HighlightNewsসম্পাদকীয়

‘স্বরাজ’ আন্দোলন ও মুসলিমদের অনীহা, একে কী স্বাধীনতা আন্দোলন বলা যায় ?

আব্দুস সালাম,টিডিএন বাংলাঃ ভারতীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘স্বরাজ’ কথাটি প্রথম বলেন বালগঙ্গাধর তিলক। বাংলায় তখন বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছে। বাংলার এই আন্দোলনে সক্রিয় ভাবে প্রথম সারিতে দেখা যায় তাকে। তিনি বলেন “স্বরাজ আমার জন্মগত অধিকার, আমি তা অর্জন করবোই।” এরপর ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের অধিবেশনে বালগঙ্গাধর তিলক ‘স্বরাজ’ প্রসঙ্গে বলেন, “নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে আমাদের বিশ্বাস নেই একথা ঠিক নয়, আমরা ইংরেজ সরকারের উচ্ছেদ চাই একথাও ঠিক নয়। কিন্তু রাজনৈতিক অধিকারের জন্য লড়াই করতে হবে। নরমপন্থীরা ভাবেন আবেদন নিবেদন করে এই অধিকার লাভ করবেন। আমরা ভাবি প্রবল চাপ সৃষ্টি করলেই তা পাওয়া যাবে।” একই অধিবেশনে দাদাভাই নওরোজি জাতীয় আন্দোলনের লক্ষ্য হিসাবে স্বরাজ অর্জনের কথা বলেন। অর্থাৎ ‘স্বরাজ’ আন্দোলনের উৎপত্তি হয় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। আর এর লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা অর্জন নয় বরং ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস। কংগ্রেস বা ‘স্বরাজ’ আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ ইংরেজ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ নয় বরং ইংরেজ শাসনের অধীনে থেকেই স্বাধীকার অর্জন অর্থাৎ শাসন ব্যবস্থার উপর ভারতীয়দের নিয়ন্ত্রণের দাবি জানিয়ে ছিলেন।

‘স্বরাজ’ আন্দোলনের প্রবক্তা বাল গঙ্গাধর তিলক এর ব্রিটিশ প্রেম বোঝা যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে তার একটি মন্তব্য থেকে। তিনি বলেন, “অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মীদের মত কোন কোন নীতি সম্বন্ধে এবং কতকটা এমনকি দেশের শাসন ব্যবস্থা সম্বন্ধে বর্তমান গভর্নমেন্ট এর সঙ্গে আমার নিজের মতপার্থক্য রয়েছে। কিন্তু সেই কারণে যদি বলা হয় যে আমার কার্যাবলী বা আমার মনোভাব মহামান্য সম্রাটের গভার্নমেন্টের প্রতি কোন প্রকার শত্রুভাবাপন্ন তাহলে তা অযৌক্তিক হবে।…একথা ঠিকই বলা হয়েছে যে শুধুমাত্র সভ্যতা সম্পন্ন শাসনব্যবস্থা দ্বারাই নয় পড়ন্তু ভারতের বিভিন্ন জাতী ও সম্প্রদায়গুলোকে পরস্পরের নিকটবর্তী করে ভবিষ্যতে এদেশে যাতে একটি একতাবদ্ধ রাষ্ট্র সৃষ্টি করা যায় সেই দিক থেকে ব্রিটিশ শাসন ভারতবর্ষের অপরিমেয় মঙ্গল সাধন করছে। স্বাধীনতা প্রিয় ব্রিটিশ জাতি ছাড়া আমরা যদি অন্য কোন জাতিকে শাসক হিসাবে পেতাম তাহলে তারা যে এই ধরনের এক জাতীয়তাবোধের আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করতে আমাদের সাহায্য করত এ আমি বিশ্বাস করি না। যাদের হৃদয়ে ভারতের মঙ্গল চিন্তা রয়েছে তারা প্রত্যেকেই এ বিষয়ে এবং ব্রিটিশ শাসনের সমতুল্য অন্যান্য উপকারিতা পূর্ণভাবে অবহিত এবং আমার মতে বর্তমান সংকট একটি আশীর্বাদ বিশেষ কারণ এর ফলে আমাদের ব্রিটিশ সিংহাসনের প্রতি আমাদের আনুগত্যের এক সম্মিলিত অনুভব ও চেতনা আমাদের মধ্যে সার্বজনীনভাবে জাগ্রত হয়েছে।” (স্পিচেস অ্যান্ড রাইটিংস অফ বি,জি, তিলক, পৃঃ ৩০১)

কংগ্রেসের ‘স্বরাজ’ আন্দোলনের মূল লক্ষ্য যে স্বাধীনতা অর্জন ছিল না তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের আমেদাবাদ অধিবেশনে। এই অধিবেশনে মাওলানা হরসত মোহানী প্রস্তাব পেশ করেন, “ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের উদ্দেশ্য হচ্ছে ভারতীয়দের জন্য বৈধ ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে বৈদেশিক প্রভাবমুক্ত স্বরাজ বা পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করা।” এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করে গান্ধীজি বলেন, “যে লঘুচিন্তার সঙ্গে আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ এই প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন তা আমাকে দুঃখ দিয়েছেে।…যে জলাশয়ের গভীরতা আমরা জানি না তার মধ্যে আমাদের যাওয়ার দরকার নেই এবং মিস্টার হরসত মোহানীর প্রস্তাব আমাদের সেই গভীরতায় টেনে নিয়ে যাবে যা দূরতিক্রম্য।” (আমেদাবাদ কংগ্রেসের ভাষণ থেকে, ইন্ডিয়ান অ্যানুয়াল রেজিস্টার ভলিউম- ১,১৯২২, পৃষ্ঠা ৩৯৭)

অন্যদিকে মুসলিমরা ভারতে ইংরেজ শাসনের প্রথম লগ্ন থেকেই ইংরেজদের থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতার কথা বলে আসছে। এই উদ্দেশ্যে মুসলিমরা বহুবার বিদ্রোহ সংঘটিত করেছে এবং ইংরেজদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে জড়িয়েছেন। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে খিলাফত কমিটির সম্মেলনে আজাদ সোহানী প্রস্তাব পেশ করেন, “পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনই ভারতীয়দের লক্ষ্য।” অধিকাংশ সদস্যের সমর্থনে এই প্রস্তাবটি পাশ হয়ে যায়। এরপর ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে ১০ ই জুলাই সর্বভারতীয় খিলাফত সম্মেলনে অনুরূপ একটি প্রস্তাব পাস হয়। এরপর ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে সর্বভারতীয় খিলাফত সম্মেলনে মাওলানা মোহাম্মদ আলী বলেন, “আমি আপনাদের সামনে ঘোষণা করছি যে ভারতীয় মুসলিমদের লক্ষ্য হচ্ছে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা। (ইন্ডিয়ান এনুয়‍্যাল রেজিস্টার- ভলিউম ২, ১৯২৮)

যে ‘স্বরাজের’ অর্থ ব্রিটিশরাজের অধীনে থেকে স্বাধীকার বা স্বায়ত্তশাসন সেই আন্দোলনকে আর যাই হোক স্বাধীনতা আন্দোলন তো বলা যায় না। কারণ কোন বৈদেশিক শক্তির অধীনে থেকে কখনো স্বাধীনভাবে শাসনকার্য পরিচালনা তো দূরের কথা স্বাধীনভাবে ধর্মাচরণ বা জীবনযাপনও করা সম্ভব না। কিন্তু গান্ধীজী, দাদাভাই নওরোজি, বালগঙ্গাধর তিলক, চিত্তরঞ্জন দাশ প্রমুখ কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনতা নয় বরং তাদের অধীনস্থ থেকেই স্বরাজের দাবি জানিয়ে ছিলেন। আর ঠিক এই কারণেই মুসলিম নেতৃবৃন্দ ‘স্বরাজ’ আন্দোলন থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন। কারণ তারা বরাবরই বৈদেশিক শক্তির হাত থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে কেউ কেউ স্বরাজ আন্দোলন থেকে মুসলিমদের দূরত্ব বজায় রাখার জন্য তাদেরকে দোষারোপ করেছেন।

তথ্য সূত্র-
১)স্বাধীনতার ফাঁকি- বিমলানন্দ শাসমল,
২) বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস- আব্বাস আলী খান,

Related Articles

Back to top button
error: