আব্দুস সালাম
‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ মুক্তির পর নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের নিয়ে। ১৯৯০ সালের ১৯ জানুয়ারি নিজেদের ভিটেমাটি ছেরে কোনো মতে জীবন নিয়ে পালিয়ে এসেছিলেন তারা। এই দাঙ্গা নিয়ে তর্কবিতর্ক আছে বহু। কে বা কারা ছিল এই দাঙ্গার পিছনে? কারা লাভবান হয়েছে এই দাঙ্গায়? কাশ্মীরের মুসলিম বা কাশ্মীরি পণ্ডিতদের অনেকেই অভিযোগ করেন এই দাঙ্গা ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রনোদিত। লাভবান হয়েছে কেবল রাজনৈতিক শিবির। আর দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সব জাতি ধর্মের সাধারণ মানুষ। আর সাধারণ ভাবে সব দাঙ্গার ক্ষেত্রেই দেখা যায় কিছু স্বার্থান্বেশী ব্যক্তি বা গোষ্টি নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করতেই সমাজের দাঙ্গা ফ্যাসাদ সৃষ্টি করেন। আর এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সব শ্রেণীর মানুষ। আর লাভবান হয় কেবল ওই সঙ্কীর্ণ স্বার্থন্বেষী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী।
সেই আলোচনা না হয় বাদ দেওয়া যাক। ১৯৯০ সালের পর অতিবাহিত হয়েছে ৩২টি বছর। আজ আমরা উপনীত হয়েছি ২০২২ সালে। এই ৩২ বছরের মধ্যে কেন্দ্র ও রাজ্যে এসেছে বহু সরকার আবার তাদের পতনও হয়েছে। কিন্তু আজও পর্যন্ত কেন কাশ্মীরে পণ্ডিতদের ফেরা হলো না তাদের আপন ঘরে? কেন আজও তাদের শরণার্থী জীবনই অতিবাহিত করতে হচ্ছে? এর জন্য কে বা কারা দায়ী?
বিভিন্ন কারণে ১৯৮৬ সালে গুলাম মহম্মদ শাহের সরকারকে বরখাস্ত করে প্রথমবারের জন্য কাশ্মীরে শুরু হয় রাষ্ট্রপতি শাসন। ১৯৮৭ সালে সালের বিধানসভা নির্বাচনের পর পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে থাকে। এরপর ১৯৯০ সালে শুরু হয় দাঙ্গা। এই দাঙ্গার ফলে ঘর ছাড়া হওয়া কাশ্মীরি পন্ডিতদের ঘরে ফেরা নিয়ে ৩ দশক ধরে কেবলই চলেছে রাজনৈতিক বাক-বিতণ্ডা। বিজেপি এর জন্য কাঠগড়ায় তুলতে চেয়েছে কংগ্রেসকে। আবার কংগ্রেস পাল্টা প্রশ্ন তুলেছে সেই সময় ভিপি সিং সরকারে ছিল বিজেপির ৮৫ জন সাংসদ। তাঁরা কেন এর দায়ে সরকার ফেলার চেষ্টা করেননি বা সরকার থেকে বেরিয়ে আসেনি?
এই প্রসঙ্গে জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ বলেন, “যখন কাশ্মীরি পণ্ডিতদের সঙ্গে এমন দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটে। ফারুক আবদুল্লা তখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন না। জগমোহন তখন রাজ্যপাল ছিলেন। কেন্দ্রে ভি পি সিংয়ের সরকার ছিল। যাকে বিজেপি সমর্থন করেছিল।’ অর্থাৎ কাশ্মীরে তখন রাজ্যপাল শাসন চলছিল। সে কথা না হয় ছাড়ুন কেন্দ্রে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আছে প্রায় ৮ বছর হয়ে গিয়েছে। কিন্তু নিজেদের হিন্দু জাতির রক্ষক হিসাবে পরিচয় দেওয়া বিজেপি সরকারের আমলেও এখনও পর্যন্ত কেন পুনর্বাসন পাননি কাশ্মীরি পণ্ডিতরা সেই প্রশ্ন তুলেছে বিরোধী রাজনৈতিক দল গুলো। তাদের প্রশ্ন ২০১৯ সালে সংবিধানের ৩৭০ ধারা তুলে নেওয়া হয়েছিল। তারপরও কেন হল না ঘরছাড়া মানুষদের ঘরে ফেরা?
বিরোধী রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে বিভিন্ন সমাজকর্মী ও মানবাধিকার কর্মীরা অভিযোগ করেছেন বিজেপি বা আরএসএস কেউই চায় না কাশ্মীরি পন্ডিতরা প্রকৃত সুবিচার পাক। তারা ফিরে যাক তাদের নিজের ঠিকানায়। শেষ হোক তাদের শরণার্থী জীবনের। তারা কেবলই কাশ্মীরি পন্ডিত ইস্যুটিকে সামনে এনে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে চাইছে। এমনকি কাশ্মীরি পণ্ডিতদের একাংশও অভিযোগ করেছেন বিজেপি কাশ্মীরি পন্ডিত ইস্যুটিকে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে। ‘কাশ্মীর ফাইলস’ এর মতো সিনেমা করে তারা কেবল জনপ্রিয়তা পেতে চায়। কিন্তু এভাবে কখনোই কাশ্মীরি পণ্ডিতদের প্রকৃত সমস্যা দূর করা যাবে না। হবে না কোনো সমাধান। বরং এতে বৃদ্ধি পাবে সাম্প্রদায়িক হিংসা নষ্ট হবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। বন্ধ হবে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ঘরে ফেরার শেষ আশা টুকুও। তারা অভিযোগ করেছেন কেন্দ্র সরকার চাইলে বহু আগেই কাশ্মীরে পণ্ডিতদের তাদের ঘরে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারতো। কিন্তু এ বিষয়ে তাদের কোন সদিচ্ছাই চোখে পড়ছে না।
এ প্রসঙ্গে কাশ্মীরি পণ্ডিত শিবানী ধর সেন জানান ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ দেখবেন না। তাঁর কথায়, “ঘৃণা ছড়াতে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ইতিহাসকে ব্যবহার করা বন্ধ হোক।” উপত্যকায় পণ্ডিতদের স্বার্থ নিয়ে লড়াই করা কাশ্মীরি পণ্ডিত সংঘর্ষ সমিতি’ নামে একটি সংগঠনের সদস্য সঞ্জয় টিকু বলেন, ”কিছু লোক এই ছবি দেখিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে চায়। তাদের অঙ্গুলিহেলনেই ছবিটি তৈরি করা হয়েছে। ওরা চায় এখন উপত্যকায় যে সব পণ্ডিত রয়েছেন, তাঁদেরও হত্যা করুক জঙ্গিরা।”
সোম্যা লাখানি নামে অপর এক জনৈক কাশ্মীরি পণ্ডিতের এই সিনেমা প্রসঙ্গে বলেন, ”এই সিনেমা শিল্প নয়, প্রচার। শিল্প ও প্রচারের সূক্ষ্ম ফারাক আছে। সেই পার্থক্যটা বোঝা জরুরি।”