সাহিত্য ও সংস্কৃতি

গল্পের নাম:- “রিজু বাঁচতে চেয়েছিলো” গল্পকার:-মোস্তফা কামাল (পর্ব-১৮)

(পর্ব-১৮)

মাসুম: হ্যালো বুবু। ভাই কিন্তু তোমাদের সবার নামে থানায় কেস করেছে। তুমি হাসিকে অন্য কোথাও লুকিয়ে রাখো।

মৌরিয়া: আমিও তাই ভাবছি। কোথায় রাখা যায় বলতো?

মাসুম: এক কাজ করো। ওদেরকে বাংলাদেশ পাঠিয়ে দাও। আমার শ্বশুর কুলের এক আত্মীয় কিছু টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশ পারাপার করে দেয়। আমি বলে দেবো তাকে।

মৌরিয়া: তুমি ভাই আবার বড়ো ভাইকে বলে দিয়ে আমাকে বিপদে ফেলবে না তো?

মাসুম: বুবু ! তুমি ভাবছো কী করে এসব। আমি তো ভীষণ খুশি হয়েছি।ওই ভায়ের জন্য বাড়িতে অশান্তি হয়েছিল। আমাকে ডোমকল ছেড়ে গ্রামের বাড়ি যেতে হয়েছিল। আমাকে মার পর্যন্ত খেতে হয়েছে ঐ ভায়ের হাতে। ওর জন্যই আবির, মেহবুব আমাকে মেরেছে। আমি কী সেসব ভুলতে পারি কখনো? যে কাজটা আমি করতে পারিনি সেটা তুমি করে দেখিয়েছো। তুমি ঠিক কাজটাই করেছো। আমিও চাই ভাইয়ের সম্মান মাটিতে মিশে যাক।ওর খুব বাঢ় বেড়েছে। তুমি হাসিকে বাংলাদেশ পাচার করে দাও।

মৌরিয়া: ঠিক আছে ভাই। তুই একটা ব্যবস্থা কর। আমি আমার ভাসুরকে বলে দিচ্ছি। যা টাকা পয়সা লাগে আমি দেবো। বাংলাদেশে আমার শ্বশুরদের অনেক আত্মীয় স্বজন আছে সেখানেই ওরা থাকবে।

মাসুম: ঠিক আছে। কেউ যেন না জানে। খুব গোপনে কাজটা করতে হবে কিন্তু। আবির, মেহবুব,মাহি ওরা সব সময় খবর নিচ্ছে। ওরা জানতে পারলে সব গণ্ডগোল হয়ে যাবে।

মৌরিয়া: তুমি নিশ্চিন্তে থাকো ভাই। কেউ জানতে পারবেনা ওরা কোথায় আছে। হেনা বুবুর ছোট মেয়ে আর মলিনার মেয়ে ওদিকের খোঁজ খবর সব সময়ই রাখছে। আবির, মেহবুব,মাহি কোথায় কখন যাচ্ছে সব আমাকে ওরা ঘন্টায় ঘন্টায় জানিয়ে দেয়। হাসিকে ভয় দেখিয়ে দিয়েছি। বলেছি, ফোনে ভুলেও তুমি কোথায় আছো কাউকে বলোনা যেন। ভাই তোমাদের খুঁজে বেড়াচ্ছেন। যদি ধরে ফেলেন তাহলে তোমার পাপা আমাদের দুজনকে একেবারে মেরে ফেলবে।

…………….খিল খিল করে হেসে ওঠে মৌরিয়া। বুঝলি মাসুম! হাসি খুব ভয় পেয়ে গেছে। খুব ভীতু মেয়ে। ও আর কাউকে কিচ্ছু বলতে পারবেনা।ভাইয়ের এই দুর্দশার কথা চিন্তা করে মাসুমও প্রতিহিংসার তৃপ্তি উপভোগ করে।

নেহার ফোন ধরেন মৌরিয়াকে।তিরস্কার করেন। বলেন, ” আমার মেয়ে হয়ে তুই এমন কাজ করতে পারলি? তাড়াতাড়ি হাসিকে ফিরিয়ে দে। না হলে তোর কপালে খুব কষ্ট আছে।”

……… “মা, আপনি এখন ঘুরে যাচ্ছেন কেন? আপনি কি জানেন না? আব্বাও তো সব জানে। এখন আমার বিরুদ্ধে গেলে আমি ভাইকে সব জানিয়ে দেবো। যে ছেলে আপনাদের অন্ধের মত শ্রদ্ধা ভক্তি করে তার সঙ্গে আপনারা কী আচরণ করছেন সব বলে দেবো।”

নেহার আর কোনো কথা খুঁজে পাননা। ফোন রেখে দেন। তিনি বুঝতে পারেন নি ব্যাপারটা এই ভাবে এতটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। রিজুকে ফোনে বলেন, ” রিজু, তুই মৌরিয়াকে ছাড়বিনা।ঐ মেয়ের হাতে পুলিশের হাত কড়া পড়লে আমি একটু শান্তি পাই।” ছেলেকে বৃথা সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি।

রিজু বড়োই একা। তার পাশে কেউ নেই। সবাই তার ক্ষতি চায়। কিন্তু সে তো কারও কোনো ক্ষতি করেনি। সব সময় যাদের কথা ভেবে ও ব্যাকুল থেকেছে তারা কেন ওর এতবড়ো ক্ষতি করলো? উত্তর পায়না রিজু।

মিতা রিজুকে দোষারোপ করে। বলে, “তোমাকে বলেছিলাম তোমার ভালো ওরা কেউ চাইনা। তোমার উপর সবাই হিংসা করে। তুমি বিশ্বাস করো নি। আজ তার ফল ভোগ করছো।এত বড় বিশ্বাস ঘাতক আমি জন্মেও দেখিনি। ছিঃ! ছিঃ! ওদের জন্য তুমি আমাদের বঞ্চিত করেছো, আমার মেয়েদের বঞ্চিত করেছো।”… মিতা কাঁদতে থাকে। খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দেয়।

এই সময় রিজুকে উত্তেজিত হলে চলবেনা। ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করতে হবে। রিজু মাসুমকে ফোনে ধরে।

হ্যালো মাসুম………..!

মাসুম: বলেন ভাই।

রিজু: একটু খবরটা নেনা ভাই। তোকে তো মৌরিয়া বিশ্বাস করে। তুই আমার পাশে একটু দাঁড়া না ভাই!

রিজুর ফোন পেয়ে মাসুমের প্রতিহিংসা পরায়ণ মনটা কিছুটা নরম হয়। বলে, হ্যাঁ ভাই, আমি দেখছি। খবর পেলে আপনাকে জানাবো। তবে শুনেছি ওরা নাকি হাসিদের বাংলাদেশ পাচার করে দেবে।

রিজু চমকে ওঠে। না আর দেরি করা যাবে না। রিজুর বিশ্বাস মাসুম অনেক কিছুই জানে। কিন্তু ও মাসুমকে জানতে দেয়না। এক সন্ধ্যায় মাসুমকে নিয়ে রিজু জলঙ্গী বেরিয়ে পড়ে। সোজা থানায়। থানার বড়ো বাবুর সাথে কথা বলে নেয়। বড়ো ভাইয়ের শুকনো মুখ দেখে মাসুমের মনে একটু মায়া জাগে।মৌরিয়ার সঙ্গে ওর কী কী কথা হয়েছে সব থানার বড়ো বাবুকে জানিয়ে দেয়। তার সূত্র ধরেই মোটা টাকার বিনিময়ে থানা উদ্ধার করে হাসিকে রিজুর হাতে তুলে দেয়। রিজু প্রাণ ফিরে পায়। আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করে। মাসুমের প্রতি দুঃখ দূর হয়। সে আজ ভাইয়ের মতো কাজ করেছে। ওর প্রতি ভালবাসা বেড়ে যায় রিজুর। মেয়েকে নিয়ে বাড়ি আসে।

রিজু সবাইকে জানিয়ে দেয়, ঐ বিশ্বাসঘাতিনী মৌরিয়া এবং তার বাড়ির কারও সঙ্গে যেন কেউ সম্পর্ক না রাখে। যদি কেউ সম্পর্ক রাখে তার সাথে রিজুর কোনো সম্পর্ক থাকবেনা। সে রিজুর শত্রুতে পরিণত হবে।

রিজুর মান সম্মান, হাসির ভবিষ্যত নিয়ে ওরা কেউ ভাবেনা। রিজুর বাবা মৌরিয়াকে তিরস্কার না করে হাসিকেই করেন। সব দোষ যেন হাসির। যারা এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল তাদের সবসময় আড়াল করেন তিনি। তিনি তার প্রতিজ্ঞার কথা ভুলে যান। মেয়েকে প্রশ্রয় দেন। তাদের সঙ্গে গোপনে সম্পর্ক রাখেন। রিজু সব জানতে পারে। তার কষ্ট হয়। এই নিয়ে তার অসন্তোষের কথা জানালে মা নেহার জানান, “দু’জনেই তো সমান অপরাধে অপরাধী। রিজু বাপ হয়ে যদি তার মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে পারে তাহলে আমি মা হয়ে কেন মৌরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক রাখবো না?”

মায়ের কথাগুলো রিজুকে বিষাক্ত তীরের মত বিদ্ধ করে। ডানা ভাঙ্গা আহত পাখির ন্যায় ছটফট করে সে।ভাষা খুঁজে পায়না। অন্তরে বাবা মায়ের বিরুদ্ধে চাপা কষ্ট জমা হয় তার।

রিজু জানতে পারে গোপনে বাড়ির সবাই মৌরিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। আবিরের যোগাযোগ রাখা নিয়ে রিজু ওকে একবার কথা বলতে গিয়ে অপমানিত হয়েছিল। ও বলেছিল, ” আপনি যোগাযোগ রাখুন আর না রাখুন আমাদের বুবুর সঙ্গে আমরা যোগাযোগ রাখবো। আমাদের সঙ্গে তো বুবু কোনো খারাপ আচরণ করেনি।”

রিজু বুঝতে পারে কেউ তার নয়। তাকে কেউ আপন ভাবে না। সেই শুধু সবাইকে আপনার ভাবে। মিতার কথাগুলো মনে পড়ে তার।

মা রিজুকে বলেন, “আবিরকে কিছু বলিস না। ও তোকে উল্টো পাল্টা বলে দেবে। তোর খারাপ লাগবে।”

পরে রিজুর মনে হয়েছিল, আবিরের বিয়ে সে মেনে নিয়েছিলো না বলেই একটা চাপা রাগ ছিল তার । প্রতিহিংসার আগুন ছিল তার মনে। তাই তার বড়ো ভাইয়ের অপমান তার অপমান বলে মনে হয়নি। হাসি শুধু রিজুর মেয়ে, ও কারও মেয়ে নয়। ও কারও ভাইঝি নয়! হাসি নিজেও পরে বুঝতে পারে। তাদের স্বরূপ জানার পরে হাসিও তাদের থেকে দূরে থাকে। দাদু,দাদি,কাকু ও পিসিদের প্রতি ওর অন্তরের যে আকর্ষণ ছিল তা ক্রমশঃ হারিয়ে যায়। ওদের প্রতি মনে একরাশ দুঃখ জমা হয়।

সত্যি কখনও চাপা থাকেনা। সবাই রিজুর কাছে সাধু সাজার চেষ্টা করে। মৌরিয়া একা পড়ে যায়। সে বলে, “আমাকে সবাই গাছে তুলে দিয়ে মই টেনে নিয়েছে।”

সবাই বলতে কাকে কাকে বোঝাচ্ছে সেটা রিজু জানতে চায়নি। জানলে তাদের প্রতি অবশিষ্ট শ্রদ্ধা, ভালোবাসা টুকুও হয়তো শেষ হয়ে যাবে। মৌরিয়ার স্বামী মুস্তাফিজুর ফোন করে ক্ষমা চেয়েছে বারবার। ও বলেছে, “ভাই, আপনি আমাদের ক্ষমা করে দিয়েন। আমরা হাসিকে আপনার হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমার ভাসুর দিতে দেয়নি। আর আপনাদের বাড়ির যদি সহযোগিতা না থাকতো তাহলে এতবড়ো ঘটনা ঘটতোও না। আজ যদি সেগুলো বলি তাহলে আপনাদের বাপ ব্যাটা ভাই বোনদের মধ্যে রক্তপাত হবে। সবটাই আপনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ছিল। এর কারিগর তারাই যাদের আপনি বেশি ভালবাসেন!”

রিজু তো তার বাপ মা ভাই বোনদের খুব ভালোবাসে। এই কথা শোনার পরও সে অবাক হয়না। ইতিমধ্যেই বাবা,মা,ভাই বোনদের আচরণে সে অনেক কিছুই জেনে গেছে। আল্লাহ একদিন ঠিক এর বিচার করবেন এই ভরসা নিয়ে রিজু নিজেকে ঠিক রাখে। এছাড়া আর কীইবা করতে পারে সে। ওর কপালটাই তো পোড়া। ওকে তো পুড়তেই হবে।

নিজেদের মান সম্মান খুইয়ে রিজুর ভাই বোনেরা অনেকেই মৌরিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে। নেহার গোপনে মেয়ের বাড়ি যান। মৌরিয়াও আসে। এই জন্য রিজুর সাথে বাড়ির সম্পর্ক ঠুনকো সম্পর্কে পরিণত হয়। বাবা মায়ের সঙ্গে দীর্ঘদিন রিজুর কথা বলা বন্ধ থাকে। তাতে বাবা মায়ের হৃদয় গলেনা। তবুও কর্তব্যের তাড়নায় নির্লজ্জের মতো রিজু বাড়ি গিয়ে বাপ মাকে দেখে আসে। মিতা বলে, “তোমার যারা এতবড়ো ক্ষতি করলো, তোমার সম্মান নিয়ে খেলা করতে যাদের এতটুকু বাঁধলো না তাদের সঙ্গে তুমি সম্পর্ক রাখো কী করে? তুমি বলেই ওদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখো। অন্য কেউ হলে কখনোই অমন-বাপ মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতো না।”

……. বাপ মাকে দোষারোপ করলে হবে? ওরাই বা কী করবেন? হাসি যেমন আমার মেয়ে তেমনি ওটাও তো ওদের মেয়ে?

………মেয়ে? যে মেয়ে ছেলের এতো বড়ো সর্বনাশ করে সে মেয়ে হয় কেমন করে? যে মেয়ে নিজের বাপ মাকে অপরাধী করে তার সঙ্গে সেই বাপ মা যোগাযোগ রাখেন কী করে? তোমার কেমন বাপ মা? তার মানে কি এটা নয়, মৌরিয়া-মুস্তাফিজুরের কথাই সঠিক? তোমার ভায়েরা ঐ বোনের বাড়ি যায় কোন লজ্জায়? তাদের কি মান সম্মান কিছুই নেই?

ঠিকই বলেছে মিতা। বাড়ির আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না রিজু। ও এখন একেবারেই একা।সবাই থেকেও কেউ নেই তার। সামান্য স্বার্থের জন্য বড়ো ভাইয়ের ক্ষতি করতে যে বোনের একটুও হৃদয় কাঁপে না সে কোনোদিনই রিজুর বোন ছিল না! থাকতে পারেনা! তার প্রতিজ্ঞা, “সবাই যায় যাক, রিজু প্রাণ থাকতে ঐ মাটিতে পা দেবেনা। আর যারা আত্মসম্মান বোঝে, রিজুকে সত্যিকারের ভালবাসে, নিজের ভাবে, তারাও রিজুর আবেগের মর্যাদা রক্ষা করবে। যারা করবেনা তাদের প্রতিও রিজুর কোনো দায়-দায়িত্ব থাকবেনা।হোকনা তার যতই প্রিয়জন। ওদের প্রিয়জন আর প্রয়োজনের পার্থক্য সময় ঠিক বলে দেবে একদিন।” সেদিনের অপেক্ষায় থাকে রিজু।

Related Articles

Back to top button
error: