HighlightNewsদেশসম্পাদকীয়

রাষ্ট্রদ্রোহ আইন কি এবং কেন সুপ্রিম কোর্টের নয়া নির্দেশ একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত?

দেবিকা মজুমদার

বুধবার একটি ঐতিহাসিক নির্দেশে সুপ্রিম কোর্ট রাষ্ট্রদ্রোহ আইন আপাতত স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়েছে। শীর্ষ আদালত জানিয়েছে, ভারতীয় দন্ডবিধির ১২৪ এ ধারার অধীনে ১৫২ বছরের পুরনো রাষ্ট্রদ্রোহ আইন কার্যকরভাবে স্থগিত রাখা উচিত যতক্ষণ না কেন্দ্র সরকার এই বিষয় নিয়ে বিবেচনা করছে। একটি অন্তর্বর্তী আদেশে আদালত কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারগুলিকে পুর্নবিবেচনার অধীনে থাকাকালীন উল্লিখিত বিধানের অধীনে কোনো এফআইআর নিবন্ধন করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে। যতদিন না কেন্দ্র সরকার এই আইন সম্পর্কে তাদের পুনর্বিবেচনা ও পুন:পরীক্ষা করার প্রতিশ্রুতি অনুশীলন সম্পন্ন করছে ততদিন কেন্দ্র ও রাজ্যগুলিকে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪এ-এর অধীনে অভিযোগ গঠনের বিষয়ে সমস্ত মুলতুবি বিচার, আপিল এবং কার্যধারা স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়েছে শীর্ষ আদালত। উল্লেখ্য, কেন্দ্র সরকার প্রথমে এই ঔপনিবেশিক আইনকে রক্ষা করার পক্ষে মত দিলেও পরে শীর্ষ আদালতের কাছ থেকে নিজেদের মতামত পুনর্বিবেচনা করার জন্য সময় চেয়ে নেয়।

এ প্রসঙ্গে আমাদের জেনে নেওয়া প্রয়োজন সংবিধানের ১২৪ এ ধারায় কি বলা রয়েছে। ঔপনিবেশিক সময় থেকে চলে আসা সংবিধানের ওই ধারায় বলা হয়েছে, “যদি কেউ কথার দ্বারা, কথিত বা লিখিত বা চিহ্ন দ্বারা বা, দৃশ্যমান উপস্থাপনা দ্বারা কিংবা, ঘৃণা বা অবমাননা হানার চেষ্টা করে বা উত্তেজিত করে অথবা অসন্তোষ উদ্দীপিত করার চেষ্টা করে তাহলে সরকারের প্রতি আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত আজীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে যার সাথে জরিমানা যোগ করা যেতে পারে।”

এই বিধানের তিনটি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। প্রথমত, “অসন্তোষ” শব্দটি ও বিশ্বস্ততা এবং শত্রুতার সমস্ত অনুভূতিকে অন্তর্ভুক্ত করে। দ্বিতীয়ত, উত্তেজনাপূর্ণ বা ঘৃণা, অবমাননা বা অসন্তোষকে উত্তেজিত করার চেষ্টা না করে আইনানুগ উপায়ে তাদের পরিবর্তন করার লক্ষ্যে সরকারের পদক্ষেপের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করে মন্তব্য করা এই ধারার অধীনে অপরাধ বলে গণ্য হয় না। তৃতীয়ত, উত্তেজনাপূর্ণ বা ঘৃণা, অবমাননা বা অসন্তোষকে উত্তেজিত করার চেষ্টা ছাড়া প্রশাসনিক বা সরকারের অন্যান্য পদক্ষেপের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করে মন্তব্য করা এই ধারার অধীনে অপরাধ বলে গণ্য হয় না।

আসুন জেনে নিই রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের ইতিহাস। ভারতীয় দণ্ডবিধির খসড়া প্রণয়নকারী টমাস ম্যাকোলে রাষ্ট্রদ্রোহের আইনটি অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। তবে এটি ১৮৬০ সালে প্রণীত কোডে যুক্ত করা হয়নি। আইন বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন, এই বাদ দেওয়ার ঘটনাটি একটি দুর্ঘটনাজনিত বিষয়। কারণ, ১৮৯০ সালে বিশেষ আইন এক্স ভি আই আই(XVII, রোমান হরফে ১৭)-এর মাধ্যমে ১২৪ এ আইপিসি ধারার অধীনে রাষ্ট্রদ্রোহ একটি অপরাধ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। সে সময় এই অপরাধের জন্য নির্ধারিত শাস্তি ছিল, অভিযুক্তের স্বাভাবিক জীবনের মেয়াদ অতিবাহিত করার জন্য সমুদ্রের অপরপ্রান্তে পরিবহন। পরবর্তীকালে, ১৯৫৫ সালে তা সংশোধন করা হয় এবং পরিবর্তন করা হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের শাস্তিতে।
স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় রাজনৈতিক ভাবে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে মত পোষণকারীদের অর্থাৎ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দমন করার জন্য এই আইনটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এই আইনের ধারায় সে সময় মামলা করা হয়েছিল বালগঙ্গাধর তিলক, অ্যানি বেসান্ত, শওকত এবং মোহাম্মদ আলী, মাওলানা আজাদ, মহাত্মা গান্ধী সহ একাধিক স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিরুদ্ধে। ব্রিটিশ শাসনকালে এই আইনের ধারায় অর্থাৎ রাষ্ট্রদ্রোহের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মামলা ছিল কুইন এলিজাবেথ বনাম বালগঙ্গাধর তিলক, ১৮৯৮।
আদালতে মূলত এই আইনের একটি আক্ষরিক ব্যাখ্যা অনুসরণ করা হয় যা বলে,” সরকারের আইনানুগ কর্তৃত্বের প্রতি আনুগত্য করার জন্য অসন্তোষ অবশ্যই ‘সামঞ্জস্যপূর্ণ’ হতে হবে..”। উল্লেখ্য, সংবিধানে মৌলিক অধিকারের মধ্যে বাকস্বাধীনতা এবং মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হিসেবে রাষ্ট্রদ্রোহ শব্দটি ব্যবহার করা নিয়ে গণপরিষদে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। তবে, পরবর্তীকালে কিছু সদস্যরা এ বিষয়ে অসম্মতি প্রকাশ করায় এই শব্দটি খসড়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
১৯৫০ সালের প্রথম দিকে রমেশ থাপার বনাম মাদ্রাজ রাজ্যের মামলায় সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছিল,”সরকারের বিরুদ্ধে উত্তেজনাপূর্ণ অসন্তোষ বা সরকারের প্রতি খারাপ অনুভূতির সমালোচনা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের সীমাবদ্ধতার জন্য ন্যায্য কারণ হিসেবে বিবেচিত হবে না যদি না এটি রাষ্ট্রের নিরাপত্তাকে ক্ষুন্ন করা বা রাষ্ট্রকে উৎখাত করার প্রবণতা না হয়।” ওই মামলার সময় বিচারপতি পতঞ্জলি শাস্ত্রী আইনের উদারতা দর্শাতে সংবিধান থেকে রাষ্ট্রদ্রোহ শব্দটি ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ দেওয়ার কথা উল্লেখ করেন। পরবর্তীকালে তারা সিং গোপিচাঁদ বনাম রাজ্য (১৯৫১) এবং রাম নন্দন বনাম উত্তর প্রদেশ (১৯৫৯) মামলায় পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্ট এবং এলাহাবাদ হাইকোর্ট জানায়, আইপিসির ১২৪ এ ধারা ঔপনিবেশিক শাসনের সময় বেশি অসন্তোষ দমন করার জন্য প্রাথমিকভাবে একটি হাতিয়ার ছিল এবং এই বিধানটিকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয়েছিল। এরপর ১৯৬২ সালে কেদারনাথ সিং বনাম বিহার রাজ্য মামলায় এই বিষয়টির শীর্ষ আদালতের সামনে আসে।
১৯৬২ সালের ওই মামলায় শীর্ষ আদালতের ৫ বিচারপতির বেঞ্চ উচ্চ আদালতের আগের রায়গুলি বাতিল করে এবং আইপিসি ধারা ১২৪ এ -এর সাংবিধানিক বৈধতা বহাল রাখে। যদিও আদালতের রায়ে এই আইনের অপব্যবহারের সুযোগ সীমিত করার চেষ্টা করা হয়। শীর্ষ আদালত সে সময় জানিয়েছিল, উস্কানিমূলক বা সহিংসতার আহ্বান না থাকলে, সরকারের সমালোচনাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না। আদালতের তরফ থেকে সাতটি নির্দেশিকা জারি করা হয়, যেখানে বলা হয়, সমালোচনামূলক বক্তব্যকে রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে গন্য করা যাবে না। রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের নতুন সীমাবদ্ধ সংজ্ঞা ব্যবহার করার বিষয়ে ওই নির্দেশিকাতে আদালত জানিয়েছিল, যে সমস্ত বক্তৃতা ‘অসন্তোষ’,’বিদ্বেষ’ বা ‘অবমাননা’ মূলক হলেও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয় সেগুলি বাদে শুধুমাত্র এমন বক্তৃতা যেগুলি ‘জনসাধারণের ক্ষোভ’ উস্কে দিতে পারে তা রাষ্ট্রদ্রোহিতা হিসেবে পরিগণিত হবে।
কেদার নাথের মামলার রায়ের পর ‘পাবলিক ডিসঅর্ডার’ রাষ্ট্রদ্রোহ কমিশনের জন্য একটি প্রয়োজনীয় উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়। আদালত জানায় জনসাধারণের শৃংখলার ক্ষেত্রে হুমকি স্বরূপ ব্যতীত স্লোগান দেওয়া রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে পরিগণিত হবে না।
এরপর ২০১১ সালে ডক্টর ভিনায়ক বিনায়ক সেন বনাম ছত্রিশগড় রাজ্য মামলায় আদালত জানিয়েছিল, রাষ্ট্রদ্রোহমূলক বক্তৃতার লেখক না হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র প্রচার করার জন্য একজন ব্যক্তিকে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা যেতে পারে।
২০১৬ সালে, অরুণ জেটলি বনাম উত্তর প্রদেশ রাজ্য মামলায় এলাহাবাদ হাইকোর্ট বিচার বিভাগ ও আদালতের রায়ের সমালোচনা করেছিল। সেসময় প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অরুণ জেটলি একটি ব্লগ পোস্টে জাতীয় বিচারবিভাগীয় নিয়োগ কমিশনকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্টের ২০১৬ সালের রায়ের সমালোচনা করেছিলেন।
গতবছর ভারতের বিনোদ দুয়া বনাম ইউনিয়ন মামলায় সুপ্রিম কোর্ট প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির করোনা সংকট পরিচালনা সম্পর্কে সমালোচনা করার জন্য সাংবাদিকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে এফআইআর বাতিল করে এবং এই আইনের অপপ্রয়োগ সম্পর্কে সতর্ক করে। ভারতের আইন কমিশন এমনকি সুপ্রিমকোর্টের পরবর্তী প্রতিবেদন রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের ব্যাপক অপব্যবহারের বিষয়ে বারংবার জোর দিয়েছে।
সুপ্রিম কোর্ট এবিষয়ে একটি নতুন আবেদনের শুনানি মঞ্জুর করেছে। একাধিক সাংবাদিক, কিশোর চন্দ্র ওয়াংখেমচা, কানহাইয়া লাল শুক্লা এবং তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ মহুয়া মৈত্র ও অন্যান্যরা ওই মামলার জন্য আবেদন জানান। এই মামলায় শীর্ষ আদালতের সাত বিচারপতির বিশেষ বেঞ্চ নির্ধারণ করবেন কেদারনাথ মামলায় যে রায়দান করা হয়েছিল তা সঠিক কিনা। আবেদনকারীদের তরফ থেকে বলা হয়েছে, যে কেদারনাথ মামলায় রাষ্ট্রদ্রোহের সীমাবদ্ধ সংজ্ঞাটি বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইনের মতো কঠোর সন্ত্রাসবিরোধী আইন সহ আরো কয়েকটি আইনের মাধ্যমে সমাধান করা যেতে পারে।
এক্ষেত্রে আদালতের সিদ্ধান্ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ যদি এই আইন থেকে রদ করা হয় তাহলে কেদারনাথের রায়কে বাতিল করতে হবে এবং বাক-স্বাধীনতার বিষয় পূর্বের উদারনৈতিক রায় বহাল করতে হবে। তবে, আইন বিশেষজ্ঞদের মতে সরকার যদি এই আইনটি পর্যালোচনা করার সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে, হয় এই আইনকে বাতিল করা হবে, নাহলে এই আইনের ভাষা খানিকটা বদল করে বা হেরফের করে ভিন্ন আকারে এই আইনটিকে ফিরিয়ে আনা হতে পারে।
ভারত বাদে ব্রিটিশ উপনিবেশের অন্যান্য দেশগুলিতে অনেক ক্ষেত্রেই ইতিমধ্যেই বাতিল করা হয়েছে রাষ্ট্রদ্রোহ আইন। ইউনাইটেড কিংডমে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনটি করোনার্স অ্যান্ড জাস্টিস অ্যাক্ট,২০০৯-এর ধারা ৭৩-এর অধীনে বাতিল করা হয়। অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রদ্রোহ ফেডারেল ফৌজদারি কোড, ধারা ২৩৮৪-এর অধীনে একটি ফেডারেল অপরাধ হিসেবে পরিগণিত হয়। তবে, ২০১০ সালে অস্ট্রেলিয়া এবং ২০২১ সালে সিঙ্গাপুরে এই আইন বাতিল করা হয়েছে।

Related Articles

Back to top button
error: