টিডিএন বাংলা ডেস্ক : চলতি বছরের জুলাই তাপমাত্রা রেকর্ডের ইতিহাসে সবচেয়ে উত্তপ্ত মাস ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় বৈজ্ঞানিক ও নীতিনির্ধারণী সংস্থা এক প্রতিবেদন বলছে, সমুদ্র ও ভূপৃষ্ঠ মিলিয়ে গত মাসের বৈশ্বিক তাপমাত্রা ছিল বিংশ শতাব্দীর গড় ১৫ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের (৬০ দশমিক ৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট) চেয়ে ০.৯৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। ১৪২ বছর আগে হিসাব রাখা শুরু হওয়ার পর থেকে এটিই মাসিক সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড। সম্প্রতি বিবিসির এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের জলবায়ু বিষয়ক সংস্থা ‘দ্য কোপার্নিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিস’ হিসাব করে দেখেছে এবারের জুলাই মাসের তাপমাত্র ১৯৮১ থেকে ২০১০ গড় তাপমাত্রা থেকে ১ দশমিক ০১ ডিগ্রি বেশি ছিল। ইন্টার গভর্নমেন্ট প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইসিসি) জানিয়েছে, এই তাপমাত্রা শিল্পায়নের আগের যুগের থেকে ১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। এর আগে ২০১৬ সালের জুলাই বিশ্বব্যাপী উষ্ণতম মাস ছিল। তবে ২০১৬ সালের জুলাই মাসের তুলনায় এবার তাপমাত্রা বেড়েছে ০ দশমিক ০৭ ডিগ্রি। পরে ২০১৯ ও ২০২০ সালেও একই তাপমাত্রা রেকর্ড হয়, তবে এ বছরের জুলাই সেটিকেও ছাড়িয়ে গেল। বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবের ফলে এমনটি হচ্ছে।
বিজ্ঞানীরা গবেষণায় দেখেছেন, পৃথিবী তার ইতিহাসের উষ্ণতম বছরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ওয়ার্ল্ড মেট্রোলজিক্যাল অর্গানাইজেশনের সেক্রেটারি জেনারেল পেততেরি তালাস বলেছেন, ‘জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাপমাত্রার ডজনখানেক রেকর্ডের কারণে এ বছরের জুলাই মাস জলবায়ুর ইতিহাস নতুন করে লিখেছে। এটা কোনো বিজ্ঞান বিষয়ক কল্পকাহিনী নয়। জলবায়ু পরিবর্তন এখন বাস্তবতা। জরুরি ব্যবস্থা না নিলে এটি ভবিষ্যতে আরও খারাপ হবে।’
এক বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় মহাসাগরীয় ও বায়ুমণ্ডলীয় প্রশাসন (এনওএএ) বলেছে, জুলাইয়ের ‘অনিবার্য পার্থক্য’ উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ন্যাশনাল সেন্টারস ফর ইনভায়রনমেন্টাল ইনফরমেশনের তথ্য উল্লেখ করে স্পিনরাড বলেন, বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন যে বিরক্তিকর এবং বিঘ্নিত পথ তৈরি করেছে তাতে নতুন সংযোজন এই রেকর্ড। আরো বলেন, বিশ্বজুড়ে জলবায়ু যেভাবে পরিবর্তন হচ্ছে তার সর্বাধুনিক বিশ্লেষণই দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলাফল লক্ষ্য করা যাচ্ছে বিশ্বজুড়ে। তাপদাহ, বন্যা, খরা ও দাবানলে নাকাল পৃথিবীর অনেক দেশ। কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না আলজেরিয়ার দাবানল। যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক, গ্রিসের দাবানলের ভয়াবহতা দেখেছে এই কিছুদিনে বিশ্ব। তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলে দাবানল পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও রেখে গেছে ধ্বংসের ছাপ। আগুনে পুড়ে গেছে দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় এভিয়া দ্বীপের ৫০ হাজার হেক্টরেরও বেশি বনভূমি।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার উত্তরাঞ্চলেও নতুন করে দাবানল ছড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে। ইতালি জুড়ে দেখা দিয়েছে তীব্র দাবদাহ। ইতালির সিসিলি দ্বীপের লুসিফায় কয়দিন আগে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি, যা সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপের মধ্যে সর্বোচ্চ। রাশিয়াতেও দাবানলে কারণে সাইবেরিয়ার এক হাজারের বেশি গ্রামে মারাত্মক বায়ু দূষণ দেখা দিয়েছে।
এ বিষয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ‘আমরা সব সময় উষ্ণ গ্রীষ্মের মধ্যে বসবাস করেছি। কিন্তু তরুণ বয়সের দেখা গ্রীষ্ম এটা নয়।’ এর আগে, চলতি সপ্তাহেই জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাব নিয়ে হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বিশ্ব উত্তপ্তকারী বিপজ্জনক গ্যাস নির্গমন অব্যাহত থাকলে চলতি শতাব্দীর শেষ দিকে সামুদ্রিক পানির উচ্চতা দুই মিটার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।
জাতিসংঘের মহাসচিব এটিকে ‘মানবতার জন্য লাল সংকেত’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, আমরা যদি এখনই সব শক্তি একত্রিত করি, তাহলে জলবায়ু বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব। প্রতিবেদন এটি পরিষ্কার করে দিয়েছে যে, দেরি করার মতো সময় নেই আর কোনো অজুহাতেরও জায়গা নেই।
তাপমাত্রার এই বৃদ্ধি এরই মধ্যে গ্রিনল্যান্ডে জমে থাকা বরফ গলানোয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। শুধু জুলাইয়ে গ্রিনল্যান্ডের বরফ গলে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে ১৯৭ বিলিয়ন টন পানি যুক্ত হয়েছে। এই পরিমাণ পানির কারণে সমুদ্রে পৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়েছে ০ দশমিক ৫ মিলিমিটার (০ দশমিক ০২ ইঞ্চি)।
জাতিসংঘের বিজ্ঞানীরা বলেছেন, আগে ১০০ বছরে জলবায়ুর যে পরিবর্তন হতো, ২০৫০ সালের মধ্যে প্রতি ছয় থেকে নয় বছরে তা ঘটবে। এই শতাব্দীজুড়ে উপকূলীয় এলাকাগুলোতে জলস্তর বাড়বে, ভাঙন দেখা দেবে, অনেক শহর পানিতে তলিয়ে যাবে।