নিজস্ব প্রতিনিধি, টিডিএন বাংলা, নদীয়া: তাঁত মানেই শান্তিপুর। শুধু এরাজ্যেই নয়, ওপার বাংলা সহ সারা দেশেই সমানভাবে সমাদৃত শান্তিপুরের তাঁত।
শনিবার ছিল জাতীয় হস্তচালিত তাঁত শিল্প দিবস। কিন্তু সেই তাঁত শিল্পের আজ রুগ্ন দশা, শিল্পীর অবস্থা করুণ।
ঐতিহ্যবাহী শান্তিপুরের চাকরিজীবি ও ব্যবসায়ী শ্রেনীদের বাদ দিলে কমবেশি প্রায় সকলেই তাঁত শিল্পের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু সেই শিল্পে এখন দেখা দিয়েছে মন্দা। সুতোর দাম বাড়লেও বাড়েনি মজুরি ও শাড়ির দাম। ফলে লাভের মুখ দেখতে পাচ্ছেন না শিল্পীরা। ফলে তাঁত ছেড়ে অনেকেই বিকল্প আয়ের কথাও ভাবছেন। কেউ কেউ পাড়ি দিচ্ছেন ভিন রাজ্যেও।
এদিকে দিনের পর দিন বিধিনিষেধের জেরে মহাজনরাও বাজারের পরিস্থিতির উপর নজর রেখে বাধ্য হচ্ছে কাজকর্মের পরিধি ছোট করতে। অন্যদিকে সুতোর দাম বাড়ায় শাড়ির বাজারে দেখা দিয়েছে মন্দা।
তাঁতিরা জানাচ্ছেন, আগে যে শাড়ি তৈরি করতে ১০০ টাকা মজুরি মিলতো এখন মিলছে ৭০ টাকা। একজন তাঁতি গড়ে দৈনিক ৩ টি শাড়ি তৈরি করতে পারে। সেক্ষেত্রে তার মজুরি দাঁড়ায় ২১০ টাকা। এই মজুরির উপর আবার বিদ্যুৎ সহ অন্যান্য খরচও আছে। সেই সাথে আছে সমিতির ঋণ। ফলে মূল্যবৃদ্ধির বাজারে একজন তাঁতি কিভাবে পরিবারের খাদ্য, শিক্ষা ও চিকিৎসার খরচ বহন করবে সেই চিন্তায় ঘুম ছুটেছে তাঁতিদের।
এই দুরাবস্থা যে শুধু তাঁতিদের একার তাই নয় বরং শাড়ি তৈরির সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত সকলেই ভুক্তভোগী বলে জানাচ্ছেন স্থানীয় শাড়ি ব্যবসায়ী রুহুল কুদ্দুস মন্ডল। তিনি জানান, প্রতি শাড়ি পিছু সুতোর দাম কমপক্ষে ৪০ টাকা বেড়েছে। মহাজনদের সমস্ত খরচ বাদ দিয়ে শাড়ি পিছু লাভ থাকত ২০-২৫ টাকা। সেক্ষেত্রে কেবলমাত্র সুতোর দাম ৪০ টাকা বেড়েছে কিন্তু শাড়ির দাম না বাড়ায় বাজারে চরম ধ্বস নেমেছে। ফলে ক্ষতি হচ্ছে ব্যবসায়।
কলেজ পড়ুয়া তাঁত শিল্পী মহম্মদ নাজিরউদ্দিন এর বাড়িতে গিয়ে এই প্রতিনিধি দেখেন, বন্ধ পড়ে রয়েছে তার তাঁত। তিনি জানান, এই তাঁতের উপর নির্ভর করেই আমার পড়াশুনা চলত। এখন মহাজনরা শাড়ি বিক্রি করতে পারছে না বলে সুতোও দিচ্ছে না। ফলে দিন আনা দিন খাওয়া সংসারে এখন কি যে করবো ভেবে পাচ্ছিনা। তাই অন্য কোন রোজগারের কথা ভাবছি।
তাঁতিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, গত দুই ঈদে সন্তানদের একটি নতুন জামা পর্যন্ত কিনে দিতে পারেনি বহু পরিবার। আসছে দুর্গাপুজোও। সেক্ষেত্রেও অনেক বাবা মা-ই সন্তানের মুখে হাসি ফোটাতে পারবেনা তা বোঝাই যাচ্ছে।
শান্তিপুরের কাপড়ের মহাজন কিয়ামত আলী সেখ জানান, ‘সারা বছর কাজ করা তাঁতিদেরও মুখের দিকে তাকাতে হচ্ছে আবার এদিকে জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া হওয়ায় শাড়ি পিছু আসল টাকা ঘরে তোলায় এখন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কখনো কখনো ৫-৭টাকা লোকসানেও বিক্রি করতে হচ্ছে শাড়ি।’
শুভ কর নামে এক তাঁত শিল্পী বলছেন, ‘মেশিন গুলি পড়ে থেকে থেকে জং ধরে গেল। কিন্তু পেট তো আর থেমে থাকে না। তাই শ্রমিকের কাজে ভিন রাজ্যে যাওয়া ছাড়া আর উপায় দেখছিনা।’ বাপ্পা মন্ডল নামে আরেক তাঁতী জানাচ্ছেন, দুঃখের বিষয় প্রতেক জিনিসের দাম আকাশ ছোঁয়া। কিন্তু সকল কাজের মজুরী কিছু না কিছু বাড়ছে। আর আমরা এমন হতভাগা তাঁত শ্রমিক যে দিনে দিনে মজুরি তলানিতে নামছে।’ রাজু মন্ডলের বক্তব্য, সরকারের কাছে আবেদন, অনুগ্রহ করে তাঁত শিল্পের রুগ্ন অবস্থার দিকে নজর দিন, তাঁতিদের বাঁচান।
স্থানীয় শানোয়াজ আলী বলছিলেন, তাঁত একটি কুঠীর শিল্প যেটা হস্তচালিত। তা এখন যন্ত্রচালিত হয়ে গেছে, যার ফলে এর ৭০-৮০% শিল্পীই কর্মহীন হয়ে পড়েছেন তারা ভিন রাজ্য পাড়ি দিয়েছেন।
যেখানে হস্তচালিত তাঁতের মান অনেক উন্নত ছিল, তা যান্ত্রিক তাঁতে ততটা ভালো হয়না। এবং যেখানে প্রতিদিন একজন তাঁতী বহু কষ্টে একটা শাড়ি তৈরি করতে পারতো, এখন অনেক বেশি করতে পারছে। এ করে উৎপাদন অতিরিক্তি হচ্ছে। সেই অনুপাতে বিক্রি নেই, কমেছে কাপড়ের মানও।