মুহাম্মাদ নূরুদ্দীন
এবার হিউম্যান ইনডেক্সে ভারতের স্থান নেমে গেল ২৯ ধাপ। সম্প্রতি আমেরিকার কাটো ইনস্টিটিউট এবং কানাডার ফ্রেজার ইনস্টিটিউট যৌথ সমীক্ষা চালিয়ে হিউম্যান ইনডেক্স বা মানব স্বাধীনতার যে তালিকা তৈরি করেছে তাতে ভারতের স্থান হয়েছে ১১৯। আমাদের প্রতিবেশী দেশ শ্রীলংকা ভুটান ইত্যাদি দেশের থেকেও ভারত অনেক ধাপ পিছিয়ে গিয়েছে। এমনকি ভারত নিজের অবস্থান থেকে পিছিয়ে গিয়েছে ২৯ ধাপ। ২০১৪ সালে যখন নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় বসেন তার আগে ২০১৩ সালে ১৬৫ টি দেশের মধ্যে সমীক্ষা চালিয়ে যে রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছিল তাতে মানব স্বাধীনতায় ভারতের স্থান ছিল ৯০ তম। আর নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে আট বছর দেশ এমন বিকাশ ও অগ্রগতির দিকে এগিয়েছে যে আন্তর্জাতিক মানদন্ডে ভারতের স্থান ২৯ ধাপ পিছিয়ে হয়েছে ১১৯।
ইতিপূর্বে আন্তর্জাতিক ক্ষুধা সূচকে ভারতের অবনমন নিয়ে দেশজুড়ে চর্চা হয়েছিল। আইরিশ ভিত্তিক সংস্থা ‘কন্সার্ন ওয়ার্ল্ড ওয়াইড’ ও জার্মানির ‘ওয়েলথ হাঙ্গার হেলপ’ যৌথ উদ্যোগ চালিয়ে যে তালিকা তৈরি করেছিল তাতে ভারত ৯৪ তম স্থান থেকে নেমে ১০১ স্থানে পৌঁছে গিয়েছিল। এমনকি যে দেশ বিশ্বের সুপারপাওয়ার হওয়ার দাবি করে সেই দেশ আন্তর্জাতিক ক্ষুধা সূচকে প্রতিবেশী পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ইত্যাদি দেশের থেকেও পিছিয়ে গিয়েছে। অবশ্য আমাদের মহিলা ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রক ক্ষুধা সূচকের রিপোর্টকে মানতে চায়নি। তাদের বক্তব্য ছিল, এই “পদ্ধতিতে গুরুতর সমস্যা আছে” এমনকি ভারত সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল এই ধরনের রিপোর্ট “অবৈজ্ঞানিক”।
কিন্তু বালিতে মুখ লুকালে কি বালু ঝড় বন্ধ হয়ে যায়? আন্তর্জাতিক রিপোর্টকে অস্বীকার করে কি আমরা দেশের অবনমন ঠেকাতে পারব? তা সম্ভব নয়। এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে আমাদের দেশ সার্বিকভাবে দ্রুত পিছনের দিকে ফিরে যাচ্ছে। কী অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, কী রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, কী মানব স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সব দিক থেকে এইদেশ পশ্চাৎপদতার শিকার।
প্রশ্ন হল, কেন এই অবনমন? অনেকেই মনে করতে পারেন আসলে করোনাভাইরাসের আঘাত এবং লকডাউনের কারণে পিছিয়ে পড়ছে আমাদের দেশ। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য হলেও এই যুক্তি ধোপে টিকবে না। কেননা করোনাভাইরাসের থাবা শুধু ভারত নয় পৃথিবীর প্রতিটি দেশকে আক্রমণ করেছিল। এমনকি আমাদের দেশের থেকে অনেক বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে দেখা গিয়েছিল ইউরোপের দেশ গুলিতে। তাহলে করণা ভাইরাসের কারণে যে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি এই যুক্তি ধোপে টেকে না। প্রকৃতপক্ষে একটি দেশের উন্নয়ন অগ্রগতি নির্ভর করে সেই দেশের পরিচালক ও নাগরিক সমাজের সামগ্রিক সচেতনতা ও কর্মতৎপরতার উপর।
আমাদের দেশে রাজনৈতিক পালাবদলের পথ ধরে ক্ষমতায় এসেছে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টি। একটি কার্যকাল পাঁচ বছর অতিক্রান্ত করার পর তারা এখন আরও পাঁচ বছরের জন্য বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ভারতের আইনসভা দখল করেছে। নরেন্দ্র মোদী স্লোগান দিয়েছিলেন বিকাশের। অর্থাৎ তিনি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। কিন্তু তার নেতৃত্বে দেশ বিকাশ তো দূরের কথা দ্রুত বিনাশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তার সরকারের গৃহীত একের পর এক নীতি দেশের জন্য ক্ষতিকর প্রমানিত হওয়া সত্ত্বেও সরকার সে বিষয়ে কোন ধরনের আত্মসমালোচনা করার প্রয়োজন মনে করছে না। এখনো পর্যন্ত সরকারি নীতিতে তেমন কোন মৌলিক পরিবর্তন আসছে বলে মনে হয় না। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ হলেও এ দেশে যে সরকার ক্ষমতাসীন তারা মন মানসিকতার দিক থেকে স্বৈরাচারী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। তারা দেশে বিরোধী কণ্ঠস্বরকে সহ্য করতে রাজি নয়। তাদের আঘাত আসে লেখক-বুদ্ধিজীবী সাহিত্যিক সাংবাদিকদের উপর। কথায় কথায় গ্রেফতার করা হয়। তাদের হাতে অন্যায় ভাবে বন্দি হয় ভারাভারা রায়, সুধা ভরদ্বাজ, সিদ্দিক কাপ্পান, গৌতম নাখলার মত মানুষ। তারা বিরোধী কণ্ঠস্বর কে দমন করার জন্য কথায় কথায় লাগিয়ে থাকে সিবিআই, ইডি। রাজনৈতিক নেতা ও বুদ্ধিজীবীদের কণ্ঠরোধ করার জন্য তাদের বিরুদ্ধে লাগিয়ে রেখেছে পেগাসাস। এইভাবে গণতন্ত্রের কণ্ঠ রুদ্ধ করার জন্য যাবতীয় বন্দোবস্ত পাকা করা হয়েছে। তারা দেশকে সম্প্রীতির বন্ধনে বাঁধার পরিবর্তে বিভেদের ছুরি দিয়ে টুকরো টুকরো করতে চায়। মব লিঞ্চিং, আদিবাসীদের উপর অত্যাচার, মসজিদ গির্জা ইত্যাদি সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠানগুলির উপর হামলা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। এমনকি এদেশে প্রকাশ্যে নামাজ পড়ার উপরও বাধা আরোপ করা হচ্ছে। পুলিশের অনুমতি থাকা সত্ত্বেও হরিয়ানায় একদল উগ্রবাদী জুমার নামাজ আদায় করার ক্ষেত্রে বাধা প্রদান করছে। সরকার নির্বিকার। দেশজুড়ে জনবিরোধী আইন একের পর এক পাশ করা হচ্ছে। সম্প্রতি তিনটি কৃষি আইন নিয়ে তোলপাড় হয়ে গেল দেশ। এক বছর টানা আন্দোলনে বাধ্য হয়ে সরকার পিছু হটেছে কিন্তু সরকারের মানসিকতার কোন পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না। তারা চাপে পড়ে এনপি আর, এনআরসি ইত্যাদি কর্মসূচিকে রহিত করেছে কিন্তু বিভেদ ও দমনের এই রাস্তা থেকে সরকার বিরত হয়নি।
আসলে একটি দেশকে পিছিয়ে দেয়ার জন্য এই ধরনের ধ্বংসাত্মক বিভেদকামী মানসিকতাই যথেষ্ট। যে দেশের সরকার ও শাসক দল দেশকে ঐক্যের পথে নিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে বিভেদের দিকে নিয়ে যায়, সম্প্রীতির পরিবর্তে উগ্রতাকে প্রশ্রয় দেয়, বাকস্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, বিরোধী কণ্ঠস্বরকে শ্রদ্ধা প্রদান ইত্যাদি গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে উপেক্ষা করে যারা স্বেচ্ছাচারিতা ও স্বৈরতন্ত্রের পথে দেশকে নিয়ে যেতে চায় তারা কখনো অগ্রগতির পথে যাত্রা করতে পারে না। স্বাভাবিকভাবেই পিছিয়ে যাচ্ছে দেশ। অবনমন ঘটছে আন্তর্জাতিক মানদন্ডে দেশের অবস্থান। অবিলম্বে সরকার যদি নিজেদের নীতির পরিবর্তন না করে তাহলে এই অবনমন রোধ করা সম্ভব নয়। জনগনকেও বিষয়টা উপলব্ধি করতে হবে। প্রয়োজনে সরকারকে বিভেদ ও অগণতান্ত্রিক রাস্তা থেকে ফিরতে বাধ্য করার মত আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সম্প্রতি কৃষি আন্দোলন আমাদের সামনে যে দৃষ্টান্ত করে তুলেছে তাকে সামনে রেখে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে সকলকেই।