গল্প:-রফিক মাস্টার
গল্পকার:-মোস্তফা কামাল
ছাত্র দরদী হিসেবে রফিক মাস্টারের এলাকায় একটা পরিচিতি আছে।অত্যন্ত নরম হৃদয় তার।সব সময় হাসি মুখে থাকেন। কোনো দুঃখ যেন তাকে স্পর্শ করতে পারে না। ছাত্রছাত্রী অন্ত প্রান ।ওরাই তার পরিবার, একান্ত আপনজন। ওদের দুঃখে রফিক মাস্টারের প্রান কাঁদে, আনন্দে আনন্দিত হোন। ওদের জন্য সবসময় তার দরজা খোলা।সবার মুশকিল আসান। ছাত্র ছাত্রীদের সবরকমের অভাব অভিযোগ জানাবার একমাত্র নির্ভরযোগ্য স্থান তাদের প্রিয় শিক্ষক রফিক মাস্টার। তাদের কাছে তিনি শুধু আদর্শ শিক্ষকই নন, একজন আদর্শ বন্ধুও।তাই তিনি ছাত্র ছাত্রীদের কাছে হয়ে উঠেছেন তাদের ভালোবাসার মানুষ, ভালো লাগার মানুষ।
নানান সমস্যা নিয়ে সময়ে অসময়ে ছাত্র ছাত্রীরা রফিক মাস্টারের বাড়িতে আসে।তারা ফোন করেও অনেক কিছু বলে। রেহেনার এসব পছন্দ নয়। ও বলে, “স্কুল ,স্কুলের জায়গায় রাখবে,এসব বাড়িতে আনবে না।তার চেয়ে নিজের ছেলে মেয়েদের জন্য সময় দাও।”
রফিক শুধু ঘাড় নেড়ে চুপচাপ রেহেনার কথা শোনে। খুব সাবধানে থাকে। মুখে কিছু বলে না। উচ্চ বাচ্য হলে রেহেনা মাঝে মধ্যে বিগড়ে যায়।নিজেই নিজের শরীরের উপর অত্যাচার করে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে।এটা একধরনের মানসিক রোগ।এই ধরনের রুগীরা ভয়ানক সন্দেহ প্রবন ও আত্মকেন্দ্রিক হয়।আত্মগ্লানীতে ভোগে।ইনসিকিওর ফিল করে। ভাবে, ওকে হয়তো কেউ ভালোবাসে না। কেউ গুরুত্ব দেয়না।এই রোগের সঠিক চিকিৎসা না হলে পরবর্তীতে এরা পাগল হয়ে যেতে পারে। বহরমপুরে অনেক ডাক্তার দেখিয়েও কোনো লাভ হয়নি। ইদানিং ব্যাঙ্গালোরে ওর চিকিৎসা চলছে।ডাক্তার বাবু বলেছেন, রেহেনাকে সুস্থ রাখতে হলে সবসময় ওর বিশ্বাস যুগিয়ে চলতে হবে।না হলে যে কোনো সময় বড়ো ধরনের বিপদ হতে পারে।এই রোগের পথ্যের থেকে বড়ো ঔষধ ওর মন যুগিয়ে চলা। রফিক মাস্টার সেটাই করার চেষ্টা করেন কিন্তু ছাত্র ছাত্রীদের বিষয়ে রেহেনার সঙ্গে মন থেকে কোনো আপোষ করতে পারেন না।
আজ রবিবার। রফিক মাস্টারের স্কুল ছুটি। সুতরাং সকাল সকাল ওঠার তাড়া নেই।বিছানায় শুয়ে কাঠ হয়ে পড়ে আছেন। ওদিকে ঘড়ির কাঁটা আটের ঘরে। রেহেনা ডাক দেয়,কী গো উঠবেনা নাকি? কটা বাজে দেখেছো? তাড়াতাড়ি উঠো।চা হয়ে গেছে। বাজারে যাও। ঘরে একটুও সবজি নেই।
রফিকের বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করছেনা।এপাশ ওপাশ করে আবার চাঁদর মুড়ি দিয়ে কুঁকড়ে শুয়ে থাকে। পাশেই রাখা মোবাইলটা হঠাৎই বেজে উঠে। একটা হাই তুলে চোখ বন্ধ করেই রফিক ফোনটা ধরে।
……..হ্যালো।
……..স্যার!
…….হ্যাঁ, বলো কে বলছো?
………আমি স্যার,তৌফিকা।
…….তৌফিকা, কোন তৌফিকা?
………আমি আপনার ছাত্রী স্যার।এইটে পড়ি।
……….ও…..।কী ব্যাপার,বলো?
………স্যার আমি আপনার বাড়ি এসেছি, কিন্তু চিনতে পারছিনা।
………তুমি আমার বাড়ি এসেছো? এতো সকালে? কী ব্যাপার? কোথায় তুমি?
………এই তো স্যার বড়ো মসজিদের পাশে দাঁড়িয়ে আছি। আপনি ক্লাসে একদিন বলেছিলেন ভাকুড়ির বড়ো মসজিদের কাছে আপনার বাড়ি। আপনার সঙ্গে খুব দরকার স্যার।
……..ও…, আচ্ছা, দাঁড়াও।
………হ্যাঁ স্যার।
চোখ রগড়াতে রগড়াতে রফিক মাস্টার বিছানা ছাড়ে। দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নেমে যায়। রেহেনা চিৎকার করে বলে কোথায় যাচ্ছ? এতো করে ডাকছি ঘুম থেকে উঠলেনা,আর একটা ফোন আসতেই দৌড়চ্ছো। কী ব্যাপার?কে এসেছে?
…..…না তেমন কিছু না। একটা ছাত্রী এসেছে।
…….…ছাত্রী?খেঁকিয়ে ওঠে রেহেনা।
……..হ্যাঁ।
……….কেন? এতো সকালে তোমার কাছে কেন?
……….হয়তো কোনো সমস্যা হয়েছে।
………সমস্যা হলে বাড়িতে আসতে হবে? তুমি কিন্তু ছাত্র ছাত্রীদের বড্ড লাই দিয়ে ফেলছো।কথায় কথায় তোমার বাড়িতে চলে আসবে? আমরাও মাস্টারদের কাছে পড়েছি। কিন্তু তোমার মতো মাস্টার আমি জম্মেও দেখিনি।
রেহেনার কথায় কথা না বাড়িয়ে রফিক তরতর করে নিচে নেমে যায়। দূরে দাঁড়িয়ে তৌফিকা।ও এগিয়ে আসে।
……….স্যার, আমাকে বাঁচান স্যার! আমি বড়ো বিপদে পড়ে আপনার কাছে এসেছি। আপনিই আমার ভরসা স্যার!
………কেন, কী হয়েছে? তুমি কাঁদছো কেন? এসো ঘরে এসো। আমি সব শুনছি।
তৌফিকাকে নিয়ে রফিক মাস্টার ঘরে ঢুকে। রেহেনাকে চা করতে বলে। রেহেনা রাগে গজগজ করতে থাকে। রফিক মাস্টার বুঝতে পারে ছাত্রীর বাড়িতে আসাটা রেহেনার পছন্দ নয়। কিছুক্ষণ পর রেহেনা ঠনাক করে চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে দিয়ে চলে যায়। রফিক মাস্টার চুপ থাকে। হাসিমুখে চায়ের কাপটায় একটা চুমুক দিয়ে বলে, হ্যাঁ বলো তৌফিকা, তোমার কী সমস্যা?
তৌফিকার চোখ দুটি ছলছল করছে।ও বলতে পারছেনা। ঠোঁট দুটো কাঁপছে।
………কী, বলো তৌফিকা।
বাম হাত দিয়ে চোখ দুটি মুছে নিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে তৌফিকা।ক্ষণিক চুপ থাকার পর কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, …….স্যার…। আমি লেখাপড়া করতে চাই ! আমি অনেকদূর পড়তে চাই স্যার…..!
……….ঠিক আছে, তুমি কাঁদছো কেন? তোমাকে লেখাপড়া করতে কে বারণ করেছে?
…………স্যার! আমরা তো খুব গরীব! আব্বু আমাকে আর লেখাপড়া করতে দেবেনা। হঠাৎই আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে।
………কী ?বলো কী তুমি? তুমি ক্লাসের সেরা ছাত্রী। তোমার বয়স সবেমাত্র ১৩ কি ১৪, আর তোমার বিয়ে দিয়ে দেবে বললেই হলো?
………..হ্যাঁ স্যার।সব ঠিক হয়ে গেছে। একসপ্তাহ পর বিয়ে।
…….কোথায়? ছেলে কী করে?
………সুন্দিপুর। রাজমিস্ত্রির কাজ করে।
……….. না না, এ বিয়ে হবে না। কিছুতেই না। একটা ফুলের মতো জীবনকে কিছুতেই অকালে ঝরে যেতে দেবো না। আমি দেখছি। তোমার আব্বুর সঙ্গে কথা বলবো।
তৌফিকার চোখ দুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ঠোঁটের কোণে একটু হাসির ঝলক খেলে গেল।ও বললো, সারারাত ঘুমোতে পারিনি স্যার।সকাল বেলায় মা বললো, তোর আব্বু আমার কথা শুনবেনা। এ সংসারে মেয়েদের কথার গুরুত্ব কেউ দেয়না।তুই প্রতিদিন তোদের রফিক মাস্টারের কথা বলিস না ?উনাকে গিয়ে সব খুলে বল। হয়তো তিনি তোর আব্বুকে বুঝিয়ে কিছু একটা করতে পারবেন।তাই স্যার…….।
……..বুঝলাম।তোমার আব্বু কী করেন?
………টোটো চালান।
……….ও।
…………আচ্ছা তুমি কিছু খাওয়া দাওয়া করে বাড়ি যাও,আমি তোমার আব্বুর সঙ্গে কথা বলবো।
………না স্যার! আপনি আমাদের বাড়ি চলুন। আমি এই বিষয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি জানলে আব্বু খুব বকবেন।
……….ঠিক আছে। তুমি এখন থাকো এখানে।মা কে ফোন করে জানিয়ে দাও তোমার ফিরতে দেরি হবে।
ঠিক আছে স্যার, মা কে জানিয়ে দিচ্ছি এই বলে কিছুটা সরে গিয়ে ফোনে কথা বলে নেয় তৌফিকা।স্নানে চলে যায় রফিক। স্নান সেরে একটু পরে জামা প্যান্ট পরে বাজার করে রেহেনার হাতে তুলে দেয়। রেহেনার মুখ গম্ভীর। গজগজ করতে করতে জিজ্ঞেস করে, তোমার ছাত্রী কি এখানেই খাবে? ওকে বাড়ি পাঠালেনা কেন?
…..….হ্যাঁ, এখানেই খাবে। ওকে একা ছাড়া ঠিক হবে না। আমি ওকে নিয়ে ওদের বাড়ি যাবো।
……….ছাত্রীর বাড়ি যাবে? কেন যাবে?
………. এই টুকু মেয়ে।ওর বাবা এই বয়সেই বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে।
……… তাতে তোমার কি?
………..দেখো রেহেনা,তৌফিকা একটা বাচ্চা মেয়ে।ক্লাস এইটের ছাত্রী। খুব মেধাবী। এখন কি ওর বিয়ে দেওয়ার সময় তুমিই বলো?
……… তাতে তোমার সমস্যা কিসের? সে সব ওর বাপ মা বুঝবে!
……… রেহেনা, তুমি এটা ঠিক বলছো না। ও তো আমার ছাত্রী। ও বিপদে পড়ে আমার কাছে এসেছে।ওর পাশে দাঁড়ানো আমার কর্তব্য।
…….. বিয়ে ভাঙ্গাটা কি তোমার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে রফিক?
……. অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়াটা অপরাধ তুমি জানো না রেহেনা? এর কূফল নিশ্চয়ই তোমার জানা আছে?
…….. জানি, কিন্তু তুমি এসবের মধ্যে থাকবে না এই আমি বলে দিলাম। আরও অন্য মাস্টার আছেন তাদের কাছে যাক না।
…….. দেখো রেহেনা,আমি কি সেটা ওকে বলতে পারি? ও আমার সাহায্য চেয়েছে।ওর পাশে আমাকে দাঁড়াতেই হবে।
……….ও, তাহলে তুমি আমার কথা শুনবেনা?
…………. কেন শুনবো না। তোমার সব কথাই তো শুনি।
…………শুনছো কোথায়? আমি বলছি তুমি বিয়ে ভাঙ্গতে ঐ ছাত্রীর বাড়িতে যেতে পারবেনা।
………..কেন তোমার এতো আপত্তি বুঝতে পারছি না রেহেনা?
……….আমি ওসব বলতে পারবো না। তুমি যাবেনা ব্যাস। তুমি ওর বাবাকে ফোন করে দাও।এসে নিয়ে যাক।
………..এসব কী বলছো তুমি?
………আমি ঠিকই বলছি। তুমিই একা মাস্টার নও যে সব দায়িত্ব তোমাকেই নিতে হবে।
………..আচ্ছা, তোমার কী সমস্যা বলো তো?ও আমার ছাত্রী। আমার মেয়ে।ওর বিপদে আমি দূরে থাকি কী করে? তাছাড়া তুমি সব মাস্টারের সঙ্গে আমার তুলনা করছো কেন? তুমি তো জানো, আমি এই রকমই। আমার ছাত্র ছাত্রী বিপদে পড়বে আর আমি চুপচাপ বসে দেখবো সেই গোত্রের শিক্ষক আমি নই। আমি অবশ্যই তার পাশে দাঁড়াবো।
রেহেনা আর কথা বলে না।মুখ ঘুরিয়ে গজগজ করতে করতে আবার রান্না ঘরে ঢুকে যায়। রফিক মাস্টার অন্য ঘরে ঢুকে। আনমনা হয়ে তৌফিকা অপরাধীর মতো বিছানায় বসে আছে। রফিক নিজেকে স্বাভাবিক করে নেয়। তৌফিকার সঙ্গে কথা বলে। ওকে আশ্বস্ত করে।
………..স্যার,ম্যাডামের মুখ ভার কেন?কী হয়েছে স্যার?
……….কিছু না,এমনি ।
………আমার আসাতে কি কোনো সমস্যা হয়েছে স্যার?
………..না না,তা হবে কেন? তোমার ম্যাডাম খুব খুশি হয়েছেন। আচ্ছা ওসব ছাড়ো।চলো খাবে।
তৌফিকা খেতে বসে লজ্জা পায়।অল্প কিছু মুখে দিয়ে উঠে পড়ে। রেহেনা রান্না ঘর থেকে উঁকি দিয়ে দেখে। কিছু বলে না। রান্না ঘরে বাসন কোসনের ঝনঝন শব্দে রেহেনা কী বলতে চাই রফিকের বুঝতে বাকি থাকে না।
রফিক মাস্টার তার স্ত্রীর আচরণে খুব কষ্ট পায়। নিজেকে সামলে নিয়ে গাড়ি বের করে। তৌফিকাকে নিয়ে তাদের বাড়ি পলাশডাঙ্গায় যায়। গ্রামের সরু অলি গলি পেরিয়ে একটা পাটকাঠির বেড়া দেওয়া ভগ্নপ্রায় জরাজীর্ণ বাড়ির পাশে এসে দাঁড়ায়।তৌফিকা হাতের ইশারায় দেখিয়ে দিয়ে বলে, স্যার,এটাই আমাদের বাড়ি! ভিতরে আসুন স্যার!।মা…..! মা.. গো…! দ্যাখো, স্যার এসেছেন।
একদৌড়ে তৌফিকা বাড়ির মধ্যে ঢুকে যায়। মুখে লম্বা ঘোমটা টেনে তৌফিকার মা ছুটে আসেন।
………….তৌফিকা, মাস্টার মশাইকে ঘরে নিয়ে যা। আমি চা করে নিয়ে আসি আর তোর আব্বুকে ডেকে দিই।
………না না,চা করতে হবে না। আপনি ওর আব্বুকে ডেকে দিন আর আপনিও সঙ্গে থাকবেন।
………তাই বললে হবে স্যার? গরীবের বাড়ি এসেছেন, কিছুতো আপনাকে খেতেই হবে।
………..ঠিক আছে, তাহলে শুধুমাত্র চা।
ভাঙ্গা ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকে তৌফিকা। কিছুক্ষণ পর তৌফিকার আব্বু এলেন। উস্কোখুস্কো শরীর। রোগাটে গড়ন।শরীর খারাপ হওয়ায় ক’দিন টোটো বের করতে পারেন নি।
………আসসালামু আলাইকুম মাস্টার মশাই।
………..ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছেন ভাই?
……….গরীবের আবার ভালো থাকা মাস্টার মশাই!
………….হুম্। বসুন। আপনার সঙ্গে কিছু কথা বলতে এসেছি।
………..বলুন মাস্টার মশাই। আপনার কথা তৌফিকার মুখে অনেক শুনেছি।
………..তৌফিকা লেখাপড়ায় খুব ভালো। আমার বিশ্বাস ও অনেকদূর যেতে পারবে। অনেক বড়ো হবে ও। শুধু আপনাদের সহযোগিতা দরকার।
……….মাস্টার মশাই, আমরা গরীব মানুষ। বেশি লেখাপড়া করানোর ক্ষমতা আমাদের নেই। এখন ও বড়ো হয়েছে। গ্রামের পরিবেশ একদম ভালো নয়।বাপ মায়ের মান সম্মান নষ্ট করে ক’দিন আগে গ্রামের দুটি মেয়ে গ্রামেরই দুই বখাটে ছেলের হাত ধরে বেরিয়ে গেছে। সমস্যাটা বুঝতেই তো পারছেন মাস্টার মশাই! খুব চিন্তায় থাকি।
…..…চিন্তা কিসের? আপনার মেয়ে ঠিক থাকলে কেউ ওর কিচ্ছু করতে পারবেনা। তৌফিকা সেরকম মেয়েই নয়। ওদের শাস্তি আপনার মেয়ে পাবে কেন? ওকে পড়াশোনা করতে দিন। আপনি গরীব মানুষ বলে মেয়েটাকেও সারাজীবন গরীব করে রাখবেন? ওকে বড়ো হওয়ার সুযোগ করে দিন। পিতা হিসেবে এটি আপনার দায়িত্ব।অন্য কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাবেন। কিন্তু লেখাপড়া বন্ধ করবেন না। টাকা পয়সার অভাবে ওর লেখাপড়া বন্ধ হবে না। আমরা আছি। তাছাড়া সরকারও চায় সবাই লেখাপড়ার সুযোগ পাক। ওদের জন্য সরকারিভাবে অনেক সুযোগ সুবিধা রয়েছে। আপনি চিন্তা করবেন না।
…..…..মাস্টার মশাই….। আগামী সপ্তাহে ওর…..!
……..কী আগামী সপ্তাহে?
…..……গ্রামেরই ছেলে। খুব কর্মী। পাড়ার মোড়ল মাতব্বররাই আমাকে ঠিক থাকতে দেয়নি। আমি তৌফিকার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছি।
……..আপনি বলছেন কী? আপনি মেয়েটির কতবড়ো সর্বনাশ করতে চলেছেন ভেবে দেখেছেন? এই অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে একটা মেধাবী মেয়ের জীবন নষ্ট করবেন?
………….তা কেন করবো মাস্টার মশাই!
………তাই ই তো করছেন। আপনি জানেন, অল্প বয়সে বিয়ে দিলে তার পরিণাম কতো ভয়ঙ্কর হয়? ওদের মতো মেয়েদের এখন খেলাধুলা করার সময়। নিজেকে গড়ার সময়।আর এই অপরিণত বয়সে আপনি বিয়ে দিয়ে দেবেন? যে মেয়েটি বড়ো হওয়ার কত স্বপ্ন দেখে, তার সেই স্বপ্নগুলো পূরণ করার সুযোগ না দিয়ে নিজে হাতে তা ভেঙে চুরমার করে দেবেন?আপনি ভাবছেন এতেই আপনার মুক্তি?
………..আমি বিয়ে করতে চাইনা আব্বু। তুমি আমাকে জোর করনা প্লিজ! আমি লেখাপড়া করতে চাই আব্বু। কান্নাকাটি শুরু করে তৌফিকা।
মা এসে মেয়ের পাশে দাঁড়ান। মেয়েকে সান্ত্বনা দেন। আমি তো চাই, তুই অনেকদূর পড়ালেখা কর। কিন্তু তোর আব্বুকে পাড়ার লোকজন ঠিক থাকতে দিচ্ছে না। বলছে,যুগ জামানা ভালো না। মেয়ে শিয়ানা হয়েছে। তাছাড়া ভালো ছেলে যখন সম্বোন্ধ নিয়ে এসেছে তখন তোর আব্বু আর অমত করেনি। তুই চিন্তা করিস না মা। বিয়ের পরেও তো অনেকে পড়াশোনা করে।চাইলে তুইও করবি।আমরা ছেলের বাড়ির সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলে নেবো।
রফিক মাস্টার তৌফিকার মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি জানেন, মেয়েদের ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ে দেওয়া আইনতঃ দণ্ডনীয় অপরাধ?
তৌফিকার মা চুপ থাকেন। শুধু ঘাড় নাড়িয়ে রফিক মাস্টারের কথায় সায় দেন।
রফিক মাস্টার বলতেই থাকেন,-
এই অপরিণত বয়সে বিয়ে দিলে আপনার মেয়ে যখন গর্ভবতী হবে তখন তার মৃত্যুর ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যাবে।এমনকি গর্ভস্থ শিশুর মৃত্যুর আশঙ্কাও তৈরি হবে।অপুষ্টিজনিত কারণে অনেকসময় ভূমিষ্ঠ সন্তানও মারা যায়। আবার যদি বেঁচেও থাকে তাহলে পরবর্তীতে এসব শিশুরা বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক জটিলতায় ভোগে।এসব জানার পর আপনারা নিশ্চয়ই চাইবেন না আপনাদের প্রিয় সন্তানের কোনো ক্ষতি হোক?
মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ বসে থাকেন তৌফিকার আব্বু। চোখে মুখে গভীর চিন্তার ছাপ। একবার করুণ মেয়ের মুখের দিকে তাকান একবার রফিক মাস্টারের দিকে। যেন কিছু বলতে চায়ছেন কিন্তু বলতে পারছেন না। কিছুক্ষণ পর বিড়বিড় করে আমতা আমতা করে বলতে লাগলেন ,………কিন্তু মাস্টার মশাই, আত্মীয়স্বজনদের অনেককেই তো নেমন্তন্ন করে ফেলেছি।যোগাড় যন্তনা প্রায় শেষের দিকে। তাহলে এখন উপায় কি? ছেলের পক্ষকে বা কী বলবো?
…… আপনি বলবেন, আপনার মেয়েকে লেখাপড়া করাবেন। আইনের বিরুদ্ধে গিয়ে অল্প বয়সে বিয়ে দেবেন না।
………..মাস্টার মশাই ঠিকই বলেছেন। যা হয় হবে,তুমি এই বিয়ে ভেঙে দাও। এতো অল্প বয়সে আমরা মেয়ের বিয়ে দেবনা। সবাইকে জানিয়ে দাও,আমাদের মেয়ে এখন লেখাপড়া করবে।লোকে যা খুশি বলে বলুক গে। কী গো তৌফিকার আব্বু,শুনছো?
তৌফিকার আব্বু মুখ তুলে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। রফিক মাস্টারের দিকে মুখ ঘুরিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ঠিক আছে মাস্টার মশাই, আমরা এই বিয়ে দেবো না। আপনাকে কথা দিচ্ছি।এই বিয়ে ভেঙে দিলাম।মেয়ের সুন্দর জীবন আমি নষ্ট হতে দেবো না। আমার মেয়ে পড়ালেখা করবে। আমার যতই কষ্ট হোক, যতদূর তৌফিকা পড়বে ততদূর আমি ওকে পড়াবো। শুধু একটা অনুরোধ মাস্টার মশাই, ওর প্রতি খেয়াল রাখবেন একটু। একটু পাশে থাকবেন।
…………..অবশ্যই তৌফিকার পাশে আমরা সবাই রয়েছি। আমার বিশ্বাস, তৌফিকা একদিন প্রমান করে দেবে মেয়েরাও অনেক বড়ো হতে পারে।দেখবেন ওই হবে সব মেয়ের অনুপ্রেরণা।
আপনি দোয়া করবেন স্যার, বললো তৌফিকা।ওর চোখে মুখে হাসির আভা। ভালো লাগে রফিক মাস্টারের।এটাই তো সে চাই।
………..আচ্ছা, তাহলে আমি আসি! কোনো সমস্যা হলে অবশ্যই ফোন করবে। আর তৌফিকার আব্বু আম্মু আপনাদের বলছি, আপনারা ওকে শুধু মেয়ে ভাববেন না।ও আপনাদের ছেলের থেকে কোনো অংশে কম নয়। দেখবেন ও একদিন আপনাদের মুখ উজ্জ্বল করবে। ভরসা রাখুন।
……….….ঠিক আছে মাস্টার মশাই।আবার আসবেন।
………….হ্যাঁ আসবো।
গাড়িতে স্টার্ট দেয় রফিক মাস্টার। মনে মনে ভাবে, ফিরতে আজ বেশ দেরি হয়ে গেছে। বাড়িতে আজ রণক্ষেত্র বাঁধবে।একেই তো রাগ করে আছে রেহেনা। মনে ভীষণ ভয় হচ্ছে! রেহেনা যদি উল্টোপাল্টা কিছু ভাবে! যদি কিছু বাড়াবাড়ি হয়ে যায়!যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে! তাহলে কী হবে! মনকে শক্ত করে রফিক।গাকুন্দা হয়ে গজধর পাড়া মোড় থেকে পশ্চিম দিকে বাঁক নিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলে। ততক্ষণে পশ্চিম আকাশে সূর্যটা অস্ত যেতে বসেছে।তার লাল আভার ঝলকানি চিন্তিত রফিক মাস্টারের মুখের উপর পড়ে তাকে অপূর্ব সুন্দর দেখাচ্ছে।