলতার ফলে অসুস্থ হয়ে হসপিটালে ভর্তি পর্যন্ত হতে হয়েছে। যা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বিদ্যজনেরা। এমনিতেই করোনার তৃতীয় ঢেউ ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে। তারপর এভাবে একসঙ্গে হাজার হাজার জমায়েত করার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ভিড়ের ভয়ে এমনিতেই ছেলে-মেয়েদের স্কুল কলেজ বন্ধ। কিন্তু এখানে হাজার মানুষের ভিড় ঠেলে বাড়ি ফিরে মা মিসছে সেই সন্তান পরিবারের সঙ্গেই।

এ ক্ষেত্রে পুরো প্রক্রিয়াটা অনলাইনে হলে এই বিশৃঙ্খলা এড়ানো যেত। যে যার মত মোবাইল বা পাড়ার কম্পিউটার দোকান থেকেও খুব সহজেই কম খরচে আবেদন করে নিতে পারতেন মায়েরা। তাতে দুপয়সা রোজগারও হত গ্রামের বেকার ছেলেটার। সঙ্গে মেয়েদের হয়রানি এবং খরচ দুটোই বেঁচে যেত। খরচ বেঁচে যেত এই জন্যই বলছি কারণ একজন মহিলাকে দুয়ারে সরকারে আসতে হয় তার স্বামী বা সন্তান কে আসতে হয়েছে। এর ফলে করোনার আবহে শিবিরে ভিড় বেড়েছে দ্বিগুন। দরিদ্র পরিবারের সেদিনের ওই পুরুষ মানুষটার ৪০০/৫০০ টাকার রোজগার বন্ধ করেই যেতে হয়েছে। সঙ্গে আছে যাতায়াত খরচও। অনলাইনে হলে পাড়ায় বসে মাত্র ৩০-৫০ টাকার মধ্যেই হয়ে যেতে পারত।

প্রকল্পে জাতপাতের অভিযোগও কম নয়। পিছিয়ে পড়া এসসি এসটি রা ১০০০ টাকা পেলে ওবিসি-দের বেলায় কেন ৫০০? সে প্রশ্নও উঠছে। রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশন ও সাচার কমিটির রিপোর্টে রাজ্যের সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের শিক্ষা চাকরি আর্থিক দিকের করুন অবস্থা স্পষ্ট হয়েছে। তার পরেও কেন এই বঞ্চনা? আর জেনেরাল কাস্টের মধ্যেও কি দারিদ্র নেই? তারাই বা কেন বৈষম্যের শিকার হবে? সর্বোপরি প্রকল্পের সার্বজনীনতা রক্ষার ক্ষেত্রে জাতপাত না দেখে আর্থিক মানদণ্ডের ওপরেই দেওয়া উচিত ছিল। ফলে উপকৃত হতে সব শ্রেণীর দরিদ্র লক্ষীরা।

নামকরণ নিয়েও সংখ্যালঘু মুসলিমদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ‘লক্ষী’ সাধারণত একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের আরাধ্য দেবতার নাম। আর তা নিয়েই আপত্তি দেখিয়েছেন মুসলিম সমাজ। লক্ষীর ভান্ডার এর পরিবর্তে ‘বঙ্গ ভান্ডার’, ‘মাতৃ ভান্ডার’ ‘বঙ্গ মাতা’, ‘মহিলা ভান্ডার’, ‘বাংলার মা, ‘বাংলার জননী প্রকল্প’ ইত্যাদি সর্বজনগ্রাহ্য একটি নাম দেওয়া যেতে পারত। সুতরাং প্রকল্পের নামকরণ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা দ্বিধা রয়েছে !

পরিশেষে বলব, এখন চাষীদের পাটের দাম নিম্নমুখী। এক লিটার সর্ষের তেলের দাম যখন ২০০ টাকা, তখন এই ৫০০ টাকায় গরিব মায়ের কি হবে? রাজ্যের বিভিন্ন দফতর সহ শিল্প কলকারখানায় শিক্ষিত বেকারদের চাকরি, কাজ দেবার পাশাপাশি লক্ষ্মীর ভান্ডারে মহিলাদের ৫০০/১০০০ টাকার পরিবর্তে আরও বেশি কিছু দেওয়া হোক। তবে অবশ্যই তা আর্থিক দিক বিচার করে। অবস্থা সম্পন্ন পরিবারের মহিলাদেরকেও যদি একই ভাবে এই প্রকল্পের আওতায় আনা হয়, লক্ষীর ভান্ডারের লাইনে যদি কাজের মাসির পিছনে বাড়ির মালকিনও দাঁড়ায় তাহলে পিছিয়ে পড়া মানুষকে সমাজের মূল স্রোতে এগিয়ে আনা কিভাবে সম্ভব?

যদি অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার উপর ভিত্তি করে লক্ষীর ভান্ডারে অর্থ দেওয়া হত তবে হরিলুটের বাতাসা কুড়ানোর মত সবাই একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ত না। যে যোগ্য কেবল সেই আসত। এক্ষেত্রে জাতপাতকে দূরে রেখে সার্বজনীন গ্রহণযোগ্য একটি নামকরণের মাধ্যমে কেবল আর্থিক স্বচ্ছলতাকে আবেদনের মানদণ্ড করে সকল দরিদ্রকে সমান অর্থ দিলে সরকারের তোষণ আর সস্তার ভোট ব্যাংক রাজনীতির অভিযোগও উঠতো না। আর সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমরা চাইব সেই অভিযোগমুক্ত করে ‘কন্যাশ্রী’ ‘রূপশ্রী’ ‘স্বাস্থ্যসাথী’ ‘সবুজ সাথী’র মতই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে সমান ভাবে সমাদৃত হোক মুখ্যমন্ত্রীর সাধের নজিরবিহীন ‘লক্ষীর ভান্ডার’ প্রকল্পটিও।

Related Articles

Back to top button
error: