HighlightNewsরাজ্য

রক্ত সংকট মেটাতে রোজা রেখেই মুমূর্ষদের রক্ত দিতে হাসপাতালে ছুটছেন রোজাদাররা

নিজস্ব প্রতিনিধি, টিডিএন বাংলা, নদীয়া: রোজার মাস পড়তেই রাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালে শুরু হয়েছে তীব্র রক্ত সংকট। ফলে সমস্যায় পড়ছেন রোগী ও পরিজনরা। এই মাসে সেইভাবে রক্তদান শিবিরও হয়না। যার কারণে প্রতি বছরেই এই দুর্ভোগ পোহাতে বলে জানাচ্ছেন বিভিন্ন ব্লাড ব্যাংকের কর্মীরা। তেহট্ট ব্লাড ব্যাংকের মেডিকেল অফিসার ইনচার্জ রামচাঁদ মুর্মু বলেন, রোজার মাসে ক্যাম্প না থাকায় ব্লাড ব্যাংকে রক্তের সংকট দেখা দিচ্ছে। অনেক ডোনার আসছেন যারা রোজা অবস্থায় রক্ত দিচ্ছেন। সংকট মেটাতে আমাদের কর্মীরাও এগিয়ে আসছেন।’

ঘটনা-১

মুর্শিদাবাদের ডোমকলের একটি বেসরকারি নার্সিংহোমে সিজার করে সন্তান প্রসব করেন ইসলামপুরের মৌসুমী খান। সেখানে রোগীর অবস্থা অত্যন্ত সঙ্কটজনক হলে রবিবার রাত ন’টা নাগাদ তাকে আনা হয় ডোমকল সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে। ডাক্তার জানান ইমার্জেন্সি তিন ইউনিট ও-পজিটিভ রক্ত লাগবে। খবর পেয়ে রাতেই ডোনারের তালিকা ধরে রক্তের খোঁজ শুরু করেন রক্তদানে যুক্ত ‘মানব কল্যানে রক্তদান’ সংস্থার সদস্য পিন্টু মন্ডল। তার ডাকেই এদিন রাতে ডোমকল ব্লাড ব্যাংকে রক্ত দিতে ছুটে যান বালিরঘাটের মুরসেলিম সেখ, ইসলামপুরের রহিত মন্ডল ও ডোমকল পঞ্চাননপুরের সুজাউদ্দিন মন্ডল নামে তিন যুবক। রক্তদাতারা জানিয়েছেন, তারা সকলেই রোজায় ছিলেন। সারাদিন উপোসের পর সন্ধ্যায় ইফতার শেষে শরীরে অনেকটাই ক্লান্তি আসে। তবুও কিভাবে এই রক্ত দান? উত্তরে সুজাউদ্দিন মন্ডল বলেন, ‘মানুষের প্রাণ বাঁচাতে ইসলামে রক্তদানে ব্যাপকভাবে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে, রোজা অবস্থায়ও রক্ত দেওয়া যায়। আর আমরা সেটাই করেছি। আগামীতেও করব। এটা আমার ষষ্ঠ রক্তদান।’

পিন্টু মন্ডল জানান, ‘ইফতারের পর সবে একটু জিরিয়ে নিচ্ছি এমন সময় ডাক্তার বাবুর ফোন এল ইমার্জেন্সি তিন ইউনিট রক্ত লাগবে। ফোন করে ডোনারদের ব্লাড ব্যাংকে নিয়ে গিয়ে রক্ত টানিয়ে রাত বারোটায় বাড়ি ফিরি।’ চিকিৎসক আবু তালহা জানিয়েছেন, ‘এই রক্ত সংকটের সময়ে সময়মত রক্তটা পাওয়া না গেলে মুশকিল হত। বাচ্চা ও মা দুজনেই এখন সুস্থ আছে।’

ঘটনা-২

নদিয়ার তেহট্ট মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি তেহট্টের বক্সিপুরের ক্যানসার আক্রান্ত কৃপাময়ী মন্ডল। কেমোর জন্য প্রয়োজন পড়ে তিন ইউনিট বিরল গ্রূপের বি- নেগেটিভ রক্তের। কদিন আগে বনগাঁ হাসপাতাল থেকে এক ইউনিট জোগাড় করেন পরিজনেরা। কিন্তু গত তিনদিন ধরে কোথাও বাকি দুই ইউনিট জোগাড় করতে পারছিল না তারা। খবর পেয়ে রবিবার রোজা অবস্থায় তেহট্ট মহকুমা হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকে গিয়ে রক্ত দেন পাগলাচন্ডীর একটি বেসরকারি নার্সিংহোমে কর্মরত নার্স মুর্শিদা খাতুন। বছর ছাব্বিশের মুর্শিদার বাড়ি মুর্শিদাবাদের দৌলতাবাদ এলাকায়। ওই নার্স জানান, ‘প্রতি বছর রোজার মাসে রক্ত সংকট দেখা যায়। রোজা রেখেই রক্ত দিলাম কোন অসুবিধা হয়নি। একজন মুমুর্ষ রোগীর পাশে দাঁড়াতে পেরে নিজেকেও খুব ভাল লাগছে।

রোগীর নাতি সুমন মন্ডল জানান, ‘ঠাকুমার বিরল গ্রূপের বি- নেগেটিভ রক্তের জন্য অনেক হয়রানি শেষে ইবিএস এর ওসমান গনি খাঁন ভাইয়ের মাধ্যমে মুর্শিদা খাতুনের খোঁজ পায়। তিনি রোজা অবস্থায় থেকেও হাসপাতালে এসে রক্তটা দিয়েছেন। উপরওয়ালার কাছে প্রার্থনা ওই দিদির যেন ভালো করেন।’

ঘটনা-৩

মুর্শিদাবাদের ডোমকল কামুড়দিয়াড়ের এর বাসিন্দা পান্নাহীরা খাতুন তিন দিন আগে ভর্তি হয় ডোমকলের একটি বেসরকারি নার্সিং হোমে। বি- পজিটিভ রক্তের অভাবে আটকে ছিল অপারেশন। খবর পেয়ে এগিয়ে আসে রক্তদানে যুক্ত সংস্থা ‘প্রত্যাশা ফাউন্ডেশন’। সোমবার নদিয়ার থানারপাড়া থানার নতিডাঙা থেকে ওই মহিলাকে রোজা থাকা অবস্থায় রক্ত দেয় ইসরাফিল মালিথ্যা নামে বছর পঁচিশের এক যুবক।

ঘটনা-৪

রমযানের প্রথম দিনেই রোজা অবস্থায় নদিয়ার কল্যাণী জেএনএম হাসপাতালে ভর্তি বছর চল্লিশের মুমুর্ষ অঞ্জলি বিশ্বাসকে রক্ত দেন মদনপুরের বাপন আলী মন্ডল। আর এভাবেই এই ভয়াবহ রক্ত সংকটের মুহূর্তে বিভিন্ন মুমুর্ষ রোগীদের রক্ত দিয়ে মানব সেবার পাশাপাশি সম্প্রীতির অনন্য নজির গড়ে চলেছেন রোজাদাররা।

ঘটনা: ৫

সুস্থ শরীরে রোজা রেখেও রক্ত দেওয়া যায়, ইসলাম একাজে ব্যাপক উৎসাহ দেয়। এই বার্তাকে সকলের মাঝে পৌছিয়ে দিতে আজ বন্ধুর মাধ্যমে খবর পেয়ে কলকাতার কমান্ড হাসপাতালে রক্ত দিতে ছুটে যান ওয়েলফেয়ার পার্টির সদস্য আবু তাহের আনসারী। এদিন তিনি ক্যান্সারাক্রান্ত মনোজ ঝা কে এক ইউনিট এ পজিটিভ রক্ত দেন। রোগীর ছেলে একজন ভারতীয় বায়ু সেনা বাহিনীর অফিসার। তিনি এই দুর্দিনে আবু তাহেরের মানবতায় মুগ্ধ। আর এভাবেই এই ভয়াবহ রক্ত সংকটের মুহূর্তে বিভিন্ন মুমুর্ষ রোগীদের রক্ত দিয়ে মানব সেবার পাশাপাশি সম্প্রীতির অনন্য নজির গড়ে চলেছেন রোজাদাররা।

Related Articles

Back to top button
error: