শিক্ষা ও স্বাস্থ্য

বাঙালি মুসলিম সমাজে শিক্ষা প্রসারে আল আমীন মিশনের ভূমিকা…..

সামিনুর আলম

(কলমে আল আমীন মিশনের প্রাক্তন ছাত্র সামিনুর আলম বর্তমানে এস এস কে এমে ডাক্তারি পড়ছে।)

সত্তরের দশকে বাঙালি মুসলিম সমাজ যখন শিক্ষা থেকে যোজন কোষ দূরে, তখন মুসলিম সমাজে শিক্ষার প্রসারের প্রতিনিধি হিসাবে তেমন কেউ এগিয়ে আসেনি। আশির দশক প্রায় শেষের দিকে মুসলিম সমাজকে শিক্ষার আলো দেখানোর জন্য প্রতিনিধি হিসাবে এগিয়ে আসেন এম নুরুল ইসলাম স্যার আর এই শিক্ষার আলো পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম সমাজের সর্বস্তরের বিস্তারের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন আল আমীন মিশন।সবার আল আমীন মিশন প্রতিষ্ঠার ইতিবৃত্ত জানা দরকার। ১৯৫৯ সালের ১৭ অক্টোবর হাওড়া জেলার খলতপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এম. নুরুল ইসলাম স্যার। ছোট থেকেই অত্যন্ত মেধাবী ও প্রখর দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ছিলেন। ১৯৮৪ সালের মে মাসে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলায় খলতপুর গ্রামে তিনি ইন্সটিটিউট অফ ইসলামিক কালচার” নামে প্রতিষ্ঠানের শুরু করেন। ১৯৮৬ সালে মুষ্টির চাল নিয়ে হাই মাদ্রাসা ভবনেই আবাসিক ছাত্রাবাস শুরু করেন পরে ১৯৮৭ -র  ১ লা জানুয়ারী মাসে এটি নামান্তর করে হয় আল-আমীন মিশন। সাত জন শিক্ষার্থীকে নিয়ে পথ চলা শুরু করেছিলেন স্বপ্নের ফেরিওয়ালা নুরুল স্যার আর বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্য শুনলে অনেকে হয়তো চমকে যাবেন, সংখ্যাটা কুড়ি হাজার পার হয়ে গেছে। সাত থেকে কুড়ি হাজার শিক্ষার্থী সংখ্যা পৌঁছাতে কত অপমান, লাঞ্চনা হতে হয়েছে নুরুল স্যারকে কিন্তু স্যারের মনের উদ্যম ইচ্ছা ও লক্ষ্যের প্রতি অবিচল থাকার জন্যই এটা সম্ভব হয়েছে। অসম্ভব কে সম্ভব করে দেখিয়েছে স্বপ্নের ফেরিওয়ালা নুরুল ইসলাম স্যার।

শুরু হলো পথ চলা অনুন্নত এলাকা থেকেও দরিদ্র মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের মিশনের আনা হলো। সেই দরিদ্র মেধাবী ছাত্রদের পড়াশোনার জন্য যথেষ্ট অর্থের দরকার ছিল। সেই অর্থ যোগাতে বেরিয়ে পড়তেন ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে। যাকাতের টাকা ও কিছু সমাজসেবী মানুষের সাহায্যে চলতে শুরু করলো আল আমীন মিশন। যখন যাকাত ও সমাজসেবী দের সাহায্য পর্যাপ্ত পরিমাণে আসতো না তখন নুরুল ইসলাম স্যার নিজের স্ত্রীর গয়না বাধা সেই অর্থাভাব মিটিয়েছেন । প্রথম থেকেই স্যারে ইচ্ছা ছিলো শুধু শিক্ষিত নয় ,মানুষের মতো মানুষ তৈরি করতে হবে । পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম সমাজের শিক্ষাবিপ্লব আনতে শুধু একটি আবাসিক মিশন যথেষ্ট নয় সেটা আগে বুঝতে পেরেছিলেন নুরুল স্যার। তাই পশ্চিমবঙ্গের সব জেলা জুড়ে শুরু হল আল-আমিন মিশনের বিভিন্ন শাখা তৈরির প্রকল্প। রাজ্যের ১৭ টি জেলা জুড়ে ৭০ টি শাখা ছড়িয়ে আছে; এই রাজ্য ছাড়াও, আসাম, ত্রিপুরা, মধ্যপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ডের মতো অন্যান্য রাজ্যের মধ্যে ইহা বিস্তৃত হলো। পশ্চিমবঙ্গের ৭০টি শাখা তৈরীর পেছনে কতটা কঠোর পরিশ্রম আছে সেটা একমাত্র নুরুল স্যারই জানেন। তাঁর নিরলস পরিশ্রম, স্বপ্নকে ছোঁয়ার অদম্য জেদ ও প্রখর দূরদৃষ্টির জন্য মাত্র ৩৪বছরে আল আমীন মিশনের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৭জন থেকে ২০হাজারে পৌঁছেছে। এখনও পর্যন্ত মিশন থেকে পাশ করে বেরিয়েছে ২৯হাজার ছাত্র ছাত্রী। যার মধ্যে ৪০০০ডাক্তার এবং স্বাস্থ্য কর্মী ও ৪০০০ এর উপর ইঞ্জিনিয়ার। কেউ তার মতোই মানুষ গড়ার কারীগর, আবার কেউ বা করছেন গবেষণা। অনেকেই আজ উচ্চপদে কর্মরত সরকারী কর্মচারী। আল আমীন মিশন আক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন সমাজে শিক্ষার আলো জ্বেলে দেওয়ার জন্য।আল আমীনের মতো আরও অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দরকার সমাজে, যদিও এখন অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি হতে শুরু করেছে। এককথায় আল আমীন দরিদ্র মেধাবী ছাত্রের সাফল্যের সোপান। আল আমীন ছিল বলেই মুসলিম সমাজের কতটা শিক্ষার প্রসার ঘটেছে সেটা সবাই আমরা এখন উপলব্ধি করতে পারি, প্রতি বছরের মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, জয়েন্ট এন্ট্রান্স, নিট, ডাব্লুবিসিএস এর রেজাল্ট প্রমাণ করে আল আমীন মিশন মুসলিম সমাজকে কতটা এগিয়ে নিয়ে এসেছি। আল আমীন না থাকলে হাজার হাজার ছেলে মেয়ের অস্তিত্ব থাকতো না, কিন্তু আল আমীন ছিল বলে তারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিষ্ঠিত প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছে। আল-আমীন মিশনের সাধারণ সম্পাদক নুরুল স্যারের কঠোর পরিশ্রম সফল হয়েছে ।বাংলার মুসলিম সমাজে শিক্ষার প্রতি আসক্তি তৈরি তিনি। অনেক সন্মান স্যারের মুকুটে,পেয়েছেন বঙ্গভুষণ, সুপার থার্টি আরও অনেক। আল আমীন মিশন টেলিগ্রাফ স্কুল অ্যাওয়ার্ড ফর এক্সিলেন্স পায় ২০০২ এবং ২০০৯সালে এবং বেগম রোকেয়া পুরস্কার পায় ২০১০সালে। স্যারের মতো আরও অনেক মানুষ দরকার সমাজে ।জাতি ও দেশ গঠনে দেশের মহান শিক্ষকদের অবদান সারা পৃথিবীর সামনে তুলে ধরতে ও আগামী প্রজন্মের শিক্ষকদের কাছে রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিতি তিনি। ২০২০সালে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক জয়েন এন্ট্রান্স, নিট পরীক্ষায় আল আমীন মিশনের নজরকাড়া সাফল্য । ২০০৭ সালে রাজ্যে প্রথম হয়ে রাজ্যের মেধা তালিকা স্পর্শ করেছিল আল আমীন মিশনের ছাত্র আরিফ সেখ । এরপর ২০১৬ সালে শাহরুক নওয়াজ এবং ২০১৭ সালে আবদুল মালেক খান রাজ্যস্তরে দশম স্থান পেয়েছিলেন মাধ্যমিকে ।আবার এবার মেধাতালিকায় সপ্তম ও অষ্টম স্থানে আল-আমীন মিশনের দুই ছাত্র ।রাজ্যস্তরে সপ্তম তথা আল আমীন মিশনের মধ্যে প্রথম হয়েছে মিশনের প্রধান শাখা হাওড়ার খলতপুরের ছাত্র সৈয়দ মহম্মদ তামিম। তার প্রাপ্ত নম্বর ৬৮৬ ( ৯৮ শতাংশ ) এবং ৯০ শতাংশের বেশি নাম্বার পেয়েছে ৪৮৫ জন। উচ্চ মাধ্যমিকে মেধাতালিকায় প্রথম দশে আল-আমীন মিশনের ৮জন। রাজ্যস্তরে মেধাতালিকা দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে আল আমীন মিলনের খলতপুর শাখার মুহাম্মদ তালহা, তার প্রাপ্ত নম্বর ৪৯৮।প্রতিবছর আল-আমীন মিশনের ছাত্রছাত্রীদের নিট পরীক্ষার রেজাল্ট সমস্ত মানুষের নজর কাড়ে, ২০২০ তে তার ব্যতিক্রম হয়নি।নিটে ৫৬৫ নম্বরের উপর পেয়েছে ৩২০ জন ছাত্রছাত্রী । আল – আমীন মিশন থেকে এ বছর সর্বভারতীয় স্তরে সর্বোচ্চ র‍্যাঙ্ক হয়েছে ৯১৬। গােটা ভারতে ১৫ লাখের বেশি ছাত্রী এ বছর নিট পরীক্ষা দিয়েছিল ,এর মধ্যে ৯১৬ র‍্যাঙ্ক করে আল – আমীন মিশনের মুখ উজ্জ্বল করেছে জিসান হোসেন।যেখানে সত্তরের দশকে মুসলিম সমাজের ছাত্ররা ডাক্তার তো দুরের কথা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়তে পারবে কিনা সন্দেহ ছিল সেখান এখন প্রতি বছর আল আমীন থেকে ৩০০-৪০০ জন ডাক্তার তৈরি হচ্ছে ।এর থেকে আনন্দে খবর আর কি হতে পারে ।বিগত ৩-৪ বছর থেকে ডাক্তারের মোট আসনের ১৫-২০ শতাংশ আল আমীন মিশনের ছেলে মেয়েরা।আপনি যদি এখন পশ্চিমবঙ্গের যেকোনো হসপিটালে যাবেন সেখানেই আল আমীন মিশনের ছাত্রছাত্রীদের পাবেন।আল আমীন যে মুসলিম সমাজ কে আলোর দিশা দেখিয়েছে সেটা আমরা সকলেই জানি। অন্ধকার থেকে আলোর দিশা দেখিয়েছে আল আমীন মিশন।এখন বাংলায় প্রতিটি মা-বাবা চাই যে তার সন্তান যেন আল আমীনে পড়তে পারে।এছাড়া ডব্লিউবিসিএস ,নার্সিং, হোমিওপ্যাথি,আয়ুরবেদ এবং ভেটেনারি তে আল-আমীন মিশনের সাফল্য অব্যাহত রয়েছে। নুরুল ইসলাম স্যার এখনো অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন যাতে পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত মুসলিম সমাজ শিক্ষিত হয়ে নিজের মেরুদন্ড শক্ত করতে পারে । সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন স্যার বলেছেন “সত্যিকারের শিক্ষক তাঁরাই, যাঁরা আমাদের ভাবতে সাহায্য করেন”।এই বানী আল আমীন মিশনের সম্পাদক নুরুল স্যারের ক্ষেত্রেও সমান ভাবে প্রযোজ্য কারন তিনি মিশনের ছাত্রদের ভাবতে শিখিয়েছেন,স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন।

যারা এই মিশনে থেকেই জীবনের সাফল্য পেয়েছে কিন্তু মিশন না থাকলে অনেকেই এই কঠোর প্রতিযোগিতায় হারিয়ে যেত পরিবেশের অভাবে তাদের কর্তব্য মিশনের পাশে দাঁড়ানো , স্যারের শিক্ষাবিপ্লবে অংশগ্রহণ করে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া কারন পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম সমাজে যে নবজাগরণ তৈরি হয়েছে তার পথ এখনও অনেক বাকি।একমাত্র শিক্ষাই পাড়ে মানুষকে আলোর দিশা দেখাতে।

Related Articles

Back to top button
error: