পাঠকের কলম

বিশ্ব পরিবেশ দিবসে ভারত সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে কিছু প্রশ্ন

আজ ৫ই জুন, বিশ্ব পরিবেশ দিবস। জাতিসংঘের উদ্যোগে ১৯৭৪ থেকে এই দিনটি পালন হয়ে আসছে বিশ্বজুড়ে পরিবেশ সুরক্ষা এবং সুষম উন্নয়ন সংক্রান্ত গণচেতনা গড়ে তুলতে। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশ দিবসের গুরুত্ব বেড়েছে সর্বত্রই। এই দিনটা সুযোগ দেয় প্রকৃতি, পরিবেশ এবং জলবায়ুর পরিবর্তন আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যতকে কিভাবে প্রভাবিত করছে বা করবে তাই নিয়ে একটু ভাবার, কিছু করার।

পশ্চিমবঙ্গে গত কয়েক বছরে আমফান এবং ইয়াসের মতন সাঙ্ঘাতিক সমুদ্রঝড়ের ঝাপটায় জলবায়ু সঙ্কটের ধাক্কা আমরা খানিকটা প্রত‍্যক্ষ করেছি। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যেই সতর্ক করেছেন যে বিশ্ব উষ্ণায়ন চলতে থাকলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে কয়েক দশকের মধ্যেই জলের তলায় তলিয়ে যাবে বেশ কিছু উপকূলবর্তী অঞ্চল। আমাদের রাজ্যে এই বিপদসীমায় দাঁড়িয়ে আছে সুন্দরবন সহ দুই চব্বিশ পরগণা, পূর্ব মেদিনীপুর এবং কলকাতার বিস্তীর্ণ অঞ্চল। প্রতিবেশী বাংলাদেশেরও বিস্তীর্ণ অঞ্চল বিপদসীমায় দাঁড়িয়ে।

জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য প্রধানত দায়ী শক্তি উৎপাদনে কয়লা, খনিজ তেল ইত্যাদির মতন জীবাশ্ম জ্বালানির থেকে কার্বন নিঃসরণ। এটা কমাতে প্রয়োজন কয়লা বা তেলের পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব, বিকল্প উৎস থেকে শক্তি উৎপাদন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পরিবেশ দপ্তরের State Action Plan on Climate Change 2017-2020 অনুযায়ী রাজ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনে পুনর্নবীকরণ যোগ্য শক্তির ব্যবহারকে বর্তমানের ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০৩০-৩১ অর্থবর্ষে ২২ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। অর্থাৎ এই দশকে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লাচালিত বিদ্যুতের অনুপাত ৯৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৭৮ শতাংশ করার কথা। এই লক্ষ্যমাত্রা পূর্ণ করতে পারলে প্রতি বছর ১৮ হাজার গিগাগ্রাম কার্বন-ডাইঅক্সাইডের নির্গমন কম হবে বলে সরকারি রিপোর্টে উল্লেখ করা আছে।

রাজ্য সরকারের নিজেরই তৈরি এই লক্ষ্যমাত্রা কিন্তু ইতিমধ্যেই এক করুন পরিহাসে পরিণত হয়েছে। এখনো পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পরিবেশ দপ্তরের ওয়েবসাইটে “Climate Change” সংক্রান্ত “Projects in Pipeline”-এ ক্লিক করলে দেখাবে “Page under Construction”; অর্থাৎ পরিবেশবান্ধব সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি বা অন্যান্য পুনর্নবীকরণ যোগ্য শক্তি উৎপাদনের একটাও বলার মতন প্রকল্প রাজ্য সরকারের নেই – http://www.environmentwb.gov.in/project_pipe_line.php

২০২১-এর নভেম্বরে গ্লাসগোতে কপ ২৬ জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্বজুড়ে কয়লা চালিত তাপবিদ্যুতের অনুপাত কমিয়ে এনে বিদ্যুৎ উৎপাদনে পুনর্ব্যবহারযোগ্য বিকল্প শক্তির অনুপাত বাড়ানোর বিষয়ে আন্তর্জাতিক বোঝাপড়া হয়েছে। ভারতও এই বোঝাপড়ার শরিক। ভারত সরকারের কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের হিসেব অনুযায়ী দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতায় কয়লা চালিত বিদ্যুতের বর্তমান অনুপাত ৪৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০২৯-৩০ সালে ৩৩ শতাংশে নিয়ে আসা হবে। অন্যদিকে ২০২১-২২ থেকে ২০২৯-৩০-এর মধ্যে জাতীয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে সৌরশক্তির অনুপাত ২১ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩৪ শতাংশ হওয়ার কথা, বায়ুশক্তির অনুপাত ১২ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৭ শতাংশ। ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতে বছরে ৫০ লক্ষ টন গ্রীন হাইড্রোজেন উৎপাদন করার লক্ষ্যমাত্রাও ঠিক করা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক চাপে কেন্দ্রীয় সরকার নানারকম লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছে ঠিকই, কিন্তু কাজের বেলায় তার দ্বিচারিতা স্পষ্ট। কয়লা চালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে এনে সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, গ্রীন হাইড্রোজেন, অ্যামোনিয়া-সহ অন্যান্য নবায়নযোগ্য শক্তির উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বাস্তব উদ্যোগের অভাব।

অথচ এরই মধ্যে বীরভূমের মহম্মদবাজার ব্লকে দেউচা-পাঁচামি এবং দেওয়ানগঞ্জ-হরিণশিঙা অঞ্চলে ২১ হাজার মানুষকে উচ্ছেদ করে, বেশ কয়েক হাজার গাছ কেটে, দ্বারকা নদী-খাল-বিল-ভূগর্ভস্থ জলস্তরের ক্ষতি করে, শাল-পলাশের জঙ্গল এবং ওই অঞ্চলের কৃষিক্ষেত্রকে ধ্বংস করে একটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল, সময় সাপেক্ষ এবং অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক কয়লাখনি করার বরাত দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার; রাজ্য সরকারও এই কয়লা খনির জন্য জমি অধিগ্রহণ করতে অস্থির হয়ে উঠেছে। গোটা বিশ্ব যখন কয়লা এবং খনিজ তেলের ব্যবহার কমাচ্ছে, তখন ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গ সরকার সম্পূর্ণ উল্টো পথে হেঁটে নতুন কয়লা খনি থেকে ২০০ কোটি টন কয়লা তুলে, আগামী ১০০ বছর ধরে সেটা পুড়িয়ে বিপুল পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ করতে চাইছে।

সি৪০ গোষ্ঠীর সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গবেষণা রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বের ৬১টি মেগাসিটির মধ্যে কয়লাজনিত বায়ুদূষণের হার সবচেয়ে বেশি কলকাতাতে। এই কয়লাজনিত বায়ুদূষণের ফলে হাঁপানি এবং অন্যান্য শ্বাসকষ্টজনিত অসুখে অপরিণত বয়সে মৃত্যু হচ্ছে অনেক বাসিন্দার, যেই তালিকার শীর্ষে কলকাতা। এই মাত্রাতিরিক্ত বায়ুদূষণের প্রধান কারণ পশ্চিমবঙ্গ-সহ সমগ্র পূর্ব ভারতের একগাদা কয়লা চালিত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ উৎপাদন নিগম (West Bengal Power Development Corporation) রাজ্যে পাঁচটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালায়, পাঁচটিই কয়লা চালিত তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র:
https://wbpdcl.co.in/our-plants

এত বছরে পশ্চিমবঙ্গে একটাও বড় আকারের সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট বা উইন্ড পাওয়ার প্ল্যান্ট তৈরি করা গেল না কেন? কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বিকল্প, পুনর্নবীকরণ যোগ্য শক্তির প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে না কেন? পশ্চিমবঙ্গে আজকের দিনে দেউচা-পাঁচামির মতন একটি নতুন কয়লাখনি প্রকল্প কি আদপেও জনস্বার্থে? বিশ্ব পরিবেশ দিবসে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের সামনে এই প্রশ্নগুলো থাকলো।

প্রসেনজিৎ বসু ও সমীরণ সেনগুপ্ত

Back to top button
error: