সম্পাদকীয়

কৃষক মৃত্যুর তথ্য অস্বীকার করা অপদার্থতা না ঔদ্ধত্য

মুহাম্মদ নুরুদ্দিন,লেখক

মুহাম্মাদ নূরুদ্দীন : ১ ডিসেম্বর ২০২১। ভারতের জাতীয় সংসদে ঘটে গেল আরেক পরিহাস। কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র সিং তোমর লোকসভায় একটি লিখিত প্রশ্নের উত্তরে জানান তাঁর দপ্তরে আন্দোলনরত কৃষকদের মৃত্যুর কোন তথ্য নেই। ফলে মৃত কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রশ্নই উঠছে না। কৃষি মন্ত্রীর এই বিবৃতি একদিকে যেমন হাস্যকর তেমনি উদ্বেগ পূর্ণ ও দুশ্চিন্তার বিষয়ও বটে। কেননা, এটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট যে কেন্দ্রীয় সরকারের আনা তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার করার দাবিতে কৃষকরা দেশ জুড়ে প্রায় এক বছর যাবত আন্দোলন চালিয়ে গেছেন। সংযুক্ত কিষান মোর্চার নেতা কৃষি মন্ত্রীর এই বিবৃতিকে দুর্ভাগ্যজনক বলে মন্তব্য করে জানিয়েছেন ৬৮৯ জন কৃষক আন্দোলন চলাকালীন সময়ে মৃত্যুবরণ করলেও সরকার তাকে অস্বীকার করছে। তিনি আরো জানান, এই সকল মৃত কৃষকদের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে তাঁরা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন এবং সরকার যাতে তাঁদের ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয় সে ব্যাপারে তাঁরা সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করে যাবেন।

প্রশ্ন হল, কোন গণতান্ত্রিক দেশের সরকার বিশেষ করে কৃষি মন্ত্রী কিভাবে এত বেপরোয়া হতে পারেন। এ তো কৃষকদের সঙ্গে নির্মম পরিহাস করা হচ্ছে। কয়েকটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তথা কেন্দ্রীয় শাসকদল ভারতীয় জনতা পার্টি তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং যথাযথ সে সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে পার্লামেন্টে বিল আনা হয়েছে এবং তা রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর পাওয়ার পর আইনে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ পূর্বের তিনটি কৃষি আইন পদ্ধতিগতভাবে সম্পূর্ণ বাতিল হয়ে গেল।

কৃষি আইন প্রত্যাহার হল কিন্তু এতে সমস্যার সমাধান হলো কি? সমস্যা ঠিক যতটা কৃষি আইনে ছিল তার থেকে বেশি ছিল সরকারের মানসিকতার মধ্যে। একটি গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচিত সরকার যদি স্বেচ্ছাচারী ও উদ্ধত্যপূর্ণ ব্যবহার করতে থাকেন, সরকার যদি কোন বিষয়ে কারো সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করার কোন প্রয়োজন মনে না করেন তাহলে তাকে আর যাই হোক গণতন্ত্র বলা যায়না।

দেশে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ সরকারের মিনিমাম কর্মসূচির মধ্যে পড়ে। কোন সরকার বা সরকারের কোন দপ্তর সেই দায়িত্বটুকু পালন যদি করতে না চান তাহলে তাতো ব্যর্থতা বলে গণ্য হবেই। কিন্তু যদি ঔদ্ধত্য বসত এই কর্তব্যকে কেউ অবহেলা করে এবং যা করেছি বেশ করেছি মানসিকতা প্রদর্শন করতে থাকে তাহলে তার থেকে ভয়ঙ্কর আর কিছু হতে পারে না। গোটা বিশ্ব দেখেছে ভারতবর্ষের কৃষকরা তাদের দাবি আদায়ের জন্য কিভাবে মরণপণ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সেই আন্দোলনে শীতের তীব্রতা, গ্রীষ্মের প্রখরতা, বর্ষার ঝড় ঝঞ্ঝা সবকিছু উপেক্ষা করে কীভাবে কৃষকরা মাটি কামড়ে পড়ে ছিলেন। এই আন্দোলনে তাদের একের পর এক প্রাণ ঝরে যেতে থেকেছে কিন্তু তারা আন্দোলনের রাস্তা থেকে সরে যায়নি। এমনকি তাদের প্রতিবাদ মিছিলের উপর সরকারি দলের এমএলএর ছেলের গাড়ি একের পর এক কৃষকদের পিষ্ট করে চলে গেলেও সরকারের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। তারপর ও যদি সরকার বলে যে তার কাছে একটি শব্দের মৃত্যুর কোন তথ্য নেই এর থেকে বড় পরিহাস আর কি হতে পারে। সংসদে পেশ করা কৃষিমন্ত্রীর বক্তব্যে এই উদ্ধত্য প্রকাশ পেয়েছে এটা গণতন্ত্রের জন্য ভয়ঙ্কর।

অবশ্য নরেন্দ্র মোদি সরকারের এই অভ্যাস নতুন নয়। সংসদে এবং তার বাইরে ঘটে যাওয়া বহু ঘটনার ব্যাপারে সরকার নির্বিকার থেকেছে। এমনকি সরকারের দপ্তরেও সে ব্যাপারে কোন তথ্য রাখা হয়নি। ইতি পূর্বে সংসদে প্রশ্ন ছিল করোণা মহামারীর কারনে ঘোষিত লকডাউনে কতজন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে? সরকার কোনো তথ্য দিতে পারেনি। এমনকি লকডাউনের কারণে কাজ হারিয়ে কত মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে? অর্থ মন্ত্রকের কাছে তার কোনো রিপোর্ট নেই। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় অক্সিজেনের অভাবে কত মানুষের মৃত্যু ঘটেছে? সরকার সে তথ্য রাখার কোনো প্রয়োজন মনে করেনি। দেশে ক্রিপ্টোকারেন্সিতে লগ্নি করেন কতজন? আমাদের দেশের অর্থমন্ত্রীর কাছে তার কোন তথ্য নেই। এই সরকার কোনোভাবেই জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা স্বীকার করতে চায় না। ক্ষমতার উৎস ও বেপরোয়া মানসিকতা তাদেরকে লাগামহীন করে দিয়েছে। যে কোন দেশের জন্য এটা খুবই বিপদজনক।

Related Articles

Back to top button
error: