সাহিত্য ও সংস্কৃতি

গল্পের নাম:- “রিজু বাঁচতে চেয়েছিলো” গল্পকার:-মোস্তফা কামাল (পর্ব-২২))

(পর্ব-২২)

ক্লাস থেকে বের হতেই ডোমকল থেকে রিজুর বাবার ফোন আসে। “হ্যালো আব্বা, বলুন। ভালো আছেন? কিছু বলবার আগেই মিজানুর সাহেব ডুকরে কেঁদে ওঠেন। রিজুর বুকটা ধড়াস করে ওঠে। মায়ের কিছু হয়ে গেলো নাকি! মা কয়েকদিন ধরে একটু অসুস্থ।

……আমি কী করবো গো রিজু? মাহি আমার কথা শুনছে না। ও একটা কোথাকার মেয়েকে বিয়ে করতে চায়ছে। মেয়েটির নাকি আগে একবার বিয়ে হয়েছে। আমি কী করবো বুঝতে পারছি না। তুমি বলো আমি কী করবো?

……..আপনি কাঁদছেন কেন? চুপ করুন। শান্ত হোন।

…… আমি শান্ত হতে পারছিনা! আবির একবার এই কাজ করলো। আবার মাহি যদি এই কাজ করে আমি আর মুখ দেখাতে পারবো না গো!!

……. আপনি মনকে শক্ত করুন। একবার আবির করেছে এবার মাহি করবে, তার পর মেহবুব তারপর…. এই ট্র্যাডিশন চলতেই থাকবে। পরিবারের অসম্মান যদি রুখতে চান তাহলে আপনাকে কড়া পদক্ষেপ নিতেই হবে আব্বা।

…….আমার মাথায় কিছুই ঢুকছেনা। আমার বাড়ির ছেলেরা কেন এমন হলো! আমি কী পাপ করেছিলাম! কান্না থামে না…….!

………আপনি ভেঙে পড়লে হবে কী করে? ধৈর্য্য ধরুন সব ঠিক হয়ে যাবে। এই বয়সে ছেলে মেয়েরা একটু আধটু ভুল করে। ওদের পাশে দাঁড়িয়ে ভুল সংশোধন করে দিতে হবে। পরিষ্কার করে মাহিকে জানিয়ে দিন আপনার আপত্তির কথা, সামাজিক মর্যাদা হানির কথা। নিশ্চয়ই ও বুঝবে।

…….তুমি ওকে একটু বোঝাও রিজু!

……..আমি বললেই ও বুঝবে? এটা তো একদিনে এমনটা হয়নি। আপনি কি আগে জানতেন না? তখন কিছু বলেননি আর এখন আমাকে বলে কি কোনো লাভ হবে? আপনার কথা শুনে যতবার ভাইদের বলতে গিয়েছি ততবারই আমি তাদের কাছে অপরাধী হয়ে গিয়েছি। আমাকে ওরা ভুল বুঝেছে। যা বলার আপনিই বলুন। আমি আর ওদের কাছে খারাপ হতে চাই না। আপনার নিরপেক্ষতার অভাবে আর অত্যধিক স্নেহান্ধের ফলে ওরা ভুল পথে চালিত হচ্ছে বারবার।

………তোমরা সবাই আমাকেই ভুল বুঝছো। আমার কাছে সবাই সমান। আমি যখন কোনো কষ্ট পাই তখন তোমার কথাই মনে করে শান্তি পাই। তোমার মতো ওরা হতে পারলোনা। তুমি একটু দেখো। পারলে একবার এসো।

…….ঠিক আছে। সময় করে আমি একদিন আসছি। আপনি শান্ত হোন। ওকে বোঝান।

একদিন মিতার সঙ্গে ফোনে মাহির কথা হয়। জানায়, ” আমি ওখানেই বিয়ে করবো। আব্বা রাজি। ভাবি, আপনি ভাইকে বলেন তিনি যেন আমাদের বিয়েতে বাধা না দেন।” মিতা বলেছিল, “আব্বা রাজি থাকলে তোমার ভাই বাধা দিতে যাবে কেন?”

কয়েকদিন পর রিজু জানতে পারে বাড়ির সবাইকে নিয়ে মাহি বিয়ে করতে যাচ্ছে। মা খুব কান্নাকাটি করছেন। তিনি বলছেন, ” আমি কোনমতেই ঐ মেয়েকে আমার বাড়ির বৌ বলে স্বীকার করবোনা।”

মায়ের সঙ্গে রিজু ফোনে কথা বলে।মা বলেন, “মাসুমের উদ্যোগে বিয়েটা হচ্ছে। তোর আব্বা মত দিয়েছেন। আমার মতের দাম কেউ দিলোনা রিজু।”

…….তুমি চিন্তা করো না মা। আব্বার ভূমিকা ঠিক নেই। ছোট ভাইয়ের বিয়ে দিচ্ছেন অথচ আব্বা একবার আমাকেও জানাচ্ছেন না। আমাকে গোপন কেন মা? আব্বা কান্নাকাটি করে আমাকে অভিযোগ জানালেন, আবার আব্বাই বিয়েতে সম্মতি দিলেন? ভালো কথা। আমি তোমাদের বাড়ির কেউ না?

……..আমি কী বলবো?আমারই তো কোনো গুরুত্ব নেই এই বাড়িতে। ওরা বাপ বেটা যা খুশি করুক। আমি ঐ বৌয়ের হাতে কিছু খাবোও না,আমি দেখবোও না।

রিজুর বাবা রিজুকে সান্ত্বনা বাক্য শোনান। তিনি বলেন, আমি মত দিতে বাধ্য হয়েছি রিজু। তাই তোমাকে কিছু বলিনি। মাসুমই সব কিছু করছে। আমি কাউকে বলিনি। মনা, সিফা আর আব্দুল্লাহ যাচ্ছে। ওরা বিয়ে পড়িয়ে নিয়ে আসুক। আমি ঐ ছেলের কোনো দায়িত্ব নেবো না।

রিজু কোনো কথা বলেনা। ফোন রেখে দেয়। একবুক হতাশা কাজ করে। ছোট ভাইটাও তাকে বাদ দিয়ে জীবনের এতবড়ো সিদ্ধান্ত নিলো?যাকে এত ভালোবাসে সেই ভাই তাকে জানালোনা পর্যন্ত?

রিজু ভাবে,বাবা নিশ্চয়ই তার সম্বন্ধে মাহিকে বলেছেন। হয়তো বলেছেন, “আমি রাজি কিন্তু তোমার ভাই রাজি নয় তাই এই বিয়েতে মত দিতে পারছিনা।” বাবার নিজেকে নির্দোষ রাখার জন্য তার একটা বোকা ছেলে তো রয়েছেই। তার ঘাড়ে বন্দুক রেখে ইচ্ছা মতো ফায়ার করা যায়।

এজন্যই মাহি রিজুকে হয়তো ভুল বুঝেছে। তাই বলেনি। অথবা ভয়ে বলতে পারেনি। যাক গে, আল্লাহ ওদের মঙ্গল করুন মনে মনে বলে রিজু।

বৌ শ্বশুর বাড়ি আসে। যেন সব দোষ তার। শাশুড়ি ঘুরেও বৌ এর মুখ দেখেন না। বৌ এর প্রতি বড্ড অভিমান। বড়ো ছেলের বৌকে কোনো কাজে পাওয়া গেল না,মেজ ছেলে বিয়ে করে মাকেই ভুলে গেছে, আবির কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করলো। ছোটটাও সবাইকে কাঁদিয়ে……….! নেহার কাঁদেন। ছোট বৌ শাশুড়ির কাছে গিয়ে অপরাধীর মতো দাঁড়ায়। কী বলবে সে, কেমন করেই বা বলবে? সে তো অপরাধী। কোন লজ্জায় মা বলে ডাকবে শাশুড়িকে? শাশুড়ি যদি কথা না বলেন? যদি মুখ ঘুরিয়ে নেন? খুব খারাপ লাগবে তার। লাগুক খারাপ! তবুও সে শাশুড়ির কাছে গিয়ে কাঁপা গলায় ডাকে, মা!

নেহার কী জবাব দেবেন খুঁজে পাননা। তার হৃদয় ছিঁড়ে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছে। মা ডাক তার ছেঁড়া হৃদয়কে কি জোড়া দিতে পারবে? পারবে কি তার মনের মধ্যে উথাল পাথাল ঢেউকে থামাতে? নেহার না শোনার ভান করেন।

মা! মা গো! আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন মা! আপনার পায়ে আমাকে ঠাঁই দিয়েন। আমি আপনার মেয়ে। মেয়ের অপরাধ মা কি ক্ষমা করে না? মা………!

মিজানুর সাহেব নেহারকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। বলেন, “তুমি শুনতে পাচ্ছ না, বৌমা তোমাকে মা বলে ডাকছে। তুমি ওদের ক্ষমা করে দাও।”

নেহার মুখ তোলেন। চোখে জল। আঁড়চোখে স্বামীর দিকে তাকান।বলেন, আমাকে মা বলার কী দরকার, যেখানে বাপ আছে। আপনাকে আব্বা বললেই তো হবে। আমি কে? আমি মা নই!

……মা! আপনি আমাকে ক্ষমা করুন মা। আমি একবার ভুল করেছি মা! এই হতভাগীকে আপনার হৃদয়ের এক কোণে একটু ঠাঁই দিন মা। কথা দিচ্ছি আর কখনো ভুল করবোনা। আপনি যেভাবে বলবেন সেইভাবেই চলবো।

ছোট বৌ এর কথায় নেহারের হৃদয় নরম হয়। অশ্রু ঝরে পড়ে। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেন না। বৌমার দিকে তাকিয়ে বলেন, কী নাম তোমার?

………আমার নাম তিতলি।

………খুব সুন্দর নাম। দেখতেও ভারী সুন্দর। তোমার আব্বা মা ভালো আছেন? তোমার সঙ্গে কে এসেছেন?

………হ্যাঁ মা সবাই ভালো আছেন। সঙ্গে কেউ আসেনি মা! অপরাধী হয়ে আমি একাই এসেছি।

…..না না, ঠিক আছে। তুমি অপরাধ করবে কেন? অপরাধ করেছে আমার ছেলে। মনা, ওদের ঘরে নিয়ে যা। যাও তিতলি ঘরে যাও। কাল সকালে কথা হবে। মনা এসে তিতলিকে নিয়ে ঘরে ঢুকে যায়।

নেহার যেহেতু প্রতিজ্ঞা করেছিলেন সেই হেতু বৌ-ছেলেকে মেনে নিলেও মন থেকে আপন করতে পারছেন না। তিনি বড়োই জেদি। অভিমানীও। কারণে অকারণে ছেলে বৌ এর সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেন। একসময় দূরত্ব বেড়ে যায়। ছেলে বৌ পর হয়।

কিছু দিন পর রিজু জানতে পারে তার ধারণাই সঠিক। তার সম্বন্ধে মাহিকে ভুল বোঝানো হয়েছিল । বিয়ের পূর্বের সমস্ত ঘটনা, বাবার ভূমিকা কী ছিল সব কিছু মাহি রিজুকে জানায়। মাহির ভুল ধারণা ভেঙে যায়। বলে, “ভাই,আপনি না বললে আমি জানতেই পারতাম না। আপনাকেই অপরাধীর আসনে বসিয়ে রাখতাম সারাজীবন। আপনি আমাকে ক্ষমা করেন।”

বাবা মাকে কষ্ট দিয়ে, তাদের সম্মান নষ্ট করে মাহির বিয়ে করাটাকে রিজু পছন্দ করেনা। কিন্তু তবুও ছোট ভাইটার জন্য রিজুর গর্ব হয়। কারণ যে কোনো মূল্যে সে তার ভালবাসার মূল্য দিয়েছে। ভালবাসা এমনটিই হওয়ায় উচিত। মাহি ছোট ভাই হয়ে যেটা করে দেখাতে পেরেছে বড়ো হয়ে সে সেটা পারেনি। রিজু জানেনা তার শালিনী কোথায় আছে, কেমন আছে! ধিকৃত মনে হয় নিজেকে। ধিক্কার জানায় পরিস্থিতির নামে তার বিকিয়ে যাওয়াকে। সে একজন প্রতারক! একজন মিথ্যাবাদী। একটু ভালো থাকার জন্য, সবাইকে ভালো রাখার জন্য শালিনীর ভালবাসাকে অমর্যদা করেছে সে। তার হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করে সে নিজেও আজ জীবন্মৃত হয়ে আছে। এসব ভাবতে ভাবতে রিজু গভীর শূন্যতায় ডুবে যায়।

Related Articles

Back to top button
error: