সম্পাদকীয়

সংশোধিত কৃষি আইনঃ কর্পোরেট সংস্থার পৌষ মাস সাধারণ মানুষের সর্বনাশ

মোহাম্মদ নুরুদ্দিন, টিডিএন বাংলা: সারা দেশের কৃষক সমাজ যখন কৃষি আইনের সংশোধনের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করছে ঠিক তখনই মহামান্য রাষ্ট্রপতি সমস্ত দাবি উপেক্ষা করে কৃষি আইন সংশোধন ২০২০ তে সাক্ষর করলেন । যার ফলে এই বিল আইনে পরিনত হয়ে গেল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বললেন কৃষকরাই আত্ম নির্ভরশীল ভারতের কান্ডারী। এই আইন কৃষকদের সুদিন ফেরাবে। অপরদিকে ভারতের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি এই আইন পাশের দিনটিকে কালা দিবশ বলে সম্বোধন করেছেন। পাঞ্জাব থেকে হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ সর্বত্রই ক্ষোভে ফুঁসছে কৃষক সমাজ।
একদিকে প্রধানমন্ত্রীর দাবি কৃষকদের স্বার্থ সুরক্ষিত করার জন্য এই ঐতিহাসিক পরিবর্তন। অপরদিকে কৃষকরা রাস্তায় নেমে এই পরিবর্তনের বিরোধিতা করছেন। কেন এই বৈপরিত্ব? কী আছে এই আইনে? এই আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে কী পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে? এই আইন কৃষকদের স্বার্থ কতটা সুরক্ষিত করবে আর কৃষকদের বিরোধিতা করার কারনই বা কী ?
বিজেপির প্রচারযন্ত্র এই আইনের স্বপক্ষে দিনরাত নানান যুক্তি দিয়ে চলেছে। কিন্তু তারা তাদের বিশ্বস্ত শরিক শিবসেনা আকালি দল এর মত সদস্যদেরকেও কে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। বাধ্য হয়ে প্রতিবাদে এনডিএ ছেড়েছে আকালি দল। এই বিল পাস করানোর ক্ষেত্রেও গণতান্ত্রিক রীতিনীতি এবং ভারতীয় গণতন্ত্রের ঐতিহ্যকে সম্পূর্ণ ধূলিস্যাৎ করা হয়েছে। কোভিড ১৯ এর অজুহাতে বিস্তারিত আলোচনা করার সুযোগ দেয়া হয়নি আইনসভার সদস্যদের। উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষ কোনখানে বিল নিয়ে বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়নি। এমনকি তৃণমূল কংগ্রেসের যে সাংসদরা এই বিলের বিরোধিতা করেছিল তাদেরকে সাময়িকভাবে সংসদ থেকে বরখাস্ত করা হয়। রাজ্যসভায় ও আলোচনা করার সুযোগ দেয়া হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, কী আছে এই বিলে? এই বিল পাশ করে আইনে পরিণত করার জন্য সরকারের এত তাড়াহুড়া কেন? কেনইবা যেনতেন প্রকারে এই বিলটা কার্যকরী করতে চাচ্ছে সরকার? এতে সত্যিই কী কৃষকদের কল্যাণ হবে? নাকি ভারতের বহুজাতিক সংস্থাগুলি বা বড় বড় ব্যবসায়ীদের আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হবে।
একই সঙ্গে তিনটি আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এফ পি টি সি বা কৃষি পণ্য বাণিজ্য বিল ২০২০। এই আইনের মাধ্যমে খাদ্যদ্রব্য গুদামজাত করার উপর যাবতীয় বিধি নিষেধ তুলে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ যে কেউ যে কোন পরিমাণ খাদ্য শস্য গুদামজাত করতে পারবে এবং সেখানে কোন বিধি-নিষেধ থাকবে না। যা আগে ছিল। দ্বিতীয়তঃ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের তালিকা থেকে চাল, ডাল, আলু, পিয়াজ এর মত কৃষিপণ্য গুলিকেও বাদ দেয়া হয়েছে। যাতে বিশেষ জরুরী অবস্থা ছাড়া এই সকল পণ্য সীমাহীনভাবে গুদামজাত করা যাবে।তৃতীয়তঃ এ পি এম সি অর্থাৎ এগ্রিকালচারাল মারকেটিং কমিটি। এই কমিটির কাজ ছিল কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণ করা। নতুন সংশোধনী এনে এই কমিটিকে ভেঙে দেয়া হলো। যার ফলে কৃষিপণ্যের আর কোন নির্ধারিত মূল্য থাকবে না এবং সরকার নির্ধারিত সহায়ক মূল্যের মাধ্যমে কৃষকদের কাছ থেকে খাদ্যশস্য কিনতে বাধ্য থাকবে না। অর্থাৎ যেকোনো পাঁচটা পণ্য-সামগ্রীর মত কৃষিপণ্য উৎপাদক এবং ক্রেতার দরদামের মধ্য দিয়েই তার মূল্য নির্ধারিত হবে। যে যেমন খুশি দামে ক্রয় করতে পারে এবং যেমন খুশি দামে তা বিক্রয় করতে পারে। তার উপর সরকার বা কোন সংস্থার কোন নিয়ন্ত্রণ থাকবে না।
এককথায় একেই কৃষিপণ্যের খোলাবাজার বলা যেতে পারে। ১৯৯১ সালে যখন মনমোহন সিং খোলা মার্কেটের আমদানি করলেন। তখন কৃষিপণ্য কে তার আওতার বাইরে রাখা হয়েছিল। কৃষকদের স্বার্থের কথা চিন্তা করেই আমদানি রপ্তানির ক্ষেত্রে এবং গুদামজাত করার ক্ষেত্রে কৃষি পণ্যের উপর নিয়ন্ত্রণ ছিল। তার মূল কারণ ছিল কৃষকদের স্বার্থ রক্ষা করা।
এই বিলের পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলা হয়েছে এর ফলে কৃষিপণ্য ব্যবসায় ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগ বাড়বে। প্রতিযোগিতা হবে বহুমুখী। যার ফলে পণ্যের দাম কম হবে আর কৃষকরা বেশি মূল্য পাবে। মাল গুদামজাত করার প্রবণতা বাড়বে। যার ফলে কৃষকদের ফসল নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা কমবে।
তার পরিপ্রেক্ষিতে কৃষকদের পক্ষ থেকে দাবি উঠেছে সরকার যদি সত্যিই কৃষকদের কল্যান চায় তাহলে ন্যূনতম কৃষি মূল্য তুলে দিতে এত আগ্রহী কেন? খোলাবাজারে কৃষিপণ্য বিক্রয় করার যেমন সুযোগ থাকা উচিত তেমনি যে কোন সংস্থাকে সর্বনিম্ন নির্ধারিত মূল্য মেনে জিনিস ক্রয় করার নিয়ম থাকা উচিত। তা না হলে বাণিজ্যিক সংস্থা গুলির ফাঁদে পড়ে কৃষকরা সর্বস্বান্ত হতে বাধ্য হবে।
যদি আমরা আমাদের দেশের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব যে সর্বত্রই সৎ পথে ব্যবসা করার থেকে অসৎ পথে ব্যবসা করার প্রবণতা ব্যবসায়ীদের মধ্যে বেশি। পুঁজিপতিরা তাদের পুঁজির জোরে একসময় বাজার থেকে ব্যাপকহারে কৃষি সামগ্রী সংগ্রহ করে গুদামজাত করে নিতে পারে। এভাবে মার্কেটে কৃত্তিম ক্রাইসিস সৃষ্টি করে দাম বাড়ানোর প্রবণতা আমাদের দেশে অত্যন্ত বেশি। এবং সে ক্ষেত্রে সরাসরি আঘাত গিয়ে পড়বে সাধারণ ক্রেতাদের ঘাড়ে। জিনিসপত্রের দাম নির্ধারণ করবে সেই কর্পোরেট সংস্থাগুলি যারা আগে থেকেই মাল সংগ্রহ করে নিজেদের অধীনস্থ করে রেখেছে। মধ্যবিত্ত ও গরিব মানুষ তাদের নির্ধারিত মূল্যে মাল কিনতে বাধ্য হবে। মাঠে যখন ফসল উঠবে তখন কৃষকদের কাছ থেকে মাল কেনার ক্ষেত্রে ও কর্পোরেট সংস্থাগুলি নানান কৌশল অবলম্বন করতে পারে। সাধারণত কৃষকরা ফসল উৎপন্ন হওয়ার সাথে সাথেই তা বিক্রি করতে বাধ্য হয়। প্রথমত গরীব কৃষকদের পণ্য গুদামজাত করার পরিকাঠামো নেই ।দ্বিতীয়তঃ তারা ঋণ নিয়ে চাষ করে। ফসল বিক্রি করে সেই ঋণ শোধ করার প্রয়োজন হয়। যার ফলে দাম বাড়ার অপেক্ষা করার সুযোগ তার সামনে আর থাকেনা। তৃতীয়তঃ ফসল বিক্রি করে না দিলে তা নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই ফসল জমি থেকে তুলে তা বিক্রি করে দেওয়ার ব্যাপারে গরিব চাষিদের বাধ্যবাধকতা থাকে। যদি কর্পোরেট সংস্থাগুলি এই সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে তাহলে তা কোনোভাবেই আটকানো সম্ভব হবে না। তারা গরিব চাষিদের কাছ থেকে অতি কম দামে মাল কিনবেন এবং তা গুদামজাত করে বাজারে কৃত্তিম সঙ্কট তৈরি করে সেই বাজারেই তা চড়া দামে বিক্রি করবে। বাজার নিয়ন্ত্রণ করা, মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা, সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষা করার দায়িত্ব সরকারের। এক্ষেত্রে সরকার কোন দায়িত্ব পালন করতে পারবে না।আমাদের দেশে সরকারের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেক সময় লক্ষ্য করা গেছে যে অনেক কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয় না। তার পিছনে হয়তো থাকে এই ধরনের বড় বড় সংস্থাগুলির অঙ্গুলিহেলন। চাষীদের ক্ষতিপূরণ আটকাতে প্রয়াত অর্থমন্ত্রী অরুণ সৌরি টমাটো পেঁয়াজ এবং আলু প্রসেসিং করার জন্য ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিলেন লক্ষ্য করা যায় সেই অর্থবর্ষে তার ৫ শতাংশ ব্যয় হয়নি।
এখন সরকার মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস (এম এস পি) বা ন্যূনতম সহায়ক মূল্য তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে । এই নিয়ম চলে আসছে বহুদিন থেকে। ষাটের দশকের গোড়ায় কৃষক সমাজকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে এই আইন পাশ করা হয়েছিল। ভারতে প্রায় ২৫০০ ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে কৃষকের পণ্য খরিদ করার কেন্দ্র আছে। এই কেন্দ্রগুলিতে কৃষকরা তাদের ফসল বিক্রি করলে সরকার নির্ধারিত দামে তা খরিদ করে। এর ফলে কৃষকরা ক্ষতির হাত থেকে বেঁচে যায়। বাজারমূল্য অনুযায়ী কৃষকের দাম ঠিক করার জন্য সরকার নির্ধারিত কমিটি তৈরি করে দেয়। সামগ্রিকভাবে কৃষকদের স্বার্থ রক্ষা করাই এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু এখন সেই আইন তুলে দেওয়া হচ্ছে।ফল সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে দেশের গরীব কৃষকরা।
কেন্দ্রীয় সরকার নতুন আইন মেনে চুক্তি চাষের উপর গুরুত্ব আরোপ করছে। অর্থাৎ গরিব কৃষকরা বড় বড় কর্পোরেট হাউসের সঙ্গে চুক্তির বিনিময়ে চাষ করবে। আমরা জানি আমাদের দেশের দাদন ব্যবস্থায় জর্জরিত কৃষকদের অবস্থার কথা। প্রথমত এই চুক্তি হবে গরিব অশিক্ষিত দুর্বল কৃষকদের সঙ্গে কর্পোরেট সংস্থার। স্বাভাবিকভাবেই গরিব চাষিদের ঠকানোর জন্য সব ধরনের সুযোগ তারা গ্রহণ করবে। সে ক্ষেত্রে চুক্তির মারপ্যাঁচ বোঝার ক্ষমতা গরিব চাষিদের কতটুকু থাকবে তা বলা মুশকিল। তাছাড়া চুক্তিভিত্তিক চাষের ক্ষেত্রে কোন সমস্যা হলে গরিব চাষির পাশে কে দাঁড়াবে? সরকার সে ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই দাঁড়াবে না। তাহলে তাদের হয়ে লড়াই করবে কে? কোন ক্ষেত্রে বিবাদ যদি আদালত পর্যন্ত গড়ায় তাহলে যাদের আদালত কিনে নেওয়ার ক্ষমতা আছে তাদের সঙ্গে গরিব চাষি লড়বে কীভাবে? আমরা ভারতের বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে বর্তমান যে অবস্থা দেখছি তাতে সাধারণ মানুষের সুবিচার পাওয়ার দিন শেষ হয়ে আসছে। সেই অবস্থায় চুক্তিভিত্তিক চাষ গরীব চাষিদেরকে কীভাবে রক্ষা করবে? এছাড়া চুক্তির যাঁতাকলে গরিব চাষিদেরকে একবার বেঁধে ফেলতে পারলে সেই সুদখোর মহাজনদের মত চক্রবৃদ্ধি হারে তাদের জমি-জিরেত বাড়ি সবকিছু গ্রাস করে নেওয়ার পথ সুগম হবে। এই বিলে সরকার সেই সুযোগ করে দিতে চেয়েছে। অর্থাৎ এক কথায় এদেশের ক্ষুদ্র চাষীদের অস্তিত্ব নির্মূল করে দেওয়ার জন্য তাদের কফিনে শেষ পেরেক টুকু গেঁথে দেওয়া হল। এখন থেকে গোটা দেশ হবে হাতেগোনা কয়েকজন কর্পোরেট মালিকের জমিদারি। আর সাধারণ গরিব কৃষক শ্রমিক হবে তাদের দাস। তারা যা খুশি তাই করতে পারবে। এই আইনে সেই ধরনের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।

Related Articles

Back to top button
error: