গাজায় হাসপাতালে ইসরাইলি বোমা হামলায় ৫০০ অধিক নিহত, মানব ইতিহাসের বর্বরতম আক্রমণে প্রতিবাদ সারা বিশ্বে
টিডিএন বাংলা ডেস্ক: ফিলিস্তিনের গাজায় একটি হাসপাতালে ইসরায়েলের বোমা হামলায় নিহত ব্যক্তির সংখ্যা বেড়ে ৫০০ হয়েছে। মঙ্গলবার রাতে মধ্য গাজার আল–আহলি আরব নামের হাসপাতালে এই হামলা চালানো হয়। এর আগে ইসরায়েলি হামলায় আহত শত শত রোগী ও গৃহহীন অসংখ্য বাসিন্দা ‘নিরাপদ’ ভেবে ওই হাসপাতালে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
গতকাল (মঙ্গলবার) স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরাইলি বিমান থেকে গাজার সেন্ট্রাল হাসপাতাল কম্পাউন্ডে বোমাবর্ষণের ফলে যেসব মানুষ শহীদ হয়েছেন তার বেশিরভাগই নারী ও শিশু। মন্ত্রণালয় জানায়, হাসপাতালের ধ্বংস্তুপের নিচে আরো শত শত হতাহত লোকজন পড়ে রয়েছেন। ইহুদিবাদী ইসরাইল গত ৭ অক্টোবর থেকে গাজা উপত্যকায় যে লাগাতার বিমান হামলা চালিয়ে আসছে তাতে হাজার হাজার আহত ও অসুস্থ ব্যক্তি এই হাসাপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন।
২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ইসরাইল গাজার প্রতিরোধকামী সংগঠন হামাস ও ইসলামি জিহাদ আন্দোলনের বিরুদ্ধে পাঁচটি যুদ্ধ করেছে কিন্তু এর আগে একটি হামলায় একসাথে এত বেশি মানুষ মারা যায়নি। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, বিস্ফোরণের পর হাসপাতালের বহুতল ভবনটি জ্বলছে। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মরদেহ। ধ্বংসস্তূপ থেকে ভেসে আসছে আহত ব্যক্তিদের আর্তচিৎকার।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল বলেন, “আমরা এর আগে অনেক যুদ্ধ দেখেছি কিন্তু কোনদিন এমন হামলা হয়নি। এবার ইসরাইল যে হামলা চালালো তা নজিরবিহীন। এটি নিতান্তই গণহত্যা।” স্থানীয় সময় মঙ্গলবার রাত আনুমানিক সাড়ে আটটার দিকে হাসপাতালে একাধিক বিস্ফোরণ হয়। জাতিসংঘসহ মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থাগুলো হাসপাতালে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। গাজার হাসপাতালের হামলার নিন্দা জানিয়েছে আরব লীগও। সংস্থাটির প্রধান আহমেদ ঘেতি বলেছেন, বিশ্ব নেতাদের অবিলম্বে এই ‘ট্রাজেডি’ বন্ধ করতে হবে। গাজার হাসপাতালে হামলার নিন্দা জানিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মহাপরিচালক তেদরোস আধানম গেব্রেয়াসুস। অবিলম্বে বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানও এই হামলার নিন্দা জানাচ্ছেন।
হামাসের গণমাধ্যম কার্যালয় এই হামলাকে যুদ্ধাপরাধ বলে অভিহিত করেছে। গাজার রেডক্রিসেন্ট সোসাইটিও এই হামলাকে যুদ্ধাপরাধ বলে উল্লেখ করেছে। ইসরাইলের বিমান হামলার পর ফিলিস্তিনি স্বশাসন কর্তৃপক্ষের প্রধান মাহমুদ আব্বাস তিনদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছেন।
এই আক্রমণে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। গাজায় হাসপাতালে হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ। একে ‘গণহত্যা’ অভিহিত করে তিনি বলেন, এই পরিস্থিতিতে কেউ চুপ থাকতে পারে না। এভাবে সাধারণ মানুষকে হত্যা ‘মানবতার জন্য লজ্জাজনক’। হাসপাতালে ইসরায়েলি বাহিনীর বোমা হামলায় শত শত মানুষের মৃত্যুকে ‘জঘন্য অপরাধ’ অভিহিত করে তীব্র নিন্দা জানিয়েছে সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
ইসরায়েলি বাহিনীর হাসপাতালে বোমা হামলার ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে কাতার। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রলায় বলেছে, ইসরায়েল যেভাবে গাজার হাসপাতাল, স্কুল ও জনবহুল এলাকায় হামলা করছে এতে সংঘাত ভয়ংকর ভাবে বিস্তৃত হচ্ছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়ের এরদোয়ান বলেছেন, ইসরায়েল যে ন্যুনতম মানবিক মূল্যবোধেরও তোয়াক্কা করছে না গাজায় হাসপাতালে হামলা তার সর্বশেষ উদাহরণ। গাজায় ‘নজিরবিহীন নৃশংসতা’ বন্ধে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘ইসরায়েলি বাহিনী নির্বিচার বিমান হামলা চালিয়ে গাজার নিরস্ত্র ও অসহায় মানুষদের হত্যা করছে। জঘন্য এই অপরাধের মাধ্যমে ইহুদী এই রাষ্ট্রটি আরও একবার বিশ্বের সামনে তাদের অমানবিক ও পাশবিকাতেই তুলে ধরেছে।’
ইসরায়েলি হামলার নিন্দা জানিয়েছে বর্তমানে মুসলিম বিশ্বের মধ্যে ইসরাইলের সবচেয়ে বন্ধুভাবাপন্ন দেশ মিসরও। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, গাজার বেসামরিক নাগরিকদের ওপর এভাবে নির্বিচার হামলা ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের চরম লঙ্ঘন’। মিসরের প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ আল–সিসি বিবৃতি দিয়ে হাসপাতালে হামলার নিন্দা জানিয়েছেন। বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, ‘ইসরায়েলের এই হামলার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।’ সিরিয়ার প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ও এই হামলাকে ‘মানবতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে নৃশংস, জঘন্য, রক্তক্ষয়ী গণহত্যাগুলোর একটি’ অভিহিত করে এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছে।
গাজায় হাসপাতালে হামলার ঘটনাকে ‘ভয়ংকর’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। তিনি বলেন, এটা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। এসব ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি সম্মান জানানো উচিত। যুদ্ধের কিছু নিয়মনীতি আছে। কোনো হাসপাতালে এভাবে হামলা করার ঘটনা কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। রাশিয়া অবিলম্বে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকার আহ্বান জানিয়েছে। গাজার হাসপাতালে প্রাণঘাতী হামলার ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে ফ্রান্সও। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, মানবাধিক বিষয়ক আন্তর্জাতিক আইন সবার জন্য প্রযোজ্য। বেসামরিক মানুষের নিরাপত্তা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।
এদিকে ইসরায়েলের উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। মিত্র ইসরায়েলের প্রতি সমর্থনের অংশ হিসেবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও শীর্ষ প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের পর এবার তেল আবিব সফরে আসছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ইসরায়েল সফর শেষ করে জর্ডানের রাজধানী আম্মানে যাওয়ার কথা ছিল বাইডেনের। সেখানে জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ, মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি ও ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে বৈঠকের কথা ছিল তাঁর। কিন্তু ইসরাইলের এই বর্বরোচিত হামলার প্রতিবাদে বাইডেনের সঙ্গে নির্ধারিত এ সম্মেলন বাতিল ঘোষণা করেছে দেশগুলো। বাইডেনের সঙ্গে সম্মেলন বাতিলের ঘোষণায় জর্ডানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আয়মান সাফাদি বলেন, ‘যুদ্ধ বন্ধ করা ছাড়া এখন আর আলোচনা করে কোনো লাভ নেই।’
এই হামলা প্রসঙ্গে হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া বলেছেন, ‘শত্রুরা (ইসরায়েল ও দেশটির মিত্ররা) যে কতটা পাশবিক হাসপাতালে চালানো এই গণহত্যা তারই প্রমাণ।’ ইসরায়েলের দখলদারদের বিরুদ্ধে লড়তে সব ফিলিস্তিনিকে রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানিয়েছেন হামাস প্রধান। এদিকে হামাসের মুখপাত্র ওসামা হামদান বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ‘সবুজ সংকেত’ পাওয়া ছাড়া ইসরায়েলের পক্ষে এই হামলা চালানো সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ‘সবারই বোঝার কথা মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেন গতকাল ইসরায়েলের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার সঙ্গে পাঁচ ঘণ্টার বেশি বৈঠক করেন। এদিকে জো বাইডেনও আজ ইসরায়েল সফরে আসছেন।’ সূত্র – প্রথম আলো, পার্সটুডে, আল জাজিরা, বিবিসি ও রয়টার্স