Highlightরাজ্য

বিড়ি শ্রমিক ও নেশাগ্রস্থ পরিবারের স্কুলছুট পড়ুয়াদের জীবন নাটকীয় ভাবে পাল্টে দিয়েছে মাদ্রাসা

রেবাউল মন্ডল, টিডিএন বাংলা, ফরাক্কা: কখনো স্কুলছুট ছাত্র-ছাত্রীদের বাড়িবাড়ি গিয়ে মাদ্রাসার আঙিনায় আনা, তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা, কখনো অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানো, কখনো সামাজিক সচেতনতা তৈরি করা, কখনো বা রাজনৈতিক হিংসা বন্ধে এগিয়ে আসা প্রভৃতি নানান কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলার অন্যান্য শিক্ষকদের মধ্যে নজর কেড়েছেন মুর্শিদাবাদ জেলার ফরাক্কার নুর জাহানারা স্মৃতি হাই মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক জানে আলম।

ফরাক্কার প্রত্যন্ত গঙ্গা ভাঙন প্রবণ এলাকা মহেশপুরের বেশিরভাগ পরিবারই বিড়ি শ্রমিক, শিশু শ্রম, হকারীর সাথে যুক্ত। কেউ বা প্রাথমিকের গন্ডি কাটিয়ে সোজা পাড়ি দেয় ভিন রাজ্যে। মাঝপথে স্কুলছুট পড়ুয়া ছাড়াও মদ, জুয়া, লটারী ও অন্যান্য নেশাগ্রস্থ পরিবারের সন্তানদের জীবনকে নাটকীয় ভাবে পাল্টে দিয়েছে মাদ্রাসা।

মীনা মঞ্চ গড়ে ডেঙ্গু প্রতিরোধ সচেতন, বাল্যবিবাহ রোধ বৃক্ষ রোপন ইত্যাদিতেও মাদ্রাসার ভূমিকায় পঞ্চমুখ স্থানীয়রা। ফরাক্কার পদ্মা ভাঙ্গন কবলিত মুসলিম সংখ্যালঘু অধ্যুষিত প্রত্যন্ত মহেশপুরের বটতলায় শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে ইতিমধ্যেই রাজ্যে নজির সৃষ্টি করেছেন নুর জাহানারা স্মৃতি হাই মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক জানে আলম।

পেশায় শিক্ষকতা করলেও নানান সামাজিক কাজে তিনি জড়িত। মাদ্রাসার উন্নয়ন তিনি কীভাবে করবেন তা নিয়ে দিনরাত তার চিন্তার শেষ নেই। আর সেই চিন্তা থেকেই একাধিক মাদ্রাসা উন্নয়ন কর্মসূচি নিয়েছেন তিনি। ইতিমধ্যেই রাজ্যের বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন ও প্রশাসনের নজরে এসেছে শিক্ষক জানে আলম। মাদ্রাসার বিভিন্ন কর্মসূচি প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে। মাদ্রাসা শিক্ষা পর্ষদ থেকে তিনি প্রশংসিতও হয়েছেন। এলাকায় তার সুনাম সর্বজনবিদিত।

এখন তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য খেলার মাঠ ও একটি গার্লস হোস্টেলের নির্মাণে তিন বিঘা জমি ক্রয়ের উদ্যোগ নিয়েছেন। জানে আলম জানান, দীর্ঘদিন থেকে এলাকার মানুষ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত ছিল। কিন্তু এখানে খেলার মাঠ নেই ছাত্রীদের থাকার জন্য হোস্টেল নেই। মাদ্রাসায় প্রবেশের জন্য নিজস্ব জন্য রাস্তাও নেই। তাই আমরা বিদ্যালয় পরিচালন কমিটি অভিভাবক ও শুভানুধ্যায়ীদের কাছে সাহায্যের হাত বাড়ানোর জন্য আহ্বান জানিয়েছি। ইতিমধ্যে বিভিন্ন জন ডাকে সাড়া দিয়ে তহবিলে দানও করেছেন।

তিনি আরো জানান, যদি মাঠ হয় তাহলে খেলার পরিবেশ তৈরি হবে। তৈরি হবে মাদ্রাসার নিজস্ব রাস্তাও। ছেলেমেয়েরা রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে খেলার সুযোগ পাবে। ছাত্রীদের জন্য একটা হোস্টেল দরকার। এখানে মেয়েদের যদি আলাদাভাবে মিশনের মত রেখে পড়াশোনা করানো যায় তাহলে তারাও ফুল হয়ে ফুটবে।

তিনি আরো জানান, মাদ্রাসার উন্নয়নের জন্য সরকার ও প্রশাসন সহযোগিতা করছেন। স্থানীয় মানুষরাও সহযোগিতা করছেন। একটা সময় এখানে এসে চাকরি করতে ভয় লাগতো অনেকের মধ্যে অসচেতনতাও ছিল। ধীরে ধীরে মহেশতলার মানুষ শিক্ষার দিকে এগিয়ে আসছে। ছেলে মেয়েরা পড়াশোনা করছে এবং নূর জাহানারা স্মৃতি হাই মাদ্রাসা গোটা পশ্চিমবাংলায় একটা নজির সৃষ্টি করেছে।

জঙ্গিপুরের সাংসদ খলিলুর রহমান বলেন, ‘জানে আলম কেবল প্রধান শিক্ষকই নন, সমাজ সংস্কারে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। স্কুলের ছোট ঘর থেকে বৃহত্তর সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তিনি এখন মহিলা শিক্ষা উন্নয়ন এবং শিশুদের স্বাস্থ্যের জন্য জমি কেনার উদ্যোগ নিয়েছেন। জনস্বার্থে তাঁর উদ্যোগকে ফলপ্রসূ করতে আমি নূর পরিবারের ব্যক্তিগত সম্পত্তি থেকে দশ লক্ষ টাকা অনুদান দিয়েছি। ভবিষ্যতে আরও কিছু করতে চাই। খেলার মাঠ এবং ছাত্রীহোস্টেল নির্মাণ নিঃসন্দেহে পরবর্তী প্রজন্মকে আরও বেশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সংস্কৃতি বিকাশে সহায়তা করবে।’

মাদ্রাসার ছাত্রী মাহেনুর বেগম বলছে, ‘আমি এই মাদ্রাসায় পঞ্চম শ্রেণী থেকে পড়াশোনা করছি। এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবো। এই মাদ্রাসা থেকে বিজ্ঞানমেলা, বিভিন্ন সাংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিযোগিতা ও শিক্ষা মূলক ভ্রমণনে আমরা বহু বার বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থানে গেছি। এছাড়া মিনা মঞ্চে কাজ করতে গিয়ে হেড স্যারকে খুব কাছ থেকে দেখে মনে হয়েছে উনি আমাদের পরিবারেরই একজন। আমরা অত্যন্ত গর্বিত যে এই পিছিয়ে পড়া গ্রামে স্যার আমাদের সার্বিক উন্নতির জন্য খেলার মাঠ এবং ছাত্রীবাস তৈরি করছে।’

এই জমিতেই হবে খেলার মাঠ ও ছাত্রীনিবাস

পড়ুয়ারা বলছে, খুব সহজেই তাদের সঙ্গে মিশে যান সরল মনা হেড স্যার। তখন মনেই হয় না যে তিনি একজন প্রধান শিক্ষক। কখনও কখনও মনে হয় তিনি একজন বন্ধু। কখনও কখনও মনে হয় তিনি একজন বাবা। আবার কখনো মনে হয় তিনি একজন দক্ষ গাইড। এমন স্যারের সঙ্গে মন খুলে কথা বলতে পেরে খুশি বলে জানাচ্ছে মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীরা।

অভিভাবক তথা বিশিষ্ট সমাজসেবী সীতারাম সরকার বলছেন, ‘আমাদের গ্রাম পিছিয়ে ছিল। এখানকার শিশু-যুবকরা কার্ড, জুয়া খেলত, লটারি, অ্যালকোহল, গাঁজা এমনকি বোমা ফেলায় আসক্তিও ছিল। কোন স্কুল ছিল না, পড়াশোনার চর্চাও ছিল না। এখন মাদ্রাসা হয়েছে। আমাদের সৌভাগ্য মাদ্রাসায় জানে আলমের মত একজন সৎ ও দক্ষ প্রধান শিক্ষক পেয়েছি। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় হাল ফিরছে মহেশপুরের। আমার তাঁকে সর্বতোভাবে সহযোগিতার চেষ্টা করছি।’

জমি কিনতে ১০লক্ষ টাকার চেক প্রধান শিক্ষক কে তুলে দিচ্ছেন সাংসদ খলিলুর রহমান

অভিভাবক আব্দুল হক (আলহাজ্ব) বলেন, জানে আলম সহ মাদ্রাসার কোন শিক্ষকই কখনো অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করেন না। অভিভাবক ও গ্রামবাসীদের নিয়ে মিটিং রেজুলেশন করেই জমি কিনতে সাহায্য নিয়ে সকলের এগিয়ে আসার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এখন কিছু কুচক্রী ওই জমিটি নিজেদের কুক্ষিগত করে অধিক মুনাফা লুটতে চাইছিল। আর সেটা পারছেনা বলেই প্রধান শিক্ষকের নামে অপবাদ ছড়াতে চাইছে। কিন্তু এলাকার উন্নয়নের স্বার্থে আমরা শিক্ষানুরাগীরা তা হতে দেব না।

জমি কিনতে শিক্ষক অভিভাবক ও কমিটির মিটিং

মহেশপুরের পঞ্চায়েত প্রধান রফিকুল শেখ বলছেন, এই মাদ্রাসার সার্বিক উন্নয়ন দেখে আমরা প্রধান শিক্ষকে সংবর্ধিত করেছি।
প্রধান শিক্ষকের জমি উন্নয়ন কমিটির সদস্য হতে পেরে আমি ধন্য। পঞ্চায়েতের তরফ থেকে আমরা মাদ্রাসার সার্বিক উন্নয়ন কামনা করছি। এই মাদ্রাসা আমাদের গর্ব।

Related Articles

Back to top button
error: