সাহিত্য ও সংস্কৃতি

গল্পের নাম:- “রিজু বাঁচতে চেয়েছিলো” গল্পকার:-মোস্তফা কামাল (পর্ব-১৬)

(পর্ব-১৬)

আবিরের জন্য মিজানুর সাহেব খুব চিন্তা করেন। রিজুরও চিন্তা হয়। রিজুর পরামর্শে আবির কৃষ্ণনগরে একটা মোবাইল রিপেয়ারিং সেন্টারে ভর্তি হয়। রিজুর বাবা তার জন্য ডোমকল বাজারে একটা দোকানের ব্যবস্থা করে দেন । তবুও আবিরের ভবিষ্যত নিয়ে রিজুর চিন্তা হয়। প্রতিযোগিতার বাজারে তার ছোট ভাই আবির টিকে থাকতে পারবে তো!

খুব অল্প সময়ে আবির সকলের মন জয় করে। ওর হাতের কাজে গ্রাহকরা খুশি। মিজানুর সাহেব স্বস্তি পান। এভাবে চললে ছেলের ভাত কাপড়ের অভাব হবে না।

আজ খুব সকালেই রিজুর মোবাইল ফোনটা বেজে উঠে। রিজু কানে ধরতেই ওপার থেকে কান্না জড়ানো গলায় রিজুর বাবার আওয়াজ। রিজু ভালো আছো?

———- হ্যাঁ আব্বা ভালো আছি।

———– আপনি কেমন আছেন? মা কেমন আছে? বাড়ির সবাই ভালো তো? এক সঙ্গে কথাগুলো বলে রিজু।

—————আমরা ভালো নেই রিজু!

————– কেন,কী হয়েছে? রিজুর বুকটা ধড়াস করে ওঠে।

আবি—-র———! আবির খুব খারাপ পথে চলে গেছে রিজু!
মাঝপাড়ার একটা মেয়েকে নাকি ও বিয়ে করেছে! আমাদের না জানিয়ে ও এই কাজ করতে পারলো! আমি চারদিকে অন্ধকার দেখছি রিজু! আমাকে লোকে কী বলবে গো! আমি মুখ দেখাবো কি করে বলো!!

রিজুর বুকটা কেঁপে উঠে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, আপনি শান্ত হোন। কাঁদবেন না।

———— আমি ঐ মেয়ে কিছুতেই মেনে নিতে পারবোনা রিজু! ছেলে আমার মান সম্মান সব ধূলোয় মিশিয়ে দিল গো। ………..ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদেন তিনি। সন্তানের থেকে কত বড়ো আঘাত পেলে বাবারা কাঁদেন তা ভুক্ত ভোগী বাবারাই জানেন।

রিজু কী করবে, কীইবা বলবে তার বাবাকে ঠিক করতে পারে না। মাসুমের সময় কিছু পারিবারিক সমস্যা হয়েছিল। বাড়ির বড়ো ছেলে হিসেবে রিজু তার বাবা মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছিল! উল্টে মাসুমের কাছে রিজু খারাপ হয়েছিল। এখন আবার যদি আবিরের এই আচরণের জন্য বাবা মায়ের পাশে রিজু দাঁড়াতে যায় তাহলে হয়তো আবিরের কাছে সে-ই খারাপ হবে। আসলে রিজু বুঝতে পারে, তাকে দোষারোপ করেই ওরা ভালো থাকে। এই বিষয়ে বারবার রিজু ওর বাবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বাবার স্মিত হাস্যে জবাব, তুমি ওদের বড়ো ভাই। তোমাকে দোষারোপ করে যদি সমস্যার সমাধান হয়,সবাই যদি ভালো থাকে তাহলে থাক না। ঘাড়ে একটু দোষ নাওনা! বাবার এই ধরনের আলগা মন্তব্য শুনে রিজু অবাক হয়। মুখ ফুটে বাবাকে কিছু বলতে পারে না। বললে হয়তো তিনি কষ্ট পাবেন। রিজু জানে, আবিরের বিরুদ্ধে কিছু বললে এক সময় তার বাবা-ই রিজুর ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে আবিরকে বলবেন, “আমার তো মেনে নিতে অসুবিধা নেই। কিন্তু তোমার ভাই মানতে বারণ করছে তাই তোমাকে বলছি.! তুমি আগে তোমার বড়ো ভাই রিজুকে রাজি করাও।”

মনে মনে রিজু বলে, আবিরকে আব্বা যা বলবেন বলুন। তিনি এখন কষ্ট পাচ্ছেন। বাড়ির বড়ো ছেলে হিসেবে তার পাশে দাঁড়ানো দরকার। তাছাড়া আবির তো ওরই ভাই। ও যা মনে করে করুক, ভাইয়ের মঙ্গলের জন্য ভাই হিসেবে শাসন করার পূর্ণ অধিকার রয়েছে তার।

হ্যালো। আব্বা! আপনি শান্ত হোন। সব ঠিক হয়ে যাবে।

———– কিচ্ছু ঠিক হবে না রিজু! কী করে সব ঠিক হবে! আবিরকে বারবার সাবধান করে দিয়েছিলাম ঐ মেয়েকে বিয়ে করলে আমার বাড়ির দরজা তোমার জন্য বন্ধ হয়ে যাবে! আমি বৌ ঘরে তুলবো না! তবুও ও শুনলো না!

——- আপনি ঠিক শুনেছেন তো? এটা মিথ্যাও হতে পারে।

———— না না, ঠিকই শুনেছি। এইমাত্র আবিরের বন্ধু বলে গেল। ও ক’দিন আগেই ডোমকল ম্যারেজ রেজিস্ট্রার অফিসে রেজেস্ট্রি বিয়ে করেছে।

———– আপনি মেয়েটির পরিবার, মেয়েটির চরিত্র সব খোঁজ নিয়ে দেখুন। যদি মেনে নেওয়ার মতো হয় তাহলে মেনে নিন। এখন বৃথা কান্না করে কোনো লাভ নেই। আগেই সাবধান হওয়া উচিত ছিল।

——— আমি কি জানতাম ও এমনটি করবে? আমার অবাধ্য হবে!

————আপনার সব ছেলে তো রিজুর মতো নয় আব্বা। তাদেরকে অতিরিক্ত আদর সোহাগ দিয়ে স্পর্ধা বাড়িয়ে দিয়েছেন। আপনাকে আমি একাধিকবার সতর্ক করেছি, আপনি উল্টে আমার উপর রাগ দেখিয়েছেন । তখন শোনেন নি, এখন কেঁদে লাভ নেই আব্বা।

——— ওসব কথা ছাড়ো। এখন কী করণীয় তাই বলো?

———– মা কী বলছেন?

———–তোমার মা বলছেন দ্বিতীয় বিয়ে করা মেয়েকে ঘরে তুলবে না।

———— সে কি? মেয়ের কি আগে কোথাও বিয়ে হয়েছিল?

——— শুনেছি তাই। তুমি আবিরের সাথে একবার কথা বলো।

————ঠিক আছে। আমি দেখছি।

আবিরকে ফোনে ধরে রিজু। ওপার থেকে আবির বলে, বলেন ভাই?

———-তুই নাকি বিয়ে করেছিস? ঘটনাটি কি সত্যি?

———– সত্যি।

———–কেন এমনটি করলি? আমাদের জানাতে পারতিস। আব্বা মাকে জানাতে পারতিস।

————- আপনারা মেনে নেবেন না তাই বলিনি।

——– হ্যাঁরে, শুনছি মেয়েটির নাকি আগে একবার অন্য কোথাও বিয়ে হয়েছিল?

———– হ্যাঁ হয়েছিল।

————- তুই বিবাহিতা মেয়েকে বিয়ে করলি? তোর বিয়ে করার ইচ্ছা থাকলে আমাদের বলতিস। আমরা ভালো মেয়ে দেখে তোর বিয়ে দিতাম। তুই এতো বড় ভুল করলি?

——- আমি ভুল করিনি ভাই। রিনিকে আমি আগে থেকেই ভালো বাসতাম। রিনির বাবা জোর করে অন্য জায়গায় তার বিয়ে দিয়েছিলেন। আমার জন্যই রিনি ঐ স্বামীকে প্রত্যাখ্যান করেছে। ও বাপের বাড়ি চলে এসে আর যায়নি।ও আমাকে ভীষণ ভালোবাসে ভাই। আমি ওকে বিয়ে না করলে ওর জীবনটা যে নষ্ট হয়ে যাবে। আমার জন্য যে মেয়েটি এতো বড় ত্যাগ স্বীকার করলো তাকে আমি ত্যাগ করি কী করে বলুন? আমিও রিনিকে ভীষণ ভালোবাসি। ওকে ছাড়া আমিও বাঁচবো না ভাই! তাতে আমাকে যে শাস্তি দেবেন মাথা পেতে নেব।

রিজু ভাবে, এই সময়ে মাথা গরম করলে চলবেনা। কিন্তু জন্মদাতা পিতা মাতার অনুমতি না নিয়ে বিয়ে করাতে রিজুর ভীষণ আপত্তি। বাড়ির অবাধ্য সন্তানের মতো কাজ করেছে ও। কিন্তু ও ঠিক কাজই করেছে। অন্ততপক্ষে মেয়েটির সঙ্গে প্রতারণা করেনি।যাকে ভালবেসেছে তাকেই বিয়ে করেছে। তার সম্মান রক্ষা করেছে।এই দিক থেকে আবির ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু তাই বলে আবিরের এই কাজকে রিজু প্রকাশ্যে সমর্থন করতে পারে না। বাড়িতে ছোট ছোট দুটো ভাই রয়েছে। আবিরের এই অন্যায়কে মেনে নিলে ওরা অনুপ্রাণিত হবে। বড়োর দেখাদেখি ছোটরা যদি ঐপথে যায় তখন তাদের শাসন করা মুশকিল হবে।

মিজানুর সাহেব কোনো মতেই নতুন বৌকে মেনে নেবেন না। তাতে যা হয় হবে। নেহার বলেন “ঐ বৌ-ছেলের মুখ আমি দেখতে চাই না।” চোখের জল মুছতে মুছতে বলেন, “যে ছেলে মা বাপের সম্মানের ধার ধারেনা সে আমার ছেলে হতে পারে না। ওকে আমি পেটে ধরিনি! ওকে আমি পেটে ধরতে পারিনা!” কান্নায় ফেটে পড়েন নেহার।

হেনা,মনা,মাসুম তাদের বাবা মা’কে সান্ত্বনা দেয়। কেউ কেউ মেনে নিতে বলে। আবির আত্মহত্যা করবে বলে ভয় দেখায়। ও বাড়ি আসেনা। অন্য কোথাও রাত কাটায়। মিজানুর সাহেব বিচলিত হোন। এমনিতেই আবিরের মাথা গরম হয়ে থাকে। খুব বদ মেজাজি। যদি সে কিছু করে বসে? চোখে মুখে অন্ধকার দেখেন তিনি। না, তিনি আর ভাবতে পারেন না। রিজুকে আবার ফোনে ধরেন।

রিজু জানিয়ে দেয়, ” আপনি যদি নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারেন তাহলে ঠিক আছে। না পারলে আপনি ভেবে দেখুন। কিন্তু মনে রাখবেন বাড়িতে এর একটা কুপ্রভাব পড়বে। ছোটরা উৎসাহিত হয়ে ওকে অনুসরণ করতে পারে। বাড়ির পরিবেশ ঠিক রাখতে হলে আপনাকে একটু কড়া হতেই হবে।”

রিজুর কথাগুলো তার বাবার ভালো লেগেছিল কিনা রিজু জানেনা। তবে মিজানুর সাহেব তার সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে পারেন নি। তিনি আবিরকে পরামর্শ দেন, “আবির,রিজুকে তুমি রাজি করাও। ও যদি রাজি হয়ে যায় তাহলে আমি তোমাদের বিয়ে মেনে নেবো।”

পরিবারের সম্মানের কথা ভেবে রিজু নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। কিছুদিন পর মিজানুর সাহেব রিজুর মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে ছেলে বৌমাকে তিনি সযত্নে তুলে নেন।পিতা হিসেবে ছেলের কাছে ভালো হোন তিনি কিন্তু বড়ো ভাই হিসেবে রিজু খারাপ হয় আবিরের কাছে। তার সমস্ত রাগ রিজুর উপর পড়ে। দুরত্ব তৈরি হয়। তার ধারণা দৃঢ় হয়, বড়ো ভাই-ই তাদের প্রধান বাধা। সুযোগের অপেক্ষায় থাকে আবির। মনে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলে। রিজু ঘুণাক্ষরেও তা জানতে পারে না।

মেহবুব ও মাহি দুই ভাই কলেজে পড়ে। রিজুর ইচ্ছা ছিল মাহিকে বহরমপুরে নিজের বাড়িতে রেখে পড়াতে। কিন্তু তাকে ভর্তি করাতে ব্যর্থ হয় রিজু। ঐ সময় এক লাল পার্টির নেতা ভর্তি করিয়ে দেবে বলে রিজুর নিকট থেকে বেশ কিছু টাকা নেয়। টাকাটা আর ফেরত দেয়নি। ভর্তি করাতে না পেরে বাবার কাছে রিজু ছোট হয়। বাবা রিজুর সদিচ্ছার উপর সন্দেহ করেন। ভাবেন,ওটা রিজুর অজুহাত। ও ইচ্ছা করেই ভর্তি করায়নি। কচি মন মাহির হৃদয় ভেঙে খান খান হয়। বড়ো ভাইয়ের প্রতি ভরসা কমে। সন্দেহ দানা বাঁধে। রিজু লজ্জিত হয়। সে তাদের বোঝাতে ব্যর্থ হয় এতে তার কোনো ত্রুটি ছিল না।

রিজুর মনে পড়ে মেহবুবের কথা।যখন ও খুব ছোট তখন বাত রোগে আক্রান্ত হয়। খুব কষ্ট পায় ও। চিকিৎসার জন্য ডাক্তার,বৈদ্য, কবিরাজ কোনটাই বাদ যায়নি। ও চিৎ হয়ে শুয়ে থাকতো। দুই পাশে দুটো বালিশ। হাত পায়ের গিট ফুলে কলাগাছের মতো। বাকি শরীর দড়ির মতো শুকিয়ে কাঠ। যন্ত্রনায় ছটফট করে ও। একাকী পাশ ফিরে শোবার ক্ষমতা ছিল না। ছোট্ট ভাই টুকুর কষ্ট দেখে পাষাণ হৃদয়েও কান্না আসে। রিজুও কেঁদেছে কত। আসলে রিজু ভালোবাসে সবাইকে। এখনও সেই ছোটবেলার মতোই ভালোবাসে। সে হয়তো তাদের বোঝাতে পারেনা। কিন্তু বড়ো হলে কেন ওরা ভুল বুঝে তাকে? রিজু উত্তর খুঁজে পায়না!

মিজানুর সাহেব ছোট ছেলেদের খুব আদরে মানুষ করার চেষ্টা করেন। কোনো অভাব বুঝতে দেননা। রিজু যে কষ্টে বড়ো হয়েছে সেই কষ্টের সিকিভাগও তারা অনুভব করেনা। শাসনের দিক থেকেও তাই। যেখানে রুটিন মাফিক প্রতিদিন প্রহার জুটতো রিজুর কপালে সেখানে ছোট ছেলেদের এই রুটিনের বাইরে রেখেছিলেন তিনি। কেন রেখেছিলেন? তিনি কি রিজুর থেকে ছোটদের প্রতি বেশি স্নেহান্ধ ছিলেন? তিনি রিজুকে বলেন, ” তোমাকে শাসন করেছিলাম বলে তুমি বড়ো হয়েছো।” তাহলে ছোটদের সেই শাসন করেননি কেন সেই প্রশ্ন রিজুর মনে। তাহলে কি তিনি চাননি ছোটরা রিজুর মতো বড়ো হোক? এই প্রশ্নের উত্তর রিজু খুঁজে পায়না।

যে সন্তানের প্রতি এতো স্নেহ, ভালোবাসা সেখানে যদি কোনো সন্তান অবাধ্য হয় তাহলে বাবা মায়ের মনে আঘাত আসবেই। সে আঘাত বলে বোঝানো যায় না। সন্তানের দেওয়া কষ্ট বাবা মায়ের হৃদয়কে কতটা ক্ষত-বিক্ষত করে বাবা মায়েরাই বোঝেন। সন্তানের দেওয়া সব আঘাত তারা হাসিমুখে নিতে পারেন। রিজু এখন বাবা হয়েছে। সে বোঝে বাবা শব্দের অর্থ কী! তাই সব অবস্থায়ই রিজু বাবার পাশে দাঁড়াতে চেয়েছে। রিজুর ছোট ভায়েরাও তো তার সন্তানের মতো। সুতরাং তাদের দেওয়া আঘাত বাবাকে যতটা আহত করে বড়ো ভাই হিসেবে ততটাই রিজুকে ক্ষত-বিক্ষত করে।

Related Articles

Back to top button
error: