রাজ্য

তৃণমূলের বিরুদ্ধে একরাশ ক্ষোভ নিয়ে কামরুজ্জামানের নেতৃত্বে অধীররঞ্জন চৌধুরীর সঙ্গে বৈঠক মুসলিম নেতাদের

নিজস্ব সংবাদদাতা,টিডিএন বাংলা, কলকাতা:তৃণমূলের বিরুদ্ধে একরাশ ক্ষোভ নিয়ে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীররঞ্জন চৌধুরীর সঙ্গে বৈঠক করলেন দলিত ও মুসলিম নেতারা। বৃহস্পতিবার রাজারহাট নিউ টাউনের একটি হোটেলের এই বৈঠক হয়। এদিনের অনুষ্ঠানের মূল আহ্বায়ক সারা বাংলা সংখ্যালঘু যুব ফেডারেশনের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন,”আমরা ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির উত্থান চাই। বিজেপিকে হারানোর জন্য সব দলের কাছে যাচ্ছি,কিন্তু নিজেদের অপ্রাসঙ্গিক করে কিছু হবেনা, রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষ দল যেমন প্রয়োজন তেমনি বঞ্চিত সমাজের প্রতিনিধিত্বও দরকার।”

মুহাম্মদ কামরুজ্জামান আরও জানান, আমরা আগামী ২০২১ সালের নির্বাচন নিয়ে ভাবছি। এমনি এমনি শুধু বিজেপির ভয় দেখিয়ে মুসলিম ভোট মিলবে না, উন্নয়ন করতে হবে। অসহায় জাতিকে ঠগিয়ে রাজনীতি করা অন্যায়। আমরা চাই,ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির জয়,আমরা চাই সংখ্যালঘু মুসলিমদের অধিকার।

বৈঠকে বহু গ্রন্থের প্রণেতা, বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী মুহাম্মদ নুরুদ্দিন বলেন,”যোগ্যতম লোকেরা দেশের নেতৃত্ব দিক। সত্যি কথা বলতে ,দলিত,সংখ্যালঘু সমাজ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ নয়। সেজন্য প্রয়োজন তাদেরকে হাত ধরে টেনে তুলে নিয়ে আসা। আমরা আশা করবো সকলকে এগিয়ে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে কংগ্রেস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

দলিত ও মুসলিম নেতাদের বক্তব্য শোনার পর প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি ও সাংসদ অধীররঞ্জন চৌধুরী বলেন, মুসলিমরা বিশ্বকেন্দ্রিক সম্প্রদায়,তারা কওমে বিশ্বাস করে, এটা কোনও আঞ্চলিক ধৰ্ম নয় যে কেউ মনে করলো যে আমি কিছু লোককে মেরে ধরে অধিকার কেড়ে নিয়ে খতম করে দেবো তা হবেনা।”
তিনি আরও বলেন, মুসলিম বিপন্ন, তুমি আমার সঙ্গে থেকো তোমাকে রক্ষা করবো, এই কথা বলার মধ্যে ধান্দাবাজি আছে। কিন্তু কে কাকে বাঁচাবে? মুসলমানকে বাঁচানোর ঠিকাদার কাউকে দেওয়া হয়নি।
তিনি বলেন,আমরা সুযোগ তৈরি করে দিতে পারি। সামাজিক,রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার একটি সমাজকে সুরক্ষা দিতে পারে। সেই অধিকার কেড়ে নিলে সমাজ পিছিয়ে যায়।
অধীররঞ্জন চৌধুরী বলেন, আপনি ভারতবর্ষ দেখছেন? ভারতবর্ষতো বটেই বিভিন্ন দেশেও মুসলিম নির্যাতন হচ্ছে। চিনে যান তো, চিনে উইঘর মুসলিমদের উপর যে অত্যাচার হচ্ছে তা কল্পনার বাইরে। লক্ষ লক্ষ মুসলমানকে ক্যাম্পে ভরে রাখা হচ্ছে। তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে গিয়ে মুসলিম নাম বদলে দিয়ে অন্য নাম দিয়ে অন্য বাবা মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছে। একটা জাতিকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য কী ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা হচ্ছে! ক্যাম্পে মুসলিমদের কুরআন, আল্লাহ, হজরত মুহাম্মদ(স:) কে ভুলিয়ে দিয়ে নতুন দর্শন শেখানো হচ্ছে।
এদিন অধীর বাবু মুসলিমদের পাশে থাকার আশ্বাস দেন। তবে আগামী বিধানসভা ভোটের আগে তাঁর এই মুসলিম নেতাদের সঙ্গে বৈঠক ভোটের জন্যই বলে অনেকে মনে করছেন।

একটা সময় এ রাজ্যে মুসলিম ভোটের বড় অংশ কংগ্রেসের দিকে ছিল। পরে বামফ্রন্ট জামানায় সেই ভোট দুইভাগ হয়ে যায়। তৃণমূল জামানায় বড় অংশের মুসলিম ভোট মমতার পক্ষে থাকলেও বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের দিকেও আছে। এমনকি বর্তমানে তৃণমূল সরকারের কাজে অসন্তুষ্ট মুসলিমরাও বিকল্প পথ খুঁজছে।
এদিন মুসলিম নেতারা অভিযোগ করেন, বিজেপির ভয় দেখিয়ে মুসলিম ভোট নিতেই গেরুয়া শিবিরকে জায়গা দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলকে অপ্রাসঙ্গিক করেছে তৃণমূল। মুসলিম উন্নয়ন হয়নি বলেও অভিযোগ।

মুসলিম নেতারা বলেন, তৃণমূল সরকার তাদের জন্য কাজ না করে প্রচার করেছে বেশি। বিজেপির সুবিধা হয় এমন কাজ করেছে। শিক্ষিত মুসলিম সমাজ তৃণমূলকে ভালো চোখে দেখছে না,কিন্তু সাম্প্রদায়িক শক্তির ভয়ে বাধ্য হচ্ছে তৃণমূলকে ভোট দিতে। আর শাসক দলের এই ছক ভাঙতে অধীর বাবু জানান, যদি কংগ্রেস ও অন্যান্য ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার মতো অবস্থায় যেতে পারে তাহলে বিজেপি তেমন লাভ করতে পারবে না।
অধীর রঞ্জন চৌধুরী বলেন, দেশের অবস্থা খুবই সংকটজনক। এমন একটা দল ভারতে ক্ষমতাসীন যারা দেশের সংবিধান মানে না, গণতন্ত্র মানে না, বহুত্ববাদীর সংস্কৃতি মানে না। জাতপাতের বিভাজন এনেই দেশকে হিন্দুত্ববাদীর রাষ্ট্র করতে চাইছে। এদের হাত থেকে আমি, আপনি কেউ রেহাই পাবোনা। তাই এখন থেকেই আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে।
তিনি বলেন , এই রাজ্যে কোনো দিন জাতপাত ছিল না। সেই জাতপাতের মূল কান্ডারীই হচ্ছে তৃণমূল। একদিকে ইমামভাতা অন্যদিকে পুরোহিত ভাতা ও ক্লাবগুলিকে খয়রাতি দিয়ে বিভাজনের ফাটল ধরিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মনে রাখবেন ,কোনো সভ্য সমাজ বা সুশীল সমাজ এটাকে সমর্থন করে না। কংগ্রেস একটি দায়িত্বশীল দল, স্বাধীনতা সংগ্রামের দল। দেশ যখন ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়ে যায়, ভারত তখন ধর্ম নিরপেক্ষতার পথকেই বেছে নিয়েছিল। ইন্দিরা গান্ধী সেই ধর্ম নিরপেক্ষতা ঢুকিয়ে ছিলেন। ১৯৭২ থেকে ৭৭ সাল পর্যন্ত সিদ্ধার্থের জামানায় ১০ শতাংশ মুসলিমদের চাকরি হয়েছিল। পুলিশ মন্ত্রী , কৃষি মন্ত্রী , বিদ্যুৎ মন্ত্রী এবং সমবায় মন্ত্রী হয়েছিলেন মুসলিম। সিদ্ধার্থ শংকর রায় সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার দিয়েছিলেন। বাম জামানায় আর যা হোক না কেন মৌলবাদী শক্তিকে তারা বাড়তে দেয়নি।

এদিন মুসলিম ও দলিত নেতাদের সামনে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরী আরও বলেন ,পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ,আরএসএস সহ হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি আরও বেড়েই চলেছে। তৃণমূল কিন্তু তার দায় এড়াতে পারে না। মনে রাখা দরকার ১৯৯৮-৯৯ সালে এই রাজ্যে প্রথম বিজেপির সঙ্গে জোট করে লোকসভা ভোটে লড়েছিল তৃণমূল। আর ২০০২ সালে গুজরাটের সংখ্যালঘু গণহত্যার সময় নরেন্দ্র মোদিকে ফুলের তোড়া পাঠিয়েছিলেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই বিজেপি ও তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গেলে দল মত নির্বিশেষে সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি গুলোকে একজোট হতে হবে। বিহারে আরজেডি-কংগ্রেস জোট ক্ষমতায় আসবে, শুধু সময়ের অপেক্ষা।
ওয়েলফেয়ার পার্টির আবু তাহের আনসারী জানান, রাজনৈতিক বঞ্চনার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ভাবেই লড়তে হবে। নিজেদেরকে এদেশ পরিচালনার জন্য যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে।
বৈঠকে বহু আদিবাসী ও দলিত নেতা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া জমিয়তে আহলে হাদিসের রাজ্য সম্পাদক আলমগীর সরদার, মুসলিম থিংক ট্যাংক-র রাজ্য সম্পাদক শাহ আলম ছাড়াও মাদ্রাসা ছাত্র নেতা, সারা বাংলা আহলে সুন্নাতুল হানাফী জামাত
সহ বেঙ্গল মাদ্রাসা এডুকেশন ফোরামের নেতাও উপস্থিত ছিলেন।

Related Articles

Back to top button
error: