HighlightNewsদেশসম্পাদকীয়

তাজমহল মোঘল স্থাপত্য নয় বরং হিন্দু মন্দির! এ দাবি সত্য নাকি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত

আব্দুস সালাম

আমরা জানি মোঘল স্থাপত্যের প্রধান নিদর্শন তথা বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্য তাজমহল উত্তর প্রদেশে আগ্রায় অবস্থিত একটি রাজকীয় সমাধি। ভারত সরকার স্বীকৃত ইতিহাস থেকে জানা যায়, মুঘল সম্রাট শাহজাহান তার স্ত্রী মমতাজ মহলের মৃত্যুর পরেই তাঁর স্মৃতিতে এই অপূর্ব সৌধটি নির্মাণ করেন। কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে হঠাৎ কিছু ডানপন্থী গোষ্ঠী তাজমহল মোঘল স্থাপত্য নয় বরং এটি আদতে একটি হিন্দু মন্দির বলে দাবি করছেন। আর এই দাবিকে সমর্থন করতে দেখা গিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারে আসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতাদের। ডানপন্থী গোষ্ঠীগুলির দাবি তাজমহলের নাম পরিবর্তন করে ‘তেজো মহল’ রাখতে হবে। এমনকি বিজেপি নেতা ভিনয় কাটিয়ার তাজমহলের নাম পরিবর্তন করার দাবি জানিয়েছেন। তাঁর মতে, তাজমহল তৈরি করেছিলেন একজন হিন্দু শাসক। এখানেই শেষ নয় তারা দাবি করছেন তাজমহলের মধ্যে তাদের পূজা করার অনুমতি দিতে হবে। একই সঙ্গে তারা আরও দাবি তুলেছে অবিলম্বে এই সৌধে কোনো মন্দির ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখার জন্য তদন্ত দল গঠন করাতে হবে। উত্তরপ্রদেশের এলাহাবাদ হাইকোর্টে একটি পিটিশন দাখিল করা হয়েছে, যাতে তাজমহলের ‘ইতিহাস’ সম্পর্কে একটি সত্য-অনুসন্ধানী তদন্ত দল গঠনের দাবি করা হয়েছে। আর সবচেয়ে অবাককর বিষয় হচ্ছে ভারতের অধিকাংশ গণমাধ্যমে এই সব দাবি ব্যাপক প্রচার পেয়েছে। যদিও ভারত সরকার এখনও পর্যন্ত ডানপন্থী গোষ্ঠীগুলির এই দাবিকে সমর্থন করেনি।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে তাজমহলের ইতিহাস সম্পর্কে ভারত সরকার স্বীকৃত ইতিহাস কি বলে? সেই ইতিহাস বলে, মুঘল সম্রাট শাহজাহান মূলত তার স্ত্রী মমতাজের সমাধিস্থলে ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে এই সৌধটি নির্মাণ করে ছিলেন। মুসলিম স্থাপত্য শিল্পের অন্যতম নিদর্শন সারা বিশ্বের সর্বত্র প্রশংসিত অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্মটির নির্মাণ শুরু হয় ১৬৩২ সালে। প্রায় ১৭ হেক্টর জায়গাজুড়ে মোগল সাম্রাজ্যের উদ্যানে তাজমহল নির্মাণ করা হয়। যারা পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে যমুনা নদী। এই সৌধটির নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ হয়েছিল প্রায় দীর্ঘ ২১ বছর পর অর্থাৎ ১৬৫৩ খ্রিস্টাব্দে। যদিও এরপরে ছোটখাটো কাজ সম্পন্ন করতে আরও কিছু সময় লেগেছিল। এটি তৈরি করতে খরচ হয়েছিল প্রায় ৩ কোটি ২০ লক্ষ টাকা। যার নির্মাণশৈলীতে পারস্য, তুরস্ক, ভারতীয় এবং মুসলিম স্থাপত্যশিল্পের সম্মিলন বিশেষ ভাবে লক্ষনীয়। তাজমহলকে ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তখন একে বলা হয়েছিল ‘বিশ্ব ঐতিহ্যের সর্বজনীন প্রশংসিত শ্রেষ্ঠকর্ম।’ বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্য হিসাবে তাজমহল এখনও বিশ্বজুড়ে সমাদৃত হয়ে আসছে।

অন্যদিকে ডানপন্থী হিন্দুত্ববাদীরা এই দাবির পক্ষে এখনও পর্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য কোন প্রমাণ উপস্থাপন করেনি। বিজেপি নেতা রজনীশ সিং দাবি করেন, ‘তাজমহল নিয়ে পুরনো বিতর্ক রয়েছে। তাজমহলের প্রায় ২০টি কক্ষ তালাবদ্ধ এবং কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না।’ তিনি দাবি করেন, এসব ঘরে হিন্দু দেবতা ও ধর্ম সম্পর্কিত মূর্তি রয়েছে।’ তিনি হাইকোর্টে পিটিশন দাখিল করেন যাতে আর্কেওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়াকে এই কক্ষগুলি খোলার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। যদিও ব্যতিক্রমী কয়েকজন ছাড়া ইতিহাসবিদরা এই দাবিকে উড়িয়ে দিয়েছেন। ভারতের প্রত্নতত্ত্ব জরিপ বিভাগ তাজমহলকে বর্ণনা করেছে ‘মোগল স্থাপত্যকলার চূড়ান্ত নিদর্শন’ হিসেবে। ভারত সরকারের তাজমহল সংক্রান্ত ওয়েবসাইট লেখা আছে, “ইসলামী স্থাপত্যকলার সঙ্গে ভারতের স্থানীয় স্থাপত্যকলার সংমিশ্রণে গড়ে উঠা সেসময়ের স্থাপত্য রীতির সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহারণ এটি।” ইতিহাসবিদ রানা সাফভি দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “তাজমহলের ইতিহাস নতুন করে লেখার কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। সেখানে যে কখনো কোন মন্দির ছিল তার কোন প্রমাণ নেই। তাজমহল তৈরি হওয়ার আগে সেখানে হিন্দু শাসক জয় সিং এর একটি ‘হাভেলি’ (প্রাসাদোপম বাড়ি) ছিল। শাহজাহান এই হিন্দু শাসক জয় সিং এর কাছ থেকে হাভেলিটি কিনে নেন। এ নিয়ে একটি ‘ফরমান’ জারি করা হয়েছিল। সেটা এখনো আছে।”

এখন প্রশ্ন হচ্ছে এত শতাব্দি প্রাচীন তাজমহল নিয়ে এখন কেন প্রশ্ন তোলা হচ্ছে? যদি সত্যিই এটি মন্দিরের উপরে গড়ে উঠে থাকে বা এটি একটি মন্দির হয়ে থাকে তহলে এত দিন কোনো ভারতীয় ঐতিহাসিক বা ব্রিটিশ আমলের সময়ে কোনো ব্রিটিশ ঐতিহাসিক কেন এই দাবি করেননি? কেন এখন এত শতাব্দি পর এই বিষয়টি সামনে আনা হচ্ছে? আসলে কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে এই বিষয়ে বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে না তো? এই প্রশ্নও তুলেছেন অনেকেই। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, পণ্যদ্রব্যের আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের অভাবে দিশেহারা যুবসমাজ, দেশ জুড়ে একের পর এক বড়ো বড়ো দূর্ণীতি ফাঁশ, দেশময় খুন-ধর্ষন-গুম-মব লিঞ্ছিং- অরাজকতা এসব থেকে জনতার চোখ অন্য দিকে ঘোরাতেই আবারও বিজেপি তার পুরানো অস্ত্র ধর্মকেই হাতিয়ার করতে চাইছে না তো?

Related Articles

Back to top button
error: