HighlightNewsরাজ্য

জাতিভিত্তিক জনগণনা ও বহুজন কমিশন গঠনের দাবিতে মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি সমাজকর্মীদের

নিজস্ব সংবাদদাতা,টিডিএন বাংলাঃ আসন্ন সেন্সাসে জাতিভিত্তিক জনগণনা সুনিশ্চিত করা এবং পশ্চিমবঙ্গে একটি বহুজন কমিশন গঠন সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব বা দাবি জানিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে একটি খোলা চিঠি পাঠালো পশ্চিমবঙ্গের একদল সমাজকর্মী। এই চিঠিতে যে সমস্ত সমাজকর্মী স্বাক্ষর করেছেন তাঁরা হলেন – অভীক সাহা, আলি আনওয়ার, বাবলু বাউরী, জিনাত রেহেনা ইসলাম, জ্যোৎস্না সোরেন, কপিল কৃষ্ণ ঠাকুর, কুমার রাণা, মনজর জমিল, প্রসেনজিৎ বসু, রাম বচ্চন, সাবির আহমেদ, শরদিন্দু বিশ্বাস, সুধাকর সরদার, সুফিয়া খাতুন, সুখবিলাস বর্মা, সুপেন হেম্ব্রম। এই চিঠিতে বলা হয়, “আমরা নাগরিকত্ব সুরক্ষা আন্দোলনের সাথে যুক্ত নিম্নস্বাক্ষরিত সমাজকর্মীরা পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে আসন্ন আদমশুমারি বা সেন্সাসের সঙ্গে এনপিআর নবীকরণ করার বিরুদ্ধে এবং জাতিভিত্তিক জনগণনা চালু করার পক্ষে সুস্পষ্ট অবস্থান নেওয়ার আবেদন জানাচ্ছি। কেন্দ্রীয় সরকার গত বছরেই ২০২১ সেন্সাসের সঙ্গে এনপিআর প্রক্রিয়া, অর্থাৎ দেশজুড়ে এনআরসি চালু করার প্রথম ধাপ চালু করার উদ্যোগ নিয়েছিল। কোভিড-১৯ অতিমারির কারণে তা স্থগিত হয়ে যায়। দেশজুড়ে বিশেষত বাংলায় এনপিআর,এনআরসি, সিএএ ২০১৯ বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষিতে রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণই এনপিআর-এনআরসি চালু করার পক্ষপাতী নন। বিধানসভা নির্বাচনের রায়ে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। জনমতের বিরুদ্ধে গিয়ে এনপিআর নবীকরণ যাতে কিছুতেই চালু না হয় তা সুনিশ্চিত করতে আপনাকে আবেদন জানাচ্ছি। কেন্দ্রীয় সরকার তফসিলি জাতি ও জনজাতি ব্যতীত অন্য কোনো জাতির তথ্য জনগণনায় সংগ্রহ না করার সিদ্ধান্ত সংসদে জানিয়েছে। সেই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে সমগ্র জনসংখ্যারই জাতিভিত্তিক গণনা করা এবং এনপিআর প্রক্রিয়াকে জনগণনার থেকে বিযুক্ত করার আবেদন জানিয়ে আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে একটি চিঠি দিয়েছি। তার প্রতিলিপি এই চিঠির সঙ্গে সংযুক্ত করা রয়েছে। ১৯৯০ সালে কেন্দ্রীয় সরকার মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ গ্রহণ করে তফসিলি জাতি এবং জনজাতিদের পাশাপাশি অনগ্রসর শ্রেণির জন্যও সংরক্ষণ চালু করার পর থেকে দেশে সামাজিক ন্যায় নিয়ে বহু বাগ-বিতণ্ডা চলে আসছে। এই বিতর্কে অধিকাংশ মতামতই আসে নানাবিধ পক্ষপাতদুষ্ট পূর্বধারণা এবং জাতিগত বিদ্বেষের ভিত্তিতে। কিন্তু ১৯৩১ সালের জনগণনার পর দেশে আর কখনো পূর্ণাঙ্গ জাতিভিত্তিক জনগণনা না হওয়ায় তফসিলি জাতি ও জনজাতি ব্যতীত অন্যান্য জাতিগুলির জনসংখ্যা এবং আর্থসামাজিক পরিস্থিতির প্রকৃত তথ্য উপলব্ধ নয়। ২০১১-এর সেন্সাসে জাতিভিত্তিক জনগণনা হওয়া সত্ত্বেও সেই তথ্য কেন্দ্রীয় সরকার আজ অবধি প্রকাশ করেনি। এটা মানবোন্নয়ন এবং সামাজিক ন্যায় সুনিশ্চিত করার পথে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এই জাতিভিত্তিক জনগণনা বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ। রাজ্যে সরকারি চাকরিতে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তফসিলি জাতির (SC) জন্য ২২% আসন সংরক্ষিত, আদিবাসীদের (ST) জন্য ৬%। মণ্ডল কমিশনের সুপারিশের পর পশ্চিমবঙ্গে প্রথমে সরকারি নিয়োগে অনগ্রসর শ্রেণির (OBC) জন্য ৭% আসন সংরক্ষিত করা হয়। পরবর্তী সময়ে অনগ্রসর শ্রেণির সংরক্ষণ আরও ১০% বাড়ানো হয়। ২০১২ সালে রাজ্য বিধানসভায় আইন পাশ করে সরকারি নিয়োগে অতি অনগ্রসর (More Backward Classes) এবং অনগ্রসরদের (Backward Classes) জন্য যথাক্রমে ১০% এবং ৭%, অর্থাৎ মোট ১৭% আসন সংরক্ষণ করা হয়।
The West Bengal Backward Classes (other than SC & ST) (Reservation of vacancies in Services and Posts) Act, 2012 আইনে ১৪৩ জাতিকে অনগ্রসর চিহ্নিত করা হয়েছিল। বর্তমানে এই অনগ্রসর জাতির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭৮, যার মধ্যে ১১৭ জাতি মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত। এখানে উল্লেখযোগ্য যে পশ্চিমবঙ্গে অনগ্রসর শ্রেণির সংরক্ষণের কোটা বৃদ্ধি বা অনগ্রসর শ্রেণির সূচীতে নতুন জাতির অন্তর্ভুক্তি, কোনোটাই কিন্তু জনগণনার ভিত্তিতে করা হয় নি। এর ফলে কিছু বিভ্রান্তিও ছড়িয়েছে। যেই জাতিগুলির নাম অনগ্রসর শ্রেণির সূচিতে স্থান পাচ্ছে, সরকারি নিয়োগে আসলে তাদের প্রতিনিধিত্ব কতটা বাড়ছে তাই নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, কিন্তু সরকারি নিয়োগের তথ্যে স্বচ্ছতার অভাবে প্রশ্নের সদুত্তর মিলছে না। অন্যান্য বেশ কয়েকটি জাতির পক্ষ থেকে অনগ্রসর শ্রেণির সূচিতে অন্তর্ভুক্তির দাবি উঠেছে, কিছু জাতিকে অন্তর্ভুক্ত করার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছে। আমাদের মতে অনগ্রসর শ্রেণির সূচীতে বিভিন্ন জাতির অন্তর্ভুক্তি জাতিভিত্তিক জনগণনার মাধ্যমেই হওয়া উচিৎ। বিগত কয়েক বছরে রাজ্য সরকার বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর নামে একের পর এক উন্নয়ন অথবা কল্যাণ পর্ষদ তৈরি করে চলেছে। মতুয়া, নমঃশূদ্র, রাজবংশী, নস্য শেখ, লেপচা, ভুটিয়া, তামাঙ্গ, মঙ্গর, শেরপা ইত্যাদি জাতি বা জনজাতির নামে পর্ষদ গড়ে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। কিন্তু এর ফলে সেই জাতি গোষ্ঠীর কীভাবে উন্নয়ন হচ্ছে, সেটা বোঝার উপায়টাই বা কী, এই নিয়ে সরকারি নীতিতে কোনোরকম স্বচ্ছতা নেই। মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ গ্রহণ করার পর তিন দশক পেরিয়েছে। সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির উপর তৈরি সাচার কমিটি রিপোর্ট জমা হওয়ার পরেও ১৫ বছর পেরিয়েছে। আপনার নেতৃত্বে রাজ্য সরকার চলেছে বিগত এক দশক ধরে। এই দীর্ঘ সময়ে রাজ্য সরকার তফসিলি জাতি, জনজাতি, অনগ্রসর এবং সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছে। এখন সময়ে এসেছে এই সমস্ত জনগোষ্ঠীর – বিশেষত নারীদের – শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, কৃষি-ব্যবসা-বাণিজ্য-ঋণ ইত্যাদি পরিস্থিতির বিস্তারিত সমীক্ষা চালিয়ে যথার্থ আর্থ-সামাজিক বিশ্লেষণ এবং মূল্যায়নের। এক্ষেত্রে জাতিভিত্তিক জনগণনার গুরুত্ব অপরিসীম। আমরা মনে করি যে বিভিন্ন দলিত, আদিবাসী, অনগ্রসর অথবা সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে সামগ্রিকভাবে সামাজিক বঞ্চনার শিকার ‘বহুজন’ হিসেবে দেখা উচিৎ। বাংলার রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক পরিসরে বর্ণ হিন্দুদের আধিপত্য এবং বহুজনদের ক্রমহ্রাসমান প্রতিনিধিত্ব একটি রূঢ় বাস্তব, যার পরিবর্তন ব্যতীত সামাজিক ন্যায় সুনিশ্চিত করা অসম্ভব। সামগ্রিকভাবে বহুজনদের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির বিশ্লেষণ এবং মূল্যায়নের ভিত্তিতে বহুমুখী উন্নয়ন এবং ক্ষমতায়নের কর্মসূচি নেওয়া আশু প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি। এই লক্ষ্যে অনতিবিলম্বে একটি বহুজন কমিশন গঠন করার প্রস্তাব আমরা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সামনে রাখছি। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের লিখিতভাবে জাতিভিত্তিক জনগণনার দাবিও জানানো উচিৎ। এই বিষয়ে আপনার সদর্থক পদক্ষেপের প্রত্যাশা রাখি।”

Related Articles

Back to top button
error: