HighlightNewsদেশ

খুন, ডাকাতি, যৌন হেনস্থা সহ পাহাড়প্রমাণ অভিযোগ সত্ত্বেও মোদীর সুরক্ষাকবচে ব্রিজভূষণ, অভিযোগ রাহুল গান্ধীর, কে এই ব্রিজভূষণ জানুন তার কাহিনী

বিশেষ প্রতিবেদন, টিডিএন বাংলা: খুন, গুম, ডাকাতি, যৌন হেনস্থা সহ পাহাড়প্রমাণ অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও মোদীর সুরক্ষাকবচে আছেন জাতীয় কুস্তি সংস্থার সভাপতি ব্রিজভূষণ, আমেরিকা থেকে এমনই বিস্ফোরক অভিযোগ করেছেন বিরোধী দল কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি রাহুল গান্ধী। শোনা যায় ব্রিজভূষণের এক ছেলে বাবার বিরুদ্ধে স্বার্থন্বেষী মনোভাবের অভিযোগ তুলে আত্মহত্যা করে ছিল। সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী বাবরি মসজিদের স্থানে রামমন্দির নির্মাণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্ৰহণ করেন তিনি। ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় এখনও পর্যন্ত অন্তত ৩৮টি ফৌজদারি মামলা হয়েছে। কিন্তু এত কিছুর পরেও কেন তাকে গ্রেফতার করেনি পুলিশ। কোন ক্ষমতা বলে তিনি এখনও সদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

কে এই ব্রিজভূষণ সিং? তাকে নিয়ে এত বিতর্কই বা কেন দেশ জুড়ে? মহিলা কুস্তিগিররা তার বিরুদ্ধে এফআইআর এ ঠিক কি কি অভিযোগ করেছেন? কেন এতো ক্ষমতাবান তিনি? তার রাজনৈতিক পরিচয়ই বা কি? জানুন তার সম্পূর্ণ কাহিনী

মহিলা কুস্তিগিরদের যৌন হেনস্থার অভিযোগে আবারও শিরোনামে উঠে আসা ব্রিজভূষণ সিং ১৯৫৭ সালের ৮ জানুয়ারি উত্তরপ্রদেশের গোন্দায় এক রাজপুত পরিবারে জন্ম গ্ৰহণ করেন। তাঁর বাবার নাম জগদম্বা শরণ সিংহ এবং মায়ের নাম পেয়ারি দেবী সিংহ। ব্রিজভূষণ যুবক বয়সেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তবে সর্ব প্রথম বিজেপির টিকিটে লোকসভায় সাংসদ নির্বাচিত হন ১৯৯১ সালে উত্তরপ্রদেশের গোন্দা লোকসভা কেন্দ্র থেকে। এরপর আর কখনও পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। তরতর করে এগিয়ে গিয়েছে ক্ষমতার উচ্চ শিখরে। সঙ্গে বেড়েছে খুন, গুম, ডাকাতি, যৌন হেনস্থা সহ বিভিন্ন মামলার পাহাড়। ১৯৯১ সালের পর আবারও ১৯৯৯ সালে ওই একই নির্বাচনী কেন্দ্র থেকে বিজেপির টিকিটে পুনরায় সাংসদ নির্বাচিত হন। তবে ২০০৪ সালে ওই কেন্দ্র ছেড়ে বলরামপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে বিজেপির টিকিটে সাংসদ হন ব্রিজভূষন। কিন্তু ২০০৮ সালে এসে বিজেপির সঙ্গে তার সম্পর্কে ছন্দ পতন ঘটে। ওই সালে লোকসভায় আস্থা ভোটে দলীয় নির্দেশ অমান্য করে অন্য দলে ভোট দেওয়ার অভিযোগে ব্রিজভূষণকে বহিষ্কার করে বিজেপি। যদিও এতে তার রাজনৈতিক কেরিয়ারের বিশেষ কোনো ক্ষতি হয়নি। তিনি বিজেপির থেকে বহিষ্কৃত হয়ে উত্তরপ্রদেশের আঞ্চলিক দল সমাজবাদী পার্টিতে যোগ দিয়ে ২০০৯ সালে উত্তরপ্রদেশের কায়সারগঞ্জ থেকে আবার সাংসদ নির্বাচিত হন। কিন্তু ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে বিপুল আসনে জয়ী হয়ে কেন্দ্রে সরকার গঠন করে বিজেপি । এর তার কয়েক মাসের মধ্যে ব্রিজভূষণ আবার বিজেপিতে যোগ দেন। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে কায়সারগঞ্জ থেকেই আবারও ষষ্ট বারের মতো লোকসভার সাংসদ নির্বাচিত হন তিনি। তবে এবার সমাজবাদী পার্টির টিকিটে নয় বরং বিজেপির টিকিটে।

সালটি তখন ১৯৯২, ডিসেম্বর মাসের ৬ তারিখে সারা বিশ্ব দেখল চরম হিংসাত্মকতা ও অরাজকতা। দিনের আলো তে সকলের সামনে একে বারে পরিকল্পিত ভাবে কয়েকটি হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের উন্মত্ত হিন্দু সমর্থকেরা উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যাতে ষোড়শ শতাব্দীর বাবরি মসজিদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে চরম সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা। সারা বিশ্ব জুড়ে শুরু হয়েছে ব্যাপক সমালোচনা। এই ঘটনায় পরিকল্পনাকারী হিসাবে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে তার মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন এই বিজেপি নেতা ব্রিজভূষণ সিং। সেই সময় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই বাবরি মসজিদ ধ্বংস মামলায় যাদের গ্রেফতার করে ছিল তাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান সন্দেহভাজন ছিলেন ব্রিজভূষণই। কিন্তু পরবর্তীতে ২০২০ সালে সুপ্রিম কোর্ট যথেষ্ট প্রমানের অভাবে তাকে খালাস করে দেয়। দ্য ওয়্যার-এর খবর অনুযায়ী এই ঘটনার পরে একদা তিনি গর্ব করে বলে ছিলেন, “আন্দোলনের সময়, আমিই সেই এলাকার প্রথম ব্যক্তি যাকে মুলায়ম সিং গ্রেপ্তার করেছিলেন। বিতর্কিত কাঠামো ভেঙে ফেলার পরে সিবিআইয়ের হাতে প্রথম গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তি ছিলাম আমি।”

এরপরের বছর ১৯৯৩ সালে মুম্বাইয়ের জেজে হাসপাতালে গুলি চালানোর ঘটনায় জড়িত দাউদ ইব্রাহিমের সহযোগীদের সাহায্য করার অভিযোগে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ (প্রতিরোধ) আইনে গ্রেফতার করা হয় ব্রিজভূষণকে। কিন্তু মাত্র কয়েক মাসই তিনি জেলে ছিলেন। এই ক্ষেত্রেও তার বিরুদ্ধে কোনো শক্ত প্রমাণ হাজির করতে না পারায় আদালতে বেকসুর খালাস পেয়ে যান তিনি। জানা যাচ্ছে, ২০০৪ সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে ব্রিজভূষণের বড় ছেলে শক্তি শরণ সিংহ নিজের বাবার বিরুদ্ধে স্বার্থপরতার অভিযোগ তুলে পিস্তল দিয়ে নিজের মাথায় গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করে ছিলেন। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী, আত্মহত্যার আগে শক্তি শরণ সিংহ একটি সুইসাইড নোটে জানিয়েছিলেন, বাবা ব্রিজভূষণের স্বার্থন্বেষী মনোভাবের জন্যই তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন।

২০১১ সালে ব্রিজভূষণ ভারতীয় কুস্তি সংস্থার সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পান। এরপর থেকে এক টানা এখনও পর্যন্ত এই পদেই বহাল আছেন তিনি। ২০২১ সালে একটি কুস্তি প্রতিযোগিতা চলাকালীন ব্রিজভূষণ মঞ্চে উঠে এক কুস্তিগিরকে চড় মারেন। সেই দৃশ্য ক্যামেরায় ধরাও পড়েছিল। যে কারণে সমালচনার মুখে পড়তে হয় তাকে। ২০২২ সালে অনলাইন সংবাদমাধ্যম ‘দ্য লল্লনটপ’-এ একটি ভিডিয়ো সাক্ষাতকারে ব্রিজভূষণ প্রকাশ্যেই নিজের হাতে একজনকে হত্যা করার কথা শিকার করে নেন। সেখানে তিনি বলেন, “লোকে যাই বলুক না কেন, আমি অতীতে একটি খুন করেছি। যে আমার প্রিয় বন্ধু রবীন্দ্র সিংহকে গুলি করেছিল তাকে আমি গুলি করে খুন করেছি।” রেসলিং ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ার (ডব্লিউএফআই) সভাপতি হওয়ার পর দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “কুস্তিগিরেরা শক্তিশালী ছেলে-মেয়ে। ওদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আরও শক্তিশালী কাউকে দরকার। আমার চেয়ে বেশি শক্তিশালী কেউ আছে নাকি এখানে?”

তবে এই মুহুর্তে এই সমস্ত কিছুকে ছাপিয়ে সব থেকে আলোচিত হয়ে উঠেছে প্রাপ্ত এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক কুস্তিগিরদের যৌন হেনস্থার অভিযোগ। ২০২৩ সালের জানুয়ারীতে, ভিনেশ ফোগাট , সাক্ষী মালিক , বজরং পুনিয়া সহ অলিম্পিয়ান এবং আন্তর্জাতিক কুস্তিগীরদের একটি দল ব্রিজ ভূষণ কর্তৃক মহিলা কুস্তিগীরদের যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলে তার গ্রেফতারি ও পদ থেকে বরখাস্তের দাবি তোলেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার বা ক্রীড়া মন্ত্রক কোনো পদক্ষেপ না করায় ২৩ এপ্রিলে যন্তর মন্তরে ধর্না বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভকারীরা ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের এবং তার অবিলম্বে গ্রেপ্তারের দাবি জানায়। ২৮ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপের পরে, দিল্লি পুলিশ তার বিরুদ্ধে দুটি এফআইআর নথিভুক্ত করে। এফআইআরগুলির মধ্যে একটি নাবালকের বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য পক্সো আইনের (দ্য প্রোটেকশন অফ চিলড্রেন ফ্রম সেক্সুয়াল অফেন্সেস অ্যাক্ট, 2012) নথিভুক্ত করা হয়। কয়েকজন প্রাপ্তবয়স্ক মহিলা কুস্তিগীরের অভিযোগের ভিত্তিতে আরও একটি এফআইআর নথিভুক্ত করা হয়ে। কিন্তু ব্রিজভূষণের উপযুক্ত শাস্তির পাশাপাশি ভারতীয় কুস্তি সংস্থার মাথা থেকে তাকে অবিলম্বে সরানোর দাবি জানান তারা। তাঁদের সেই দাবির কোনও সুরাহা হয়নি। অথচ দিল্লি পুলিশের হস্তক্ষেপে অবশেষে ২৮ মে যন্তর মন্তরে ধর্না বিক্ষোভ থেকে উঠতে বাধ্য হয়েছেন তাঁরা। ধর্নায় বসে পুলিশের হাতে আটক হতে হয় সাক্ষীদের।

অভিযোগ, ওই অপ্রাপ্তবয়স্ক কুস্তিগিরের ছবি তোলার নাম করে তাঁর শরীর ছুঁয়েছেন ব্রিজভূষণ। তাঁর কাঁধে-বুকে ইচ্ছাকৃত ভাবে হাত দিয়েছেন। অভিযোগ, শারীরিক সম্পর্কে ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও তাঁকে বার বার উত্ত্যক্ত করেছেন ভারতীয় কুস্তি সংস্থার সভাপতি। মহিলা কুস্তিগিরদের আরও অভিযোগ, রেস্তরাঁয় খেতে নিয়ে গিয়ে তাঁর শ্লীলতাহানি করেছেন ব্রিজভূষণ। আবার কারও অভিযোগ, নিশ্বাস-প্রশ্বাস দেখার নাম করে শরীরের বিভিন্ন গোপন অঙ্গে হাত দেন ব্রিজভূষণ। এক মহিলার কুস্তিগিরের অভিযোগ, ব্রিজ ভূষণ ২০১৮ সালে তার সম্মতি ছাড়াই তার পোশাক তুলেছিলেন। শীর্ষস্থানীয় বিক্ষোভকারীদের একজন আরও অভিযোগ করেছেন যে ২০২০ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে একটি পদক হারানোর জন্য ব্রিজ ভূষণ তাকে “মানসিকভাবে হয়রানি ও নির্যাতন করেছিলেন”। সাক্ষী মালিকেরা এ বার দু’টি এফআইআরে মোট ১০টি নিগ্রহের ঘটনার উল্লেখ করেছেন।

এদিকে দিল্লি পুলিশ বিজেপি সাংসদ ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির মামলায় প্রায় এখনও পর্যন্ত প্রায় ১২৫ জনের বয়ান রেকর্ড করেছে। পুলিশ সূত্রে খবর, এই সাক্ষীদের মধ্যে চারজন ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছেন এবং কুস্তিগীরদের অভিযোগককে মান্যতা দিয়েছেন। যাদের মধ্যে একজন রেফারি এবং একজন রাজ্য স্তরের কোচও আছেন বলে খবর।

কিন্তু এতো কিছুর পরেও কেন ব্রিজভূষণকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না সেই প্রশ্ন তুলেছেন দেশের অসংখ্য রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। এই প্রসঙ্গে বিরোধী দল কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি রাহুল গান্ধী আমেরিকা থেকে বিস্ফোরক অভিযোগ করে বলে, “২৫টি আন্তর্জাতিক পদক জয় করা দেশের মেয়েরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ন্যায়বিচার প্রার্থনা করছেন। আর দু’টি এফআইআর-এ ১৫টি যৌন হেনস্থায় অভিযুক্ত সাংসদ প্রধানমন্ত্রীর সুরক্ষাকবচের বলে সুরক্ষিত। দেশের মেয়েদের এই পরিস্থিতির জন্য মোদী সরকার দায়ী।” তিনি আরও বলেন, “পাহাড়প্রমাণ অভিযোগ, জনতার ধিক্কার সত্ত্বেও ব্রিজভূষণ সিংহকে এখনও গ্রেফতার করা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী চুপ, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চুপ, বিজেপি চুপ, আরএসএস চুপ। ফলে যাঁরা তদন্ত করছেন তাঁদের কাছে বার্তা স্পষ্ট। ‘সব কা সাথ’ নয়, ব্রিজভূষণকা সাথ!”

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কুস্তিগীরদের আন্দোলনকে সমর্থন করে বলেন, “কুস্তিগীরদের আন্দোলনের পাশে আছি আমরা। দেশের জন্য লড়াই করে পদক জিতেছেন কুস্তিগীররা। সেই কুস্তিগীরদের ওপরেই অত্যাচার, জুলুম মেনে নেওয়া যায় না।” এছাড়াও দেশের অধিকাংশ বিরোধী দলীয় নেতা থেকে শুরু করে সমাজসেবী, মানবাধিকার কর্মী, খেলোয়াড়রা কুস্তিগীরদের এই আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন এবং তাদের পাশে থাকার বার্তা দিয়েছেন। কপিল দেবের নেতৃত্বে বিশ্বকাপ জয়ী ক্রিকেট টিমও তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। ধীরে ধীরে বাড়ছে আন্দোলনের ধার। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ব্রিজভূষণকে গ্রেফতার না করলে কুস্তিগীররা তাদের সমস্ত পদক গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। এবার কী তাহলে ব্রিজভূষণকে গ্রেফতার করা হবে? এখন দেখার কেন্দ্রীয় সরকার কী ব্যবস্থা নেয়।

Related Articles

Back to top button
error: