ভারতে ভ্যাকসিনের আকাল ও মৃত্যু মিছিল কেন্দ্রীয় সরকারের তুঘলকি পনার পরিনাম
মুহাম্মাদ নূরুদ্দীন: আমাদের দেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা বিশ্বের সকল দেশকে ছাড়িয়ে গেছে। গোটা বিশ্বের করোনা মৃত্যুর মিছিলে ভারত এখন শীর্ষে। দিল্লী, উত্তরপ্রদেশ, বিহারসহ গোটা দেশে ভয়ংকর অবস্থা। শ্মশানে ঠাই নেই। কবরগুলি উপচে পড়ছে লাশের ভীড়ে।
কেন এমনটা হল? যে দেশ সারা পৃথিবী জুড়ে দাবি করে আসছে যে তারা করোণা মহামারীর মোকাবেলায় সামনের সারিতে অবস্থান করছে। যে দেশে প্রধানমন্ত্রী দাবি করেছেন যে তার দেশ করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেছে এবং যে দেশের সরকারের স্লোগান আত্মনির্ভরশীল ভারত বর্ষ। যে দেশের সরকার বারবার দাবি করেছে যা “আমরা শুধু আমাদের প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন উৎপাদনে সক্ষম নই বরং আমরা অনেক দুর্বল দেশকে করোনা মোকাবেলার ভ্যাকসিন দিয়ে সাহায্য করতে পারব” সেই দেশ করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের কাছে কেন এমনভাবে আত্মসমর্পণ করলো? কেন গঙ্গার জলে বইছে মৃত মানুষের লাশ? কেন শ্মশান গুলিতে ঠাই না পেয়ে গঙ্গার বালির মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে হচ্ছে হাজার হাজার লাশ? কেন সেই লাশ ভেসে গঙ্গাকে দূষিত করছে, মানবতাকে অপমানিত করছে, গোটা দুনিয়া জুড়ে ভারতবর্ষের নগ্নচিত্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে?
গত মাসের হিসাবে দেখা গিয়েছে যেখানে আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলো তাদের জনসংখ্যার কোথাও অর্ধেক কোথাও তার থেকে বেশি নাগরিককে ভ্যাকসিন দিতে সক্ষম হয়েছে ইংল্যান্ড ইতালির মতো দেশগুলো তাদের সকল নাগরিককে ভ্যাকসিন দেওয়ার কাজ সম্পন্ন করেছে সেই ক্ষেত্রে আমাদের দেশ ভারতবর্ষে এখনো পর্যন্ত কত শতাংশ মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়া সম্ভব হয়েছে?
৭ এপ্রিল ২০২১ স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষবর্ধন এন ডি টিভিতে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় দাবি করেন যে ভ্যাকসিন উৎপাদন এবং সরবরাহের ক্ষেত্রে কোনো দুর্বলতা নেই। ৪৫ বছরের উপরের কোন ব্যক্তি ফোন করে যোগাযোগ করলেই ভ্যাকসিন পেয়ে যাবেন।
১৩ মে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সিরাম ও ভারত বায়োটেক দুটি কোম্পানিতে সফর করেন। সেখানে তিনি ভাষণ দেন। তাঁর সামগ্রিক উপস্থাপনা থেকে এটা সহজেই উপলব্ধি করা যায় যে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ভারতে করোনা ভ্যাকসিন তৈরি হচ্ছে।
দাভোসে বক্তব্য রাখার সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, “ভারত দুটি টীকার বিনিময়ে মানবতার সেবা করছে।”
২৮ জানুয়ারি ২০২১ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ” আজ ভারত দুটি টিকা তৈরি করে গোটা দুনিয়ায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য ইনফ্রাস্ট্রাকচার তৈরি করে মানবতার সেবা করছে।” তাঁর এই বক্তব্য শুনে সকলেই খুব খুশি হন। প্রধানমন্ত্রী আরও জানান, “এখন তো মাত্র দুটি মেড ইন ইন্ডিয়া ভ্যাকসিন বাজারে এলো। এরপর ভারত আরো ভ্যাকসিন নিয়ে আসবে এবং গোটা বিশ্বব্যাপী ভারত মানবতার সেবা করার কাজ চালিয়ে যাবে।
গীতা প্রকল্প উদ্বোধন করার সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, “আমাদের বিজ্ঞানীগণ কঠোর পরিশ্রম করে অতি দ্রুততার সঙ্গে ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেছে এবং এখন ভারতবর্ষে অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে গোটা বিশ্বকে ভ্যাকসিন সরবরাহ করতে সক্ষম হয়েছে। আর গীতা আমাদেরকে সততা ও সেবার আদর্শ শিখিয়েছে।”
কথায় বলে, “পাপ বাপকেও ছাড়ে না। আমাদের দেশের রাজনীতিতে মিথ্যাচার এতই গা সওয়া হয়ে গিয়েছে যে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন তুলতে ভুলে গিয়েছে মানুষ। ভুল তথ্য সরবরাহ, ফাঁকা আওয়াজ এবং কাজ না করে কৃতিত্ব নেওয়ার বাহাদুরি খুবই ভয়ঙ্কর। ভারতে করোণা মহামারীর এই যে অবস্থা তার পিছনে অনেকটাই আমাদের দেশের সরকার ও শাসক দলের নেতাদের তুঘলকি পনাই দায়ী। শুধুমাত্র ভাষণ দিয়ে, চটকদারি বাহাদুরি কুড়িয়ে যে কোন মহামারী মোকাবেলা করা যায় না সেটা আরো একবার চোখে আঙুল দেখিয়ে দিল করোনার দ্বিতীয় ঢেউ।
ভারত দাবি করেছে তাদের দেশের বিজ্ঞানীগণ অত্যন্ত পরিশ্রম করে ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেছেন। কিন্তু প্রকৃত সত্য কি তাই? এ পর্যন্ত করোণা ভাইরাসের কার্যকরী ভ্যাকসিন কোভি শিল্ড। তথ্য বলছে, ভারতীয় বিজ্ঞানীগণ নয় বরং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক এক্সট্রা জেনেকার এর নেতৃত্বে সেখানকার চিকিতসকগন ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেছেন। গার্ডিয়ান পত্রিকা এই সংবাদ প্রকাশ করে জানায় যে এই ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পিছনে মূলত বৃটেনের নাগরিকদের কর থেকে অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। বৃটেনের ওয়েলকাম ট্রাস্ট এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক সংস্থা এই ভ্যাকসিন আবিষ্কারে উৎসাহিত করেছে এবং প্রয়োজনীয় অর্থ সরবরাহ করেছে। কোভি শিল্ডের ‘ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইট’ এক্সট্রা জেনেকার নামে।
স্ভাবাভাবিক ভাবে প্রশ্ন জাগে যদি ভারতিয় বিজ্ঞানী ভ্যাকসিন আবিষ্কার করে থাকেন তাহলে সেই বিজ্ঞানীর নাম কী? তিনি কী ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেছেন? সে ই ভ্যাকসিন কোথায় তৈরি হয়? এবং কী কাজে লাগে?
ভারতে অবস্থিত দুটি কোম্পানি ভ্যাকসিন উৎপাদন করছে বলে জানা যায়। ‘সিরাম ইন্সটিটিউট’ ও ‘ভারত বায়োটেক কোম্পানি’। এরা ঔষধ প্রস্তুতকারক সংস্থা মাত্র। তাও ভারত বায়োটেকের গূনমানের বিষয়ে ইতি মধ্যে প্রশ্ন উঠতে সুরু করেছে। তারপরও বলতে হয় এটা আমাদের গর্বের বিষয় যে আমাদের দেশের দুইটি কোম্পানি ভ্যাকসিন উৎপাদন করার দায়িত্ব পেয়েছে। কিন্তু উৎপাদনকারী সংস্থাতো উৎপাদন করে মাত্র। যারা তাদেরকে অর্ডার দেন বা কোন চুক্তি করেন সেই চুক্তি মোতাবেক উৎপাদিত সামগ্রী সরবরাহ করার দায়িত্ব উৎপাদনকারী সংস্থা গুলির হয়ে থাকে।
প্রশ্ন হল, ‘সিরাম’ এবং ‘ভারত বায়োটেক কোম্পানি’ ভ্যাকসিন উৎপাদন করলে তা কী আমাদের দেশের হয়ে যাবে? আমাদের দেশে উৎপাদিত হচ্ছে বলেই কি তা আমরা ব্যবহার করতে পারব? প্রশ্ন থেকেই যায়। অনুসন্ধান করলে জানা যাবে যে এই দুটি কোম্পানি বিভিন্ন বাইরের দেশ থেকে ভ্যাকসিন উৎপাদনের অর্ডার সংগ্রহ করে। কোন কোন দেশ থেকে তারা কাঁচামাল সংগ্রহ করে যে সকল দেশ তাদেরকে কাঁচামাল সরবরাহ করে সহযোগিতা করেছে তাদের সঙ্গে চুক্তি হয় তাদেরকে তারা ভ্যাকসিন সরবরাহ করবে। আর যে সকল দেশ অগ্রিম অর্থ দিয়ে ভ্যাকসিন বুক করেছে তাদেরকে তারা ভ্যাকসিন সরবরাহ করবে।
কিন্তু তথাকথিত আত্মনির্ভরশীল ভারতবর্ষের সরকার কি বলতে পারবেন যে এই দুটি সংস্থাকে অগ্রিম কত টাকা দিয়ে ভারত সরকার ভ্যাকসিন তৈরি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন? যদি কোন বাইরের দেশ আমাদের দেশের কোন কোম্পানিকে অর্ডার দিয়ে মাল তৈরি করে নেন তাহলে সেটা আমাদের দেশের জন্য একদিকে গর্বের আর একদিকে হতাশার ও লজ্জার। যদি আমাদের দেশের সরকার এই সকল কোম্পানিগুলোকে কাজে লাগিয়ে আমাদের দেশে প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন সরবরাহ করতে পারতেন এবং আরও অতিরিক্ত উৎপাদন করে সেই ভ্যাকসিন বাইরে সরবরাহ করতে পারতেন তাহলে সেটা হতো আমাদের গর্বের। কিন্তু বিদেশী সংস্থাগুলি আমাদের দেশের কোম্পানিকে ব্যবহার করে তারা তাদের দেশের ভ্যাকসিন আমাদের দেশ থেকে উৎপাদন করে নিয়ে যাচ্ছেন অথচ ভারতবর্ষের জনগণ ভ্যাকসিনের অভাবে মৃত্যুর মিছিলে পরিণত হচ্ছেন এটা কি লজ্জার নয়?
অবশ্য প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু ভ্যাকসিন নিয়ে আমাদের দেশ কাজ শুরু করেছে মাত্র। তারপর প্রবল চাপের মুখে পড়ে সরকার অন্য দেশ থেকে ভ্যাকসিন নেওয়ার বাপারে সম্মতি জানান। যারা গোটা দুনিয়ায় ভ্যাকসিন সরবরাহ করার ব্যাপারে প্রচার চালাচ্ছিল এবং নিজেদেরকে বড় দাতা হিসেবে আত্মশ্লাঘা অনুভব করছিল তারা এখন ভিন দেশ থেকে ভ্যাকসিন সরবরাহ করার চেষ্টায় রত।
সততা ও সেবার উদাহরণ দিতে গিয়ে বারবার গীতার প্রসঙ্গ টানা হয়েছে। আমরা কখন ভ্যাকসিন তৈরি করে অন্য দেশকে সাহায্য করলাম? যদি কাউকে সাহায্য না করে সাহায্য করার দাবি করা হয় তাহলে তার নাম কি সততা? আজকের ভারতে যে মহামারী মহা বিপর্যয় দেখা দিয়েছে তার মূলে আছে অনেক প্রশ্ন। এই ধরনের ধোকা ও প্রতারণার ধুম্রজাল আমাদের দেশের জনগণকে এক সংঘাত-সংকটের মধ্যে নিক্ষেপ করেছে। আর সেই সংকটের সামগ্রিক পরিণতিতে বিধ্বস্ত হয়ে যাচ্ছে এদেশের মানুষের জীবন। গঙ্গার তীরে লাশের মিছিল তার সামান্য একটি চিহ্নমাত্র।