সম্পাদকীয়

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি-কে ঠেকানোর উপায় কি “মহাজোট”?

প্রসেনজিৎ বোস, টিডিএন বাংলা: বিহার নির্বাচনে জিতে এনডিএ জোট ক্ষমতায় ফেরার পর বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন নিয়ে তৎপরতা বাড়িয়েছে। মোদী-শাহ্‌র নির্দেশে বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সংগঠনের রাশ নিজেদের হাতে তুলে নিয়ে নির্বাচনের গুটি সাজাচ্ছে। অন্যদিকে এক দশক ধরে ক্ষমতায় থাকার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ তো ছিলই, দক্ষিণবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে আমফান ক্ষতিপূরণ বণ্টনে শাসকদলের দুর্নীতি সেই ক্ষোভের মাত্রা অনেকটাই বাড়িয়েছে। ফলে তৃনমূল কংগ্রেসের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নতুন মাত্রা পেয়েছে, অনেক নেতারাই বেসুরে গাইছে, মেদিনীপুরের শুভেন্দু অধিকারী যার সর্বশেষ উদাহরণ। এই পরিস্থিতিতে আসন্ন নির্বাচনে বিজেপি-র জেতার সম্ভাবনা নিয়ে অনেকেই উদ্বিগ্ন।

বাংলায় বিজেপি ক্ষমতায় এলে যে রাজ্যের সমূহ বিপদ তা সন্দেহাতীত। কোভিড মহামারি এবং অর্থনৈতিক সঙ্কটে জর্জরিত মানুষের সুরাহায় মোদী সরকার বাগাড়ম্বর ছাড়া কিছুই করেনি, উপরন্তু সঙ্কটকে কাজে লাগিয়ে আম্বানি-আদানীদের হাতে দেশের সম্পদ, কৃষি, শ্রমিকদের অধিকার, পরিবেশ সব বিক্রি করে দিচ্ছে। অযোধ্যায় রাম মন্দির বানিয়ে, কাশ্মীরের ক্ষেত্রে ৩৭০ ধারা বিলোপ করে এবং এনআরসি-এনপিআর-সিএএ ২০১৯-কে হাতিয়ার করে মোদী সরকার ভারতে একটি সাম্প্রদায়িক হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার দিকে এগিয়ে চলেছে।

ওরা কয়েক কোটি বাঙালি উদ্বাস্তু এবং দলিত-আদিবাসী-মুসলিম সংখ্যালঘুদের “অনুপ্রবেশকারী” দাগিয়ে, নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে জেলখানায় পুড়তে চায়। অসমে এই লক্ষ্যে ওরা অনেকটাই এগিয়েছে। বাংলায় দিলীপ ঘোষও প্রকাশ্যে এই হুমকি দিয়েছে। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে ‘অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসঙ্ঘ’ এবং এই জাতীয় আরও কিছু উদ্বাস্তু সংগঠন ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব নির্ণয় করার অসাংবিধানিক খেলায় বিজেপি-র দোসর হয়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গে এই রাজনীতির আধিপত্য কায়েম হলে স্বাধীনতার আগের দেশভাগের পরিস্থিতি ফিরে আসবে, বাংলা আবার সাম্প্রদায়িক নরকে পরিণত হবে। সুতরাং আসন্ন নির্বাচনে বিজেপি-র বিরুদ্ধে সকলেরই সক্রিয় হওয়া উচিৎ, তৃনমূল রাজত্বের ফুটন্ত কড়াই থেকে বিজেপি-র জ্বলন্ত আগুনে ঝাঁপ দেওয়া হবে মস্ত বড় ভুল।

বাংলায় বিজেপি-র ক্ষমতায় আসা আটকাতে অনেকেই আবার বিহারের মতন একটি বিজেপি-বিরোধী “মহাজোট” নির্মাণের কথা বলছেন — অর্থাৎ শাসক তৃনমূল কংগ্রেস, সিপিআইএম-সহ বাম দলগুলি এবং কংগ্রেসের নির্বাচনী জোট। এই প্রসঙ্গে প্রথমেই যেটা উল্লেখযোগ্য তা হল বিহারে এই “মহাজোট” করেও কিন্তু এনডিএ জোটকে আটকানো যায়নি, একটি ভালো লড়াই দেওয়া গেছে মাত্র। দ্বিতীয়ত, বিহারের মহাজোটের মূল স্তম্ভ আরজেডি বিগত ১৫ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে, যার ফলে অন্যান্য দলগুলির সাথে জোট গড়া বা আসন বণ্টন করা সম্ভবপর হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে তৃনমূল কংগ্রেস এখনো একক ভাবে শাসন ক্ষমতায়; কংগ্রেস এবং বামফ্রন্ট বিধানসভায় বিরোধী দল। নির্বাচনের মুখে বিধানসভায় শাসক এবং বিরোধী দলগুলির আচমকা জোট তৈরি করা রাজনৈতিক এবং আসনবণ্টন, দুই নিরিখেই বেশ কঠিন। তাই বিহারে যা হয়েছে তাই পশ্চিমবঙ্গে করা উচিত যারা বলছেন তারা পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক বাস্তবতার থেকে বিচ্ছিন্ন।

যেটা সম্ভব সেটা হল তৃনমূল কংগ্রেস এবং কংগ্রেসের জোট, যেটা ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনে জিতেছিল। এই জোটের রাজনৈতিক ভিত্তি নিয়ে খুব একটা সমস্যা নেই কারণ পশ্চিমবঙ্গে এরা একাধিকবার জোট করেছে এবং কেন্দ্রীয় স্তরে গত কয়েক বছর একসাথে মোদী সরকারের বিরোধিতাও করছে। রাজ্য রাজনীতিতে তৃনমূল এবং কংগ্রেসের দ্বন্দ্ব মূলত নেতৃত্ব নিয়ে, কর্মসূচি বা মতাদর্শ নিয়ে ওদের খুব একটা পার্থক্য নেই। নেতাদের কায়েমি স্বার্থকে অগ্রাধিকার না দিয়ে বৃহত্তর রাজনৈতিক স্বার্থের কথা ভাবলেই তৃনমূল কংগ্রেস এবং কংগ্রেস অনায়াসে জোট গঠন করতে পারে।

মুখ্যমন্ত্রী পুলিশ-গুন্ডা-ভোটলুটের মাধ্যমে নিজের দলের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার স্বৈরাচারী উচ্চাকাঙ্ক্ষা থেকে সরে এসে কংগ্রেসকে উত্তরবঙ্গে পর্যাপ্ত আসন এবং ভাঙ্গিয়ে নেওয়া কিছু বিধায়ক-প্রার্থী ফেরত দিলে এই জোট এখনো সম্ভব। অন্যদিকে অধীর চৌধুরীর মতন কংগ্রেস নেতাদের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার অলীক স্বপ্ন এবং কৃত্রিম তৃনমূল-বিরোধিতা ছেড়ে, বিহারের থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের ক্ষমতার অতিরিক্ত আসনের দাবি না করে, বাস্তব-সম্মত ভাবে এই জোট গড়া উচিত। তৃনমূল কংগ্রেস এবং কংগ্রেসের জোট হলে ধর্মনিরপেক্ষ ভোটের ভাগাভাগি কম হবে, বিজেপি-কে আটকানো সম্ভব হবে।

২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচন থেকে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি-র ভোট বেড়েছে ১ কোটি ৭৪ লক্ষ (৩০%), তৃনমূল কংগ্রেসের বেড়েছে মাত্র ১.৯ লক্ষ (- ২.৩%); অন্যদিকে বামফ্রন্টের ভোট কমেছে ১ কোটির বেশি (- ১৯%), কংগ্রেসের কমেছে প্রায় ৩৫ লক্ষ (- ৭%)। অর্থাৎ সিপিআইএম এবং বামফ্রন্টভুক্ত দলগুলির সমর্থক এবং ভোটারদের বিজেপি-র দিকে চলে যাওয়াই পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি-র উত্থানের প্রধানতম কারণ। এই প্রাক্তন বাম সমর্থকেরা তৃনমূল-বিরোধী, তারা সিপিআইএম-বামফ্রন্ট নেতৃত্বের প্রতি আস্থা হারিয়ে বিজেপি-র দিকে ঝুঁকে গেছে। সিপিআইএম-বামফ্রন্ট যদি এখন তৃনমূলের সাথে জোট করে তাহলে তাদের বাকি সমর্থকরাও এই “আগে রাম-পরে বাম” লাইনে বিজেপির দিকে চলে যাবে।

সিপিআইএম “বঙ্গব্রিগেডের” কংগ্রেসের সাথে জোটের লাইনটা যে ভ্রান্ত সেটা ২০১৬-র নির্বাচনেই প্রমাণিত। সেই সুবিধাবাদী জোটের না ছিল কোন বিকল্প কর্মসূচি, আসন বণ্টনের অঙ্কটাও ছিল সম্পূর্ণ ভুলভাল — ফলে ওই জোট করে বামফ্রন্ট বিধানসভায় দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় হয়ে যায়। ন্যাড়ার বারংবার বেলতলায় যাওয়ার মতন সিপিআইএম-বামফ্রন্টের নেতৃত্ব আবার ২০২১ নির্বাচনের আগে কংগ্রেসের সাথে জোটগঠনে সচেষ্ট হয়েছে। এর কারণ এই অপদার্থ বৃদ্ধতন্ত্রের এমনিতেই আর কিছু করার নেই। এই অফিস থেকে ওই অফিসে ঘুরে ঘুরে জোট-জোট খেলা খেললে এদের সময় কেটে যায়, মিডিয়াতেও ভেসে থাকা যায়। কিন্তু এইসব করে জনসমর্থন আদায় করা যায় কি?

বামফ্রন্ট আর কংগ্রেসের ২০১৯-এর নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোট শতাংশের যোগফল ১৩%, বিজেপির ৪০%, তৃনমূলের ৪৩%। কোন ভিত্তিতে ২০২১-এ এসে জনগণ বাম-কংগ্রেস জোটকে ভোট দিয়ে জেতাবে?

এইসব না করে বামপন্থীরা যদি একত্রে এসে তৃনমূল কংগ্রেস সরকারের অপশাসন এবং সাম্প্রদায়িক বিজেপি-র বিপদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিকল্প কর্মসূচির ভিত্তিতে নির্বাচন লড়ে, তাহলে বাম-ভোটের ক্ষয় রোধ করা এখনো সম্ভব হতে পারে। ২০১৯-এর ফলের নিরিখে আসন হয়তো বামফ্রন্টের একটা-দুটোর বেশি জেতা মুশকিল। কিন্তু বিজেপি-তে চলে যাওয়া ভোটের একটা ছোট অংশকেও যদি বামফ্রন্ট ফিরিয়ে আনতে পারে তাহলে বিজেপি-র পক্ষে নির্বাচনে জেতা অসম্ভব হয়ে পড়বে। ২০২১-এ বিজেপি ক্ষমতায় না আসতে পারলে বামপন্থীরা এই রাজ্যে ঘুরে দাঁড়াবার সুযোগ পাবে।

এক বাক্যে বলতে গেলে, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি-কে ঠেকাতে হলে কোন মহাজোট নয়, যেটা দরকার তা হল একদিকে তৃনমূল কংগ্রেস আর কংগ্রেসের জোট, আর অন্যদিকে একটা ঐক্যবদ্ধ বামপন্থীদের ফ্রন্ট যেটা জিততে না পারলেও বিজেপি-র ভোট কমিয়ে নিজেদের দিকে নিয়ে আসতে পারে। “জোট-পন্থী” এবং “মহাজোট-পন্থী”-রা একবার ভেবে দেখবেন।

(লেখক: অর্থনীতিবিদ ও নাগরিক পঞ্জি বিরোধী আন্দোলনের নেতা।)

Related Articles

Back to top button
error: