সম্পাদকীয়

ভারতবর্ষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো কাশ্মীর–যেখানে কোনদিন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয় নি

সুকৃতিরঞ্জন বিশ্বাস,

সুকৃতিরঞ্জন বিশ্বাস,টিডিএন বাংলা: ‘দি কাশ্মীর ফাইলস’ নামটা শুনে মনে হয়েছিল যে, সিনেমাটি ইংরেজিতে। কিন্তু ভাবলাম— ওটাতো হিন্দিতে হওয়া উচিত, নাহলে বিজেপির লক্ষ্য পূরণ কীভাবে হবে?— ঠিকই ভেবেছিলাম, ওটা হিন্দিতেই, বিজেপি অতটা বোকামি করে নাকি!

শুনলাম ওটাতে নাকি কাশ্মীরি পন্ডিতদের (ব্রাহ্মণদের) উচ্ছেদ ও দুরবস্থার চিত্র চিত্রিত হয়েছে, সাথে মুসলমান-ইসলামের হিংস্রতার কাহিনী!

কারুর বা কোন জনগোষ্ঠীর উচ্ছেদ ও কষ্ট আমাকে পীড়া দেয়। শুধুমাত্র আমাকে কেন, প্রত্যেকটি অনুভূতিপ্রবন মানুষেরই তাই হয়, হওয়া উচিত।

এক্ষেত্রে, মানে এই সিনেমায় মানুষের এই স্বাভাবিক অনুভূতিকে মুসলমান ও ইসলামের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করার চেষ্টা হয়েছে বলে মনে করার কারণ আছে, পন্ডিতদের দুরবস্থার জন্য কাশ্মীরের মুসলমানদের দায়ী করার চেষ্টা হয়েছে—যা সত্য নয়। বরং সত্য ও ইতিহাস হলো এই যে, ভারতবর্ষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো কাশ্মীর—যেখানে কোনদিন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয় নি।

কিছু সন্ত্রাসবাদী, তাদের ধর্মীয় পরিচয় মুসলমান— এই সন্ত্রাসবাদীদের সাথে গোটা মুসলমান সমাজ ও ইসলামকে মিলিয়ে-গুলিয়ে দেবার চেষ্টা হয়েছে এই সিনেমায়, যা ঠিক নয়। কে না জানেন যে, এই সন্ত্রাসবাদীদের শিকার হয়েছেন যারা, তাদের সিংহভাগ মুসলমান মানুষ। সেই সাথে কিছু পন্ডিতরাও অত্যাচারিত হয়েছেন। এটা কোন সাম্প্রদায়িক বিষয় নয়, সম্পুর্ন রাজনৈতিক বিষয়।

এই রাজনৈতিক সমস্যাকে নিয়ে এই সিনেমা ও বিজেপি রাজনীতির সাম্প্রদায়িকরণের চেষ্টা করছে, যা দেশ ও জাতির জন্য আরো ক্ষতির কারণ হবে।

কাশ্মীর সমস্যা হলো একটি কৃত্রিম সমস্যা, এই সমস্যা তৈরি করা হয়েছে এবং এই সমস্যা তৈরি করেছে কংগ্রেস ও কংগ্রেসি সরকার। আর বিজেপি সেই আগুনে ঘি ঢেলে চলেছে। সিপিএম ও বামেরা, সমাজবাদীরা প্রভৃতি প্রায় সকলেই কয়েক দশক ধরে কাশ্মীর সমস্যা জটিলতর করতে ইন্ধন জুগিয়েছে। কোন দল ও নেতা সত্য কথা সোচ্চারে বলেন নি!

একটা কথা বহুকাল খুব চালু হয়েছে। এবারের সিপিএম পার্টি কংগ্রেসও তা বহুল আলোচিত হয়েছে, তা হলো, কট্টর হিন্দুত্ব ও নরম হিন্দুত্ব। কথাটি আংশিক সত্য— পুরো সত্য বা সত্য হলো এই প্রশ্নে আরো আরেকটি দিক আছে, তাহলো লুকানো হিন্দুত্ব! বিজেপি ও কংগ্রেসের বাইরে আর প্রায় সবাই এই অংশের মধ্যে পড়েন। এই সব অংশের চক্করের ফসল হলেন কাশ্মীরি পন্ডিতরা, কাশ্মীর সমস্যা। কাশ্মীরি পন্ডিতদের বা পূর্ববঙ্গ থেকে উচ্ছেদ হওয়া মানুষের সমস্যা নিরসনের জন্য চেষ্টা করার কেউ নেই, ওটা নিয়ে সবাই রাজনীতি করতে চান।

অনুরোধ হলো—আবেগপ্রবণ না হয়ে কাশ্মীরের ইতিহাসটা সবাই জানুন। অনেকেই এই ইতিহাস লিখেছেন, নানা দৃষ্টিকোণ থেকে লিখেছেন, সেগুলি পড়ুন। আমিও সম্ভবত ১৯৯৭ সালে কাশ্মীর নিয়ে ১৫/১৬ পৃষ্ঠার একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র এঁকেছিলাম, লেখাটির নাম ছিল ‘একজন আম্বেদকরবাদীর চোখে কাশ্মীর সমস্যা’, সেটাও পড়ে দেখতে পারেন। দেশের মানুষের কাশ্মীরের ইতিহাসটা জানা দরকার, একমাত্র তাহলেই কাশ্মীর সমস্যা সমাধান করে সেখানকার মানুষের জন্য শান্তি ও সমৃদ্ধি সম্ভব।

আর বলি—কাশ্মীর ফাইলস দেখে কাশ্মীরের পন্ডিতদের জন্য যাদের মন ভারাক্রান্ত, তারা একবার ভারতের দলিতদের দুর্দশা ও তাদের উপর নিরন্তর ঘটে চলা নির্যাতনের চিত্রগুলি স্মরণ করুন, দলিতদের উপর যারা অত্যাচার করেন, সেই মুখগুলি সনাক্ত করুন, তাহলে দেখবেন অনেক সত্য সামনে চলে আসবে!

(লেখকের ফেসবুক ওয়াল থেকে নেওয়া)

Related Articles

Back to top button
error: