Highlightরাজ্য

পলাশির যুদ্ধ না প্রহসন

পলাশির যুদ্ধ না প্রহসন

২৩জুন ১৭৫৭। ভারত তথা বিশ্বের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক দিন। এদিন পলাশীর প্রান্তরে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্নেল রবার্ট ক্লাইভের কাছে পরাজিত হয়। এই ঘটনার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। এখানেই ভারতের স্বাধীনতার সূর্য নিভে যায়। ইংরেজরা ভারত দখল করে নেয় ও প্রায় ১৯০ বছর ভারতকে শোষণ করে। পর্তুগিজ ঐতিহাসিক বাকসার এই যুদ্ধকে বিশ্বের সেরা যুদ্ধ গুলির অন্যতম বলে মনে করেন।  ঐতিহাসিক রজতকান্ত রায় একে যুদ্ধ না বলে ষড়যন্ত্র বলে অভিহিত করেছেন। নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন বাংলাকে শুধু রাজনৈতিকভাবে পরাধীন করেনি বরং বাংলার ইতিহাসে হিংসা ঘৃণা ও জাতিবিদ্বেষ এর বীজ বপন করে। ইংরেজ ইতিহাসিকগণ তাদের আগ্রাসী ভূমিকাকে যুক্তিগ্রাহ্য করার জন্য একের পর এক ইতিহাস বিকৃত করে। সিরাজকে অত্যাচারী নিকৃষ্ট মানুষ হিসেবে তুলে ধরা হয়। ইংরেজদেরকে দেখানো হয় বাঙালির ত্রাতা হিসেবে। মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা বিদ্বেষ ছড়িয়ে মেরুকরন করা হয়। যা আজও অব্যাহত আছে। প্রকৃত সত্য কি তাই? আলোচনা করেছেন মুহাম্মাদ নূরুদ্দীনআজ প্রথম কিস্তি।

“এই বাংলায় ডুবিয়াছে হায় ভারতের দিবাকর” বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই আক্ষেপ ও বেদনাপূর্ণ কবিতার লাইনের মধ্যে লুকিয়ে আছে ভারতের এক করুণ ইতিহাসের এই চিত্র। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে জুন বৃহস্পতিবার রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর মাত্র ৩০০০ সৈন্যের কাছে পরাজিত হয় বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব সিরাজুদ্দৌল্লার ৫০০০০এর অধিক সৈন্য। সিরাজের এই পরাজয়ের পিছনে ছিল একদল  আত্মঘাতী বিশ্বাসঘাতকের ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্র বা চক্রান্তের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন ধনকুবের জগৎশেঠ, ব্যবসায়ী উমিচাঁদ ও রাজা রাজবল্লভ প্রমুখ। তারা লোভ দেখিয়ে নবাবের প্রধান সেনাপতি মীরজাফরকে তাদের দলে টেনে নিতে সক্ষম হন। মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার কারনে পলাশির যুদ্ধে বাংলার নবাবের পরাজয় ঘটে।

নিঃসন্দেহে মীরজাফর বিশ্বাস ঘাতক ছিলেন। কিন্তু এই বিশ্বাসঘাতকতা একটা সম্প্রদায়ের  ঘাড়ে চাপিয়ে গোটা সম্প্রদায়কে বিশ্বাসঘাতক রূপে পরিচিত করার অপপ্রয়াস চালানো হয়েছে। বর্তমানে জোরে শোরে প্রচার করা হচ্ছে – মীরজাফরেরা বিশ্বাসঘাতকের দল, তাদের বিশ্বাসঘাতকতার কারনে ইংরেজরা ভারতবর্ষ দখল করার সুযোগ পেয়েছিল এবং এই সূত্র ধরে এদেশে হিন্দু-মুসলিম মেরুকরণ করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে মুসলমানরা বিশ্বাসঘাতক, দেশদ্রোহী, দেশের  প্রতি তাদের ভালবাসা নেই। তাদের দেশপ্রেম নিয়ে তাচ্ছিল্য করা হয়। কিন্তু প্রকৃত ইতিহাস সেকথা বলে না। পলাশির যুদ্ধে ইংরেজদের হাত থেকে দেশরক্ষা করার জন্য যেমন হিন্দু-মুসলমান কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছে, রক্ত দিয়েছে, শহীদ হয়েছে তেমনি সিরাজকে মসনদ থেকে সরানোর জন্য যারা ষড়যন্ত্র করেছিলেন তাদের মধ্যেও ছিল হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ।

বিবাদের গভীরে পারিবারিক দ্বন্দ্বঃ

বাংলার নবাব ছিলেন আলিবর্দী খাঁ। তাঁর কোন পুত্র সন্তান ছিল না। তাই তিনি কন্যা আমিনা বেগমের পুত্র সিরাজদৌল্লাকে বাংলার সিংহাসনে বসানোর ইচ্ছা পোষন করেন। সিরাজের পিতা জৈনুদ্দিন আহমেদ ছিলেন বিহারের গভর্নর। সিরাজকে বাংলার সিংহাসনে বসানোর সিদ্ধান্ত অনেকের পছন্দ হয়নি। বিশেষ করে আলিবর্দির অপর কন্যা ঘসেটি বেগম খোলা মনে এ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি। আবার রাজদরবারের মধ্যে যারা সুযোগ সন্ধানী ছিলেন তারাও সিরাজদৌল্লার মত একজন স্বাধীনচেতা নবাবকে মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। আপরদিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে ভারতে আসে। ফরাসী গোলন্দাজ,ডাচদের মত তারাও ভারতের বিভিন্ন জায়গায় কুঠিস্হাপন করে ব্যবসা বানিজ্য করতে থাকে। কিন্তু সৎপথে ব্যবসা করে রাতারাতি বিপুল সম্পদ অর্জন করা যায় না। নিত্যনতুন অবৈধ কৌশল অবলম্বন করে তারা তাদের ব্যবসাকে বাড়িয়ে নিতে খুবই তৎপর ছিল। ইংরেজদের লোভাতুর দৃষ্টি ছিল বাংলার দিকে। কেননা, তখন বাংলা ছিল সম্পদের প্রাচুর্য্যে ভরপুর। বাংলার সম্পদ পেতে গেলে শুধু ব্যবসা করলে হবে না, রাজ আনুকুল্যও দরকার। তাই ইংরেজরাও চাইত বাংলার সিংহাসনে তাদের পছন্দের কোন লোক বসুক।

প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে ইংরেজ যোগঃ

সিরাজকে ক্ষমতাচ্যুত করায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল জগৎ শেঠের বাড়িতে। এই ষড়যন্ত্র বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন রাজা মহেন্দ্র (দুর্লভ রায়), রাজা রাম নারায়ণ, রাজা রাজবল্লভ, কৃষ্ণ দাস, উমিচাঁদ, জগৎ শেঠ প্রমুখ। সেই গোপন বৈঠকে ইংরেজদের পক্ষ থেকে স্ত্রীলোকের ছদ্মবেশে উপস্হিত হয়েছিলেন ইংরেজদূত মি:ওয়াটস্ সাহেব। লোভাতুর বাংলার আমীর-ওমরাহ্ ও ধনকুবেরদের কুমন্ত্রণার জালে জড়িয়েছিলেন মূলত: ওয়াটস সাহেব। মুসলমানদের হাত থেকে শাসন ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার জন্য তিনি ধাপে ধাপে এগোনোর পরামর্শ দেন। সেই কাজ করতে তারা সিদ্ধান্ত নেন সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করা হবে এবং তারই আত্মীয় নবাব পরিবারের অংশ মীরজাফরকে মসনদে বসানো হবে যাতে বাংলার তথা সারা ভারতের মুসলিম সমাজ একসঙ্গে উত্তেজিত হয়ে না ওঠে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য যে টাকা লাগবে তা ঢেলে দেওয়ার জন্য তৈরিই ছিল জগৎ শেঠ। এইভাবে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা ও শাঁখের করাতের মত যেতে আসতে টাকা রোজগারের সুনিপুণ পরিকল্পনা করেছিল ইংরেজরা।

ঊমিচাঁদের প্রলোভনে মীরজাফরঃ মীরজাফর সিরাজের প্রতি অসন্তুষ্ট ছিল ঠিকই। কিন্তু প্রাথমিকভাবে তিনি চক্রান্তে পা দিতে চাননি। এক তো আত্মীয়তার বন্ধন, দ্বিতীয়ত আলিবর্দী খাঁকে দেওয়া তাঁর প্রতিশ্রুতি। বৃদ্ধ আলিবর্দী খাঁকে তিনি কথা দিয়েছিলেন যে তিনি সিরাজকে সহযোগীতা করবেন। উমিচাঁদ তাঁকে বিভিন্ন দিক থেকে প্রলোভিত করে। তাঁকে বোঝানো হয় নবাব পরিবার থেকে শুরু করে, সেনাবাহিনী এবং সাধারন মানুষ তাঁকেই নবাব হিসাবে দেখতে চান। দ্বিতীয়ত তিনি নবাব হলে বাংলার প্রভূত উন্নতি হবে ইত্যাদি। মীরজাফর উমিচাঁদের বিষ পান করেন এবং সিরাজকে হঠানোর ষড়যন্ত্রে সামিল হন।

 

Related Articles

Back to top button
error: