আজীবন সীমান্তের বেড়া মানেননি সীমান্ত গান্ধী আব্দুল গাফফার খান
মুহাম্মদ নূরুদ্দীন
সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকারের হাত থেকে ভারত স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৪৭ সালে। কিন্তু ব্রিটিশের ডিভাইড অ্যান্ড রুল ভারতকে তিনটি ভাগে ভাগ করে দিয়ে যায়। অখন্ড ভারত ভেঙে হয় পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান ও ভারত বর্ষ। এই দেশভাগে কার কি ভূমিকা ছিল তা নিয়ে বিতর্কের অন্ত নেই। প্রকৃত ইতিহাস যাই বলুক ভারত ভাগের দায় মুসলিমদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে তাদেরকে কোণঠাসা করার চেষ্টা স্বাধীন ভারতে অব্যাহত আছে। এ নিয়ে বারবার মুসলিম সমাজকে কটুক্তি শুনতে হয়। এই বিতর্কের মাঝে অটল পাহাড়ের মত দেশভাগের বিরোধিতা করে দাঁড়িয়েছিলেন যে ব্যক্তিটি তার নাম খান আব্দুল গাফফার খান। ইতিহাসে তিনি সীমান্ত গান্ধী নামে পরিচিত। খান আব্দুল গাফফার খান এর দেশ ভক্তি এবং জাতির প্রতি দায়বদ্ধতা তাকে ইতিহাসে অমর করে রেখেছে। সাম্প্রদায়িকতার রং অনেক তাবড় নেতার গায়ে ছিটানো সম্ভব হলেও খান আব্দুল গাফফার খানকে কখনো ধর্মীয় সংকীর্ণতা স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক, সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক এবং মানবিক ব্যক্তিত্ব।
১৮৯০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৮৮ সালের ২০ জানুয়ারি তিনি পরলোক গমন করেন। আফগানিস্তানের জালালাবাদে তাকে সমাধিস্থ করা হয়।
খান আব্দুল গাফ্ফার খানকে ইতিহাসে নানান বর্ণময় উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তাকে কখনো বলা হয়েছে ‘সীমান্ত গান্ধী’ কখনো বা ‘মুসলিম গান্ধী’ হিসেবে ডাকা হয়েছে। তিনি ছিলেন বাচ্চা খান বা বাদশা খান। তাকে ফখরে আফগান বা আফগানিস্তানের গর্ব বলে অনেকেই সম্বোধন করেছেন। সীমান্ত গান্ধী একজন নন ভারতীয় হিসাবে সর্বপ্রথম ভারতরত্নে ভূষিত হন। ১৯৮৭ সালে তাকে ভারত সরকার বা দেশের সর্বাধিক সম্মানজনক পুরস্কার ভারতরত্ন প্রদান করেন। ১৯৮৫ সালে খান আব্দুল গাফফার খান এর নাম প্রস্তাবিত হয় নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য। ১৯৬৭ সালে তাকে দেওয়া হয় জওহরলাল নেহেরু পুরস্কার।
খান আব্দুল গাফফার খান এর জীবন ছিল মানুষের জন্য নিবেদিত। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। বিদেশে চাকরি করতে যাওয়ার হাতছানি থাকা সত্ত্বেও তিনি সীমান্ত প্রদেশে গড়ে তোলেন মাদ্রাসা ও ধর্ম প্রতিষ্ঠান যার মধ্য দিয়ে তিনি ধর্মের প্রকৃত বাণী মানুষের মাঝে প্রচার করতে শুরু করেন। এক সময় তিনি দেওবন্দের সংস্পর্শে আসেন। স্বাধীনতা সংগ্রামী মাহমুদুল হাসানের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন।
১৯২০ সালে তিনি নাগপুরের কংগ্রেস অধিবেশনে যোগদান করেন। তিনি খেলাফত আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন এবং ১৯২১ সালে কারাবন্দী হন। তিন বছর সশ্রম কারাদণ্ডেদন্ডিত হন। এই সময় ক্ষুদ্র জেলে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করেন। শিকলে পা কেটে রক্ত ঝরতে থাকে তবু তিনি নীরবে তা সহ্য করেন।
তিনি ছিলেন প্রকৃত ধার্মিক এবং একান্ত শান্তি নিষ্ঠ্য মানুষ। তিনি শুধু ইসলাম ধর্ম নন বরং বেদ বাইবেল গীতা পাঠ করে ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ করার চেষ্টা করেন। তিনি গড়ে তোলেন খোদাই খিদমতগার বা আল্লাহর সেবক দল। এই দলের সদস্যদের লক্ষ্য ছিল মানব সেবা করা। প্রেম ও সাধুতার দ্বারা অন্যায়ের মোকাবেলা করা। কারো উপর হিংস্র আচরণ না করা। বিবাদ থেকে সর্বদা দূরে থাকা। সহজ সরল অনাড়ম্বর জীবনযাপন করা। দেশ ও জাতির জন্য জীবন উৎসর্গ করা। খেলাফত আন্দোলনে যোগ দেয়ার পর তিনি গান্ধীজীর অহিংসা ও অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে পরিচিত হন। তার আন্দোলনের পদ্ধতির সঙ্গে মিলে যায় গান্ধীজীর দর্শন। তাই তিনি একবার গান্ধীকে বলেছিলেন, “আমি আপনাকে এমন একটি অস্ত্র দিতে পারি যার বিরুদ্ধে পুলিশ ও সেনাবাহিনী দাঁড়াতে পারবে না। এটি রাসুলের অস্ত্র। সেটি হলো ধৈর্য ও ধার্মিকতা।”
খান আব্দুল গাফফার খান এর স্বপ্ন ছিল স্বাধীন অখন্ড ভারত এবং স্বাধীন পাখতুন প্রদেশ। এই লক্ষ্যে তিনি সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন। গান্ধীজী ও কংগ্রেসের প্রতি তার আস্থা ছিল অবিচল। তিনি ভেবেছিলেন ব্রিটিশরা যতই চক্রান্ত করুন না কেন গান্ধী বা কংগ্রেস কখনোই দেশভাগ মানবে না। কিন্তু দিন শেষে তিনি যখন দেখলেন দেশভাগের ব্যাপারে কংগ্রেসের এমনকি মহাত্মা গান্ধীর ও সমর্থন আছে তখন তিনি খুবই বিরক্ত হলেন । তিনি বললেন পাখতুন প্রদেশের স্বাধীনতার জন্য গান্ধীজী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এখন দেশ ভাগ মেনে নিয়ে গান্ধীজী তাকে নেকড়ের মুখের সামনে ফেলে দিলেন।
দেশের জন্য নিবেদিত প্রাণ এই অমর সংগ্রামী দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও দীর্ঘ বাইশ বছর কারাবন্দি ছিলেন। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তিনি দেশভাগকে স্বীকৃতি দেননি। ১৯৮৭ সাল যখন ভারত তাকে ভারতরত্ন পুরস্কারে ভূষিত করার জন্য ঘোষণা করেন তখন তিনি বিনা পাসপোর্টে বিনা ভিসায় ভারতে প্রবেশ করেন। পাসপোর্ট ভিসা দেখার সাহস বা সীমানার বন্ধনে আবদ্ধ করার সাহস কোন সরকার দেখাতে পারেনি।