গল্পকার:-মোস্তফা কামাল।
দীর্ঘ উনিশ বছর সুনামের সঙ্গে মাস্টারি করার পর কয়েকদিন হলো হাবিব মাস্টার বদলী হয়ে হরিপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেছেন। এই স্কুলে দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে প্রধান শিক্ষক নেই। বাম আমলে এই স্কুলে প্রায় সবারই নেতাদের চিরকুটে পাওয়া চাকরি। স্থানীয় শিক্ষক কমরেড সালাম মাস্টার টিআইসি হয়ে স্কুলের হর্তাকর্তা হয়ে বসে আছেন। তিনি নিজস্ব দুর্নীতির বলয় তৈরি করে স্কুলটাকে একটা দুর্নীতির আঁতুর ঘরে পরিণত করেছেন। দিবালোকে মিড ডে মিল থেকে সর্বত্র চুরির একটা আস্ত কারখানা খুলে রেখেছেন। পরিচালন কমিটির সেক্রেটারি এবং কয়েকজন সহযোগী শিক্ষক থেকে শুরু করে স্থানীয় দুর্বৃত্তদের হাতে তার বখরা ঠিক সময়ে পৌঁছে যায়।লাল-সবুজ-গেরুয়া সবাই এর ভাগ পায়। ফলে এদের বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস কারোর নেই। তাই প্রধান শিক্ষক বিহীন স্কুলে লেখাপড়ার মান তথৈবচ।দেখার কেউ নেই।
এক সহকর্মী এগিয়ে এসে হাবিব মাস্টারকে বলেন, এসব আমাদের সয়ে গেছে হাবিবদা। কিছুদিন থাকুন তাহলে আপনারও সয়ে যাবে।কী দরকার এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর? স্কুলে আসি যাই,মাসে মাসে মাইনে পাই। এটা ঠিক মতো পেলেই হবে।
……. হুম্। আচ্ছা এই স্কুলে হেডমাস্টার আসে না কেন?
……কে বললো আসেনা? আসে, কিন্তু যিনি আসেন তিনি বেশিদিন টিকতে পারেন না। কিছুদিন পর অপবাদের বোঝা নিয়ে চোখের জলে বিদায় নেন। এসব নিয়ে প্রতিবাদ করতে গেলে আপনার বিরুদ্ধেও যৌথ ষড়যন্ত্র হবে।এই স্কুল ছাড়তে ওরা আপনাকে বাধ্য করবে।
……. বলছেন কী?
……… হ্যাঁ ঠিকই বলছি। সালাম মাস্টার অত্যন্ত ধূর্ত লোক।স্থানীয় লোকজনের মুখে শোনা তিনি হেন হীন কাজ নেই যা উনি করতে পারেন না। বাড়িতে একটা ঘানি কল আছে।সবাই জানে সেখানে প্রকাশ্যে তেলে ভেজাল মিশিয়ে বিক্রি করে। কিছু গরীব মানুষকে ঠকিয়ে জমি জায়গা দখল করে বসে আছে কিন্তু কেউ ওর কিছু করতে পারে না। অত্যন্ত মামলাবাজ লোক। অবাধ্য সন্তান হওয়ায় বাপ তাকে ত্যাজ্য পুত্র করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল।ঐ সময় তাকে যারা পুত্র সন্তানের স্নেহ ভালবেসে স্থান দিয়ে আগলে রেখেছিলেন তাদেরকেও ছাড়েন নি।কথায় আছে না, অকৃতজ্ঞরা যে পাতে খায় সেই পাত ফুটো করে।
…….. একজন শিক্ষক হয়ে এত নিকৃষ্ট হতে পারে?
…….. পারে। তার জলন্ত উদাহরণ সালাম মাস্টার নিজেই।তার দ্বিতীয় কপি পৃথিবীতে আর আছে বলে মনে হয় না।
কিছুদিন পর টিআইসির ঘরে ডাক পড়ে হাবিব মাস্টারের। কয়েকজন ষণ্ডামার্কা লোক নিয়ে সালাম মাস্টার বসে আছেন। তাদের মধ্যে সদ্য রাখা লম্বা দাড়িওয়ালা স্কুলের সম্পাদক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে হাবিব মাস্টারের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন, আপনি মিড ডে মিলে গোয়েন্দা গিরি করছেন কেন? শুনছি স্কুলে হেডমাস্টার নিয়ে আসছেন? আবার স্কুলকে নাকি উচ্চ মাধ্যমিক বানাবেন?
…….. হাজার অধিক ছাত্র ছাত্রী থাকলেও মিড ডে মিলের খাবার খায় খুব জোর দুশো থেকে আড়াইশো মতো। কিন্তু সরকারি খাতায় নব্বই শতাংশ দেখিয়ে টাকা তোলা হয়। সেটা নিশ্চয়ই আপনার অজানা নয় সেক্রেটারি সাহেব? সেই টাকা কোথায় যায় আমি ভালো করেই জানি। দীর্ঘ কুড়ি বছর প্রধান শিক্ষকের পদটি শূন্য আছে। সেখানে প্রধান শিক্ষক যোগদিলে তো আপনার স্কুলের লাভ।আর স্কুল উচ্চ মাধ্যমিক হোক তা নিশ্চয়ই আপনারাও চান। আবেদন করার ক্ষমতা তো আমার নেই, ওটা আপনাদের দায়িত্ব। স্কুল যদি উচ্চ মাধ্যমিক হয় তবে সব থেকে বেশি লাভবান হবে আপনার এলাকার ছাত্র ছাত্রীরা। আশা করি আপনারা স্কুলের স্বার্থে এগুলোর দিকে নজর দেবেন।
কিছুক্ষণ সবাই চুপ থাকেন।একটু নিষ্ঠুর হাসির রেখা ফুটে ওঠে সালাম মাস্টারের ঠোঁটে। টেবিল চাপড়ে হঠাৎ চিৎকার করে ওঠেন সেক্রেটারি সাহেব। বলেন, দেখুন হাবিব সাহেব, এসব দেখার জন্য আপনাকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। আপনার কাজ ছেলে মেয়েদের পড়ানো। বেশি বাড়াবাড়ি করলে আপনার ভাগ্যে কষ্ট আছে। স্কুলে আরও তো মাস্টার আছে তারা তো কেউ কিছু বলে না। আর দুদিন স্কুলে এসে আপনি একেবারে স্কুল দরদী হয়ে গেলেন?
সালাম মাস্টার আর একটু ঝাঁঝ বাড়িয়ে বললেন, দেখছেন তো সবাই, হাবিব মাস্টারের ঔদ্ধত্য?এই স্কুল তৈরি করেছি আমরা। স্কুলের প্রতিটি ইঁটে আমাদের রক্ত লেগে আছে।তাই আমরা যা খুশি তাই করবো। বাইরে থেকে এসে কেউ এখানে দাদাগিরি করবে এটা মেনে নেবো না।
একপ্রকার অপমানিত হয়ে হাবিব মাস্টার টিআইসির ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। তিনি বুঝতে পারেন এখানে তার পাশে দাঁড়িয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার কেউ নেই।ষড়যন্ত্রের জাল অনেকদূর বিস্তৃত। তবুও তাকে ভয় পেলে চলবে না। ছাত্র ছাত্রীদের স্বার্থে এর একটা বিহিত করতেই হবে। স্কুল ছুটির পর বাড়ি না ফিরে সোজা জেলা শিক্ষা ভবনে হাজির হোন হাবিব মাস্টার।ডিআই এর সঙ্গে দেখা করেন। স্কুলে টিআইসি এবং সেক্রেটারি মিলে কীভাবে দিনের পর দিন দুর্নীতি হচ্ছে তা তুলে ধরেন।ডিআই সাহেব নিদানের প্রতিশ্রুতি দেন এবং দুজন শিক্ষা আধিকারিককে দ্রুত তদন্ত করে রিপোর্ট জমা দিতে বলেন।
ঘটনাটি জানাজানি হতেই রাগে ফুঁসতে থাকে সালাম মাস্টার।সে প্রমাদ গুনে। হাবিব মাস্টার যদি এই স্কুলে থাকে তাহলে তাদের এতদিনের তৈরি করা রাজত্ব শেষ হয়ে যাবে। যেভাবেই হোক হাবিব মাস্টারকে থামাতেই হবে।প্রয়োজনে তাকে পৃথিবী থেকে বিদায় করতে হলে করবে সে।
গভীর রাতে অচেনা নং থেকে হাবিব মাস্টারের কাছে হুমকি ফোন আসে। ‘সাবধান হয়ে যান মাস্টার মশাই। আমাদের স্কুল নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করবেন না। আমাদের এলাকার ছেলেরা করে খাচ্ছে তাতে আপনার নাক গলানোর কি দরকার? মাস্টারি করতে এসে শেষে কি জীবনটা হারাবেন?’- ভয় পান হাবিব মাস্টার। তিনি টের পান এর পরিনতি খুব ভয়ঙ্কর হতে পারে।
স্কুলের অনতিদূরে হাজী হেলাল সেখের বাড়ি। তিনি এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তি। মসজিদে যাওয়া আসার সুবাদে তার সঙ্গে পরিচয় হয় হাবিব মাস্টারের। ওকে সব খুলে বলেন তিনি। শুনে হেলাল সেখের ভ্রু কুঁচকে যায়। একটা চিন্তার ভাঁজ পড়ে কপালে। বিড়বিড় করে বলেন, সালাম মাস্টার লোকটি তো ভালো নয়। আপনার ক্ষতি করতে তার হাত একটুও কাঁপবে না। একটু নীরব থেকে বলেন, ‘আমি দেখছি মাস্টার মশাই। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।’
দুদিন পর হেলাল সেখ হাবিব মাস্টারকে ফোন করে বলেন, আমি খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারলাম আপনাকে খুন করার জন্য সালাম মাস্টার উস্থিয়ার দুজনকে টাকার বিনিময়ে সুপারি দিয়েছেন। সৌভাগ্যক্রমে সুপারি কিলার দুজনেই আমার খুব পরিচিত হওয়ায় বিষয়টি জানতে পারি। আপনি চিন্তা করবেন না। সালাম মাস্টারের টাকা ওরা ফেরত দিয়ে দিয়েছে। তবুও আপনি সাবধানে থাকবেন। কিছু হলে আমাকে জানাবেন।
একটু শুষ্ক হাসি দিয়ে হাবিব মাস্টার ঘাড় নাড়ান। তার মনে হয় চাকরি ছেড়ে চলে যেতে। কিন্তু সংসার চলবে কি করে! ছেলে মেয়েরা বাইরে পড়াশোনা করে। তাদের টাকার যোগান আসবে কোত্থেকে!মনকে শক্ত করেন তিনি।
আজ আকাশে ঘন কালো মেঘ জমেছে। হালকা বৃষ্টি শুরু হয়েছে। স্কুলের শেষ ঘন্টা পড়ে গেছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে। একটু দেরি হলে অজানা আশঙ্কায় মিনা অস্থির হয়ে ওঠে। হাবিব মাস্টার রেনকোট গায়ে চাপিয়ে মোটরসাইকেলে স্টার্ট দেন। কিছুদূর যাওয়ার পর তিনি লক্ষ্য করেন একটা মোটরসাইকেলে দুজন লোক তার পিছু নিয়েছে। শীলপুকুরের কার্লভাটের কাছে হঠাৎ ই পেছন থেকে তার বাইকে সজোরে লাথি মেরে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওরা প্রচণ্ড স্পীডে পালিয়ে যায়। হাবিব মাস্টার কোনোরকমে রক্ষা পান। ভয়ে কাঁপুনি ধরে শরীরে। তিনি বুঝতে পারেন এসব সালাম মাস্টারের পোষা গুন্ডাদের কাজ।
আজ সকাল সকাল বেরিয়ে পড়েন হাবিব মাস্টার। লালবাগ থানা হয়ে স্কুল যাবেন।স্কুলের বর্তমান পরিস্থিতি এবং তার নিরাপত্তার অভাব জানিয়ে একটা ডায়েরি করে স্কুলের দিকে রওনা হোন।ক্লাসে ঢোকার মুখে উঁচু ক্লাসের দুজন ছাত্র তার দিকে এগিয়ে যায়। গোপনে পকেট থেকে একটা চিরকুট বের করে হাবিব মাস্টারের হাতে দিয়ে দ্রুত সরে পড়ে। যাবার সময় মুখে হাত চেপে বলে, “স্যার,যেন কেউ আমাদের নাম জানতে না পারে। আপনার বিরুদ্ধে মেয়েদের দিয়ে নোংরা ষড়যন্ত্র হচ্ছে।” একটু আড়ালে গিয়ে হাবিব মাস্টার চিরকুটটি খুলে দেখে চমকে ওঠেন তিনি। এতবড়ো জঘণ্য ষড়যন্ত্র! ছিঃ ছিঃ! শেষে তারই ছাত্রীদের দিয়ে কিনা সম্মান হানির চেষ্টা! এটাই বোধহয় নিকৃষ্টতম লোকের নিকৃষ্টতম পন্থা। সালাম মাস্টার ছাত্রীদের নিয়ে রিহার্সল পর্ব শেষ করে অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। এখন শুধু মঞ্চে অভিনয় বাকি। হাবিব মাস্টারকে উচিত শিক্ষা দিতেই হবে।
ক’দিন থেকে হাবিব মাস্টারের শরীর ভালো যাচ্ছে না। নতুন স্কুলে যোগদানের পর থেকে একটা অজানা দুশ্চিন্তায় তার ঘুম হারাম হয়ে গেছে।কী কুক্ষণে যে এই স্কুলে বদলি হয়ে এসেছিলেন। নিজের চুল নিজে ছিঁড়তে ইচ্ছে করে তার।মিনা বলে তুমি ক’দিন স্কুল যেওনা।অতো দুশ্চিন্তার কী আছে? আল্লাহ তোমাকে ঠিক রক্ষা করবেন। পারলে তুমি এই স্কুল ছেড়ে দিয়ে অন্য স্কুলে যাবার চেষ্টা করো।আর তুমি তোমার সবুজ দলের অনেক পুরোনো কর্মী। এই বিষয়টি তোমার নেতাদের জানাও।তারা নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা নেবেন।
মিনার এই পরামর্শে হাবিব মাস্টার শুষ্ক হাসি দিয়ে বলেন,এখন সবুজ দলে পুরোনো দিনের নিষ্ঠাবান কর্মীদের আর গুরুত্ব নেই মিতা।যত স্বার্থান্মেষী লোকগুলো এখন সবুজ দলের সম্পদ।কমরেড সালাম মাস্টার এখন সবুজ দলের নেতাদের খুব কাছের লোক বুঝলে?
মিনা বিড়বিড় করে বলে, সংসার ভাসিয়ে তুমি সবুজ দলের জন্য দশ পনের বছর ধরে কী না করেছো! আর আজ বিপদের দিনে দলে তোমার থেকে সালাম মাস্টারের গুরুত্ব অনেক বেশি? অমন দল করো কেন? হাবিব মাস্টার স্ত্রী মিনার কথার জবাব খুঁজে পাননা।
আগামীকাল থেকে গরমের ছুটি পড়ে যাবে তাই আজ মর্ণিং স্কুল। হাবিব মাস্টার তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নেন।মিনা চা দিয়ে যায়। তাড়াতাড়ি চায়ে চুমুক দিয়ে মোবাইলটা পকেটে পুরতেই সেটা বেজে ওঠে।
…………হ্যালো!
………….মাস্টার মশাই আমি সুনীতি বলছি।
……….হ্যাঁ বলো সুনীতি।
……….আজকে স্কুলে আসছেন তো?
………..হ্যাঁ যাবো তো।এই বেরুচ্ছি।
…………একটু সাবধানে আসুন মাস্টার মশাই।
……….কেন,কী হয়েছে?
…………দুদিন থেকে স্কুলে আসছেন না তো তাই কনফার্ম হয়ে নিলাম।সালাম মাস্টার আমাকে ফোন করেছিল। আপনাকে ফোন করে জানতে বলেছে আপনি আজ স্কুলে আসবেন কিনা। আপনার বিরুদ্ধে খুব ষড়যন্ত্র হচ্ছে মাস্টার মশাই। গত দুই দিনে আপনি স্কুলে আসবেন ভেবে সালাম মাস্টার তার কিছু সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে আপনার বিরুদ্ধে স্কুলে মিটিং করেছে।ওরা আপনাকে খুব অপমান করবে।সালাম মাস্টার তো সেদিন প্রতিজ্ঞাই করেছেন যেভাবেই হোক আপনাকে উনি মারবেনই। আপনি স্কুলে এলেই কিছু একটা অঘটন ঘটাবেই ও।
………ও ! আচ্ছা! রাখছি। ফোন রেখে দিয়ে কেমন যেন আনমনা হয়ে পড়ে হাবিব।
……..কে ফোন করেছিল গো? মিনা জিজ্ঞেস করে।
………সুনীতি। আমাদের স্কুলের পিওন।
……….কী বলছে? ওর ফোন পেয়ে তোমাকে চিন্তিত মনে হচ্ছে কেন?
………সালাম মাস্টারের ষড়যন্ত্রের কথা বলছে। আমি আজ স্কুলে যাবো কিনা তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য ফোন করেছিল। হয়তো সালাম মাস্টারের আজ কোনো কু-মতলব রয়েছে।
………মিনা চিন্তিত হয়।বলে, আজও না হয় স্কুল যেওনা।অমন স্কুল থেকে চলে আসার চেষ্টা করো। এইভাবে চাকরি করা যায় নাকি? ট্রানাস্ফার নিয়ে এই স্কুলে আসার আগে একটু খোঁজ খবর নিতে পারতে। আমি তোমাকে কতবার বলেছিলাম তুমি শোনোনি। তোমার একটাই কথা শিক্ষক কখনোই খারাপ হতে পারেন না। শিক্ষক কখনোই আত্মসম্মান বিক্রি করে বেশি নিচে নামতে পারেন না। এখন দ্যাখো ঠ্যালা।
………মিনা, তোমাকে এতো চিন্তা করতে হবে না। মনে রেখো, শয়তান শুধুমাত্র মিথ্যা আস্ফালন করে।তারা কখনো জয়ী হয় না। শয়তানের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হবেই হবে।
হাবিব মাস্টার গাড়ি বের করে স্কুল রওনা দেয়। মনে মনে ভাবে আল্লাহই একমাত্র ভরসা।যাবার পথে তালপুকুরের মাহাতাব সাহেবের সঙ্গে দেখা করেন। উনি স্কুলের প্রাক্তন সেক্রেটারি। তাকে সব খুলে বলেন। মাহাতাব সাহেব বলেন, আপনার কোনো চিন্তা নেই। আমি আপনার পাশে আছি।মাথা উঁচু করে স্কুলে যান। বাকিটা আমি দেখে নিচ্ছি।
হাবিব মাস্টার যথাসময়ে স্কুলে পৌঁছান। তিনি লক্ষ্য করেন সবাই তার দিকে আড়চোখে চেয়ে কী যেন সব বলাবলি করছে।
আজ সালাম মাস্টারের চোখে মুখে একটা নিষ্ঠুর আনন্দের ছাপ লুকোচুরি খেলছে।এই সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করতে চায়না সে। আজকে হবে চরম প্রতিশোধ। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে হাবিব মাস্টারকে দোষী সাব্যস্ত করে পুলিশের হাতে তুলে দেবে।প্ল্যান রেডিই ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সালাম মাস্টারের পোষা বাহিনীর আট দশজন স্কুলে ঢুকে যায়। থানায় ফোন করে সালাম মাস্টার পুলিশ পাঠাতে বলেন। পুলিশ আসে।স্কুলে ছুটির ঘন্টা পড়ে। রিহার্সলে অংশগ্রহণকারী ছাত্র ছাত্রীদের রেখে বাকি ছাত্র ছাত্রীদের গেটের বাইরে বের করে দিয়ে বদ্ধ ঘরে হাবিব মাস্টারের বিচার শুরু হয়।আজ পকসো আইনে বিচার হবে এবং হাবিব মাস্টারকে দোষী প্রমাণিত করে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হবে। সালাম মাস্টারকে খুব খুশি দেখায়। হাবিব মাস্টারের করুণ পরিণতি ভেবে তার অন্তরটা বারবার পুলকিত হয়ে উঠে।
স্টাফ রুমে বিচার শুরু হয়। রুদ্ধদ্বারে রুদ্ধশ্বাস পরিবেশ! ছাত্রীদের শেখানো অভিযোগগুলো একটা একটা করে পড়ে শোনান সেক্রেটারি সাহেব। অভিযোগ একটাই,শ্রেনিকক্ষে পড়ানোর সময় হাবিব মাস্টার ছাত্রীদের গায়ে ব্যাড টাচ করেন।সবার চোখ হাবিব মাস্টারের দিকে। তিনি লজ্জায় মুখ লুকিয়ে মাথা গুঁজে বসে আছেন। সালাম মাস্টার দুজন ছাত্রীকে স্টাফ রুমে নিয়ে এলেন।মুখ তুললেন হাবিব মাস্টার। ওদের চোখে চোখ রাখতেই ওরা কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠলো, ”বিশ্বাস করুন স্যার, আমাদের হাবিব স্যার খুব ভালো শিক্ষক! উনি আমাদের খুব ভালোবাসেন! ভালো পড়ান! আমাদের কোনো অভিযোগ নেই স্যারের বিরুদ্ধে!
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে সেক্রেটারি সাহেব জিজ্ঞেস করেন, তাহলে এই চিঠি কে লিখেছে? এই সই তোমাদের নয়?
……..আমরা লিখিনি স্যার! সালাম স্যার লিখেছেন। আমাদের সই করতে বলেছিলেন তাই সই করেছিলাম।
হাবিব মাস্টার চোখে জল ধরে রাখতে পারলেন না। উপরের দিকে তাকিয়ে আল্লাহকে হাজার শুকরিয়া জ্ঞাপন করলেন। বললেন,হে আল্লাহ! মানীর মান আপনিই রক্ষা করেন।
নিমেষের মধ্যে ঘটনার প্লট পাল্টে গেল। সেক্রেটারি টিআইসি সালাম মাস্টারকে তিরষ্কার করতে লাগলেন।পরে হাবিব মাস্টারের দিকে চেয়ে নরম সুরে বললেন, মাস্টার মশাই,যা হওয়ার হয়ে গেছে। আপনি কিছু মনে করবেন না। আপনি ডিআই অফিসে যে অভিযোগগুলো করে এসেছেন সেগুলো তুলে নিয়েন। আজকের মিটিং এখানেই শেষ করা হলো।
ততক্ষণে গেটের বাইরে মাহাতাব সাহেবের নেতৃত্বে কয়েকশো অভিভাবক উপস্থিত হয়েছেন। উত্তেজিত জনতার রোষানলে গোটা স্কুল। তারা গেট ভেঙে স্কুলের ভিতর ঢোকার চেষ্টা করছেন। ওদের দাবী ষড়যন্ত্রকারী সেক্রেটারি ও সালাম মাস্টারের বিচার চাই।
সেক্রেটারি এগিয়ে এসে হাবিব মাস্টারকে অনুরোধ করেন, মাস্টার মশাই এদের থামতে বলুন। পরিস্থিতি খুব খারাপের দিকে যাচ্ছে।
…….আপনি আগে বলুন, যারা আমার সম্মানহানির অপচেষ্টা করলেন তাদের বিচার কী হবে? আপনি কি পারবেন সালাম মাস্টারের বিচার করতে?
বিপদ দেখে ততক্ষণে সালাম মাস্টার পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়েছেন। পুলিশ অভিভাকদের বোঝানোর চেষ্টা করে। সবাই হাবিব মাস্টারের দিকে এগিয়ে আসে। জিজ্ঞেস করে, আপনি শুধু বলুন, আপনাকে কি কেউ অপদস্থ করেছে?
.…..…….না,কেউ অপদস্থ করেননি। শুধু এইটুকু বলবো আপনাদের এই স্কুলে আমার হয়তো বেশিদিন শিক্ষকতা করা সম্ভব হবে না। অভিভাবকগণ ভিড় করেন হাবিব মাস্টারের কাছে।তারা সমস্বরে জানান আপনাকে এই স্কুল ছাড়তে আমরা দেবো না। আপনার কোনো অসুবিধা হবে না।এমন সময় একজন অফিসার গোছের পুলিশ এসে বলেন,স্যার, আপনি এখান থেকে চলে যান। এখানে দাঁড়াবেন না।
মোটরসাইকেল স্টার্ট করে হাবিব মাস্টার।দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন। পুলিশ অভিভাকদের আশ্বস্ত করে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। সালাম মাস্টার রাতে ফোন করে হাবিব মাস্টারের কাছে আজকের ঘটনার জন্য ক্ষমা চেয়ে নেন।ষড়যন্ত্রকারীর এই ক্ষমা চাওয়ার অভিনয়টা হাবিব মাস্টারের কাছে হাস্যকর বলে মনে হয়। হতে পারে বিশ্বাস ঘাতকের এ এক নতুন চাল।
এখন গরমের ছুটি। হাবিব মাস্টারের বেশ ক’দিন নিশ্চিন্তে কাটছে। অন্ততঃ শয়তান থেকে দূরে রয়েছে সে । ছুটির ফাঁকে স্কুল পরিবর্তনের জন্য শিক্ষা দফতরে আবেদনও করে দিয়েছেন।
ঘটনাটি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্র ছাত্রীরা নিজেদের বাবা মা কে জানায়।তারাও ক্ষুব্ধ হোন।এলাকায় একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। একজন নিরক্ষর অভিভাবক গালমন্দ করতে করতে রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলে।
……… শালা শুহুরের বাচ্চা, ইস্কুলটাকে এক্কেবারেই শ্যাষ কইরি দিলো।ঐ শালার জন্যি ছেলিপেলি গুল্যা লষ্ট হয়্যি গ্যালো। সেই কতবছর হলো ইস্কুলে হেডমাস্টার নাই।শালা ইস্কুলের টিআইসি না কি যেন হইছে, হয়ি মিড ডে মিলের টাকাগুল্যা ল্যুট্যাপ্যুট্যা খ্যাছ্যে।ম্যালা টাকা ভর্তির ফি লিয়্যা কম টাকার রশিদ দ্যায় শালা। হেডমাস্টার লিচ্ছেনা।শ্যুনিছি হেডমাস্টার হওয়ার ল্যাইগি হাইকুটে মামলা ঠ্যুকিছে শালা মাগীবাজ।এক্কেবারে দুকান কাটা শালার।শালার লাজ লুজ্জা বুলতে কিছুই নাই রে।অল্প সাদে বাপে শালাকে ত্যাজ্য পুত্র ক্যরিছিল? আপন মনে বকবক করতে করতে হেঁটে যায় কালু। পালপাড়ার চন্দনের চায়ের দোকানে বসে ছিল সাজু।ও হাঁক দেয়। কী হলো রে কালু? তুই কাকে গালমন্দ করছিস?
ক্যান,তুই জানিস না,ঐ শালা সালাম মাস্টার ইস্কুলটাকে লিয়্যা কি কীর্তি কর্চ্ছে? মুনে হইচ্চে শালার বাপের ইস্কুল।আমরা শালারা দিনরাত খ্যাইটি খ্যুইটি মাথার ঘাম পায়ে ফ্যেলি, ইঁট পাথর বহি ইস্কুলটাকে তৈরি করনু আর ঐ শালা ইস্কুলটাকে বাপের জমিদারি বানিয়েছে! এইকথা বুলার এই এলাকায় কেহু নাই?
কিছুক্ষণ চুপ থাকে সাজু। একটা টানা নিঃশ্বাস নিয়ে বলে, তোরাই তো ওকে মাথায় তুলে রেখেছিস।তোরা কি জানিস না সালাম মাস্টার কেমন ধরনের লোক?
হ্যাঁ, জানিই তোরে।অর মুতোন লষ্ট মানুষ এই ইলাকায় আর দ্যুটি নাই। তবুও কি জানিস সাজু! হাজার হুলেও উ তো এই ইলাকারই ছেল্যি।তাই হাজার অন্যায় কুরলেও উর পাশে দাঁড়াতে হয়।
…….না, এটা ঠিক নয় কালু। একটা মানুষ দিনের পর দিন অন্যায় করে যাবে আর এলাকার মানুষ বলে আমাদের সব কিছু মেনে নিতে হবে? একবার ভেবে দেখেছিস স্কুলটার কী অবস্থা হয়েছে? ছাত্র ছাত্রীদের কয়েকটি প্রজন্মকে শেষ করে দিয়েছে ওই শয়তানটা। শুনেছি তোকে নাকি সালাম মাস্টার মাসে মাসে কিছু টাকা দিয়ে হাত করে রেখেছে? কথাটা কি ঠিক?
কালু এবার চমকে উঠে। কিছুক্ষণ পর মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে, তুই শুদু আমাকেই বুলছিস ক্যানে রে? সিপিএনের জাকির,তির্ণমূলের আমজাদ, কংগ্রেচের সিহাব মুন্ডলের কথা শ্যুদ্ধি বোল।উরাও তো সালাম মাস্টারের কথায় উঠাবসা করে।উরা সবাই মিল্যা হাবিব মাস্টারকে ইস্কুল থ্যাকি তাড়াবার ল্যাগি উঠিপ্যড়ি ল্যাগিছে।আর তুই শালা শুদু আমাকেই দ্যেখতে পাছিস?
সাজু চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে,এখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে গালমন্দ করলে হবে? তোরা সবাই তো ওর কাছে বিক্রি হয়ে আছিস। স্কুলের টাকা মেরে সালাম মাস্টার তোদের যে টাকা দিয়ে পুষে রেখেছে তাতে তোরা নিজেদেরই সর্বনাশ করছিস। একটু ভেবে দেখ।
কালু চুপ করে শোনে। একটু পরে মাথা নাড়িয়ে বলে,আর এমনটি হ্যত্যে দিবোনা।আমরা সবাই মিল্যা হাবিব মাস্টারের পাশে দাঁড়াবো।তোখুন দ্যেখবো সালাম মাস্টার কি ক্যইর্তে পারে।আমরা ঐ মাস্টারকে ইস্কুল ছ্যাড়্যা চ্যলি য্যাতি দিবোনা।
ঠিক আছে কালু। কথাগুলো মনে রাখিস। একটা ভালো মাস্টারকে আমরা কিছুতেই স্কুল থেকে যেতে দেবোনা। এতদিন কেউ এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুখ খোলেনি। হাবিব মাস্টার এসে ওদের মুখোশ খুলে দিয়েছেন।
তুই ঠিকিই ব্যুলিছিস সাজু।উ শালার সাথে আমি আর নাই।অর টাকায় আমি ম্যুত্যা দিই।
গরমের ছুটি শেষ হয়েছে। স্কুলের থমথমে পরিবেশ। ছাত্র ছাত্রীরা হাবিব মাস্টারের কাছে আসতে লজ্জা পায়। ওদের কাছে ডেকে হাবিব মাস্টার বলেন, তোদের কোনো দোষ নেই। শিক্ষক যদি খারাপ হোন তাহলে তার দায় তোদের নয়। বরং ছাত্র খারাপ হলে তার দায় কিছুটা হলেও শিক্ষকদের উপর বর্তায়। একজন শিক্ষক ইচ্ছা করলে যেমন পুরো সমাজকেই বদলে দিতে পারে আবার সে সমস্ত সমাজটাকেই নষ্ট করে দিতে পারে। ভালো মন্দ সবজায়গায় সবক্ষেত্রেই রয়েছে। সবসময় সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। তোরা আগামীতে যা কিছু করবি ভালো মন্দ বিচার করেই করবি। তোদের মানুষ হতে হবে। অনেক বড়ো মাপের মানুষ।
টিফিনের সময় শেষ হয়।ঢং ঢং ঢং ঘন্টা পড়ে। হাবিব মাস্টার স্টাফ রুমে ঢুকে যান। শিক্ষা দফতর থেকে হঠাৎ ই হাবিব মাস্টারের মোবাইলে একটা ট্রানাস্ফারের ইমেইল আসে। আগামী তিনদিনের মধ্যে তাকে নতুন স্কুলে যোগদান করতে হবে।