পাঠকের কলমে

হিংসার বিরুদ্ধে এবং সম্প্রীতির পক্ষে আওয়াজ তুলুন!

বাংলাদেশের কুমিল্লায় একটি দুর্গাপুজোর মণ্ডপে যেভাবে পবিত্র কোরানের অবমাননা করা হয়েছে সেটা অত্যন্ত নিন্দনীয়। দোষীদের চিহ্নিত করে দ্রুত শাস্তি দেওয়া দরকার। ওই ঘটনাটা কে বা কারা ঘটাল সেই সত্যটা এখনো উন্মোচিত হল না এটা দুর্ভাগ্যজনক।

বাংলাদশে ইসলামী মৌলবাদীরা যেভাবে এই ঘটনার প্রতিবাদ করার নামে জেলায় জেলায় সংখ্যালঘু হিন্দুদের পুজো মণ্ডপ আক্রমণ করেছে এবং দাঙ্গা বাঁধিয়েছে, সেটা আরও বড় অন্যায়। কুমিল্লায় কোরানের অবমাননা কে করেছে তা প্রমাণ হওয়ার আগেই এই মৌলবাদী বর্বরেরা বাংলাদেশের অন্যান্য জায়গায় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সংগঠিত হিংসায় লিপ্ত হয়েছে। এতেই বোঝা যায় মৌলবাদী শক্তিরা এইরকম একটি সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিল। কোরানের অবমাননাটা একটা অজুহাত।

প্রতিবেশী বাংলাদেশের এই সাম্প্রদায়িক হিংসা রোধে হাসিনা সরকারের পুলিশ-প্রশাসন কিছুটা দেরিতে হলেও পদক্ষেপ নিয়েছে। উৎসবের সময় এইরকম দুর্ঘটনা না ঘটতে দেওয়ার ক্ষেত্রে ওই দেশের সরকার আরও তৎপরতা দেখালে ভালো হত। সাম্প্রদায়িক হিংসা ঠেকানো এবং দাঙ্গায় লিপ্ত সমস্ত দোষীদের গ্রেপ্তার করে শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে হাসিনা সরকারের পাশে দাঁড়াবেন এবং মৌলবাদীদের জনবিচ্ছিন্ন করবেন, এটাই প্রত্যাশা।

বাংলাদেশের এই দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গেও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ানোর অপচেষ্টা চলছে। কেউ বাংলাদেশে কোরানের অবমাননার প্রতিশোধ নিতে আমাদের রাজ্যে হিংসার উস্কানি দিচ্ছে, কেউ কেউ আবার এই সুযোগে এখানকার সংখ্যালঘু মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াচ্ছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিন্দু সংখ্যালঘুদের উৎসবের প্রেক্ষিতে সাম্প্রদায়িক হিংসার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বলেছেন “ধর্ম যার যার, উৎসব সবার”। তাকে ব্যঙ্গ করে পশ্চিমবঙ্গের এক পীরজাদা “বিয়ে যার যার, বৌ সবার”, এই জাতীয় নোংরা, নারীবিদ্বেষী এবং সাম্প্রদায়িক মন্তব্য করে সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়াচ্ছে। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।

আজকের সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়িয়ে বা ধর্মীয় উস্কানি দিয়ে হিংসা সংগঠিত করা অনেক সহজ হয়ে গেছে। বিভিন্ন দেশে সোশ্যাল মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণ এবং ঘৃণাজনিত অপরাধের (Hate Crime) বিরুদ্ধে নতুন আইন আনা হয়েছে বা হচ্ছে। ভারতের সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদী, সংখ্যালঘু-বিরোধী মোদী সরকার সাম্প্রদায়িক ঘৃণা এবং হিংসা ছড়িয়েই ক্ষমতায় টিকে আছে, তারা এই ধরণের আইন কোনদিনই আনবে না। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষা করার নামে ভোট জিতে আসা তৃণমূল কংগ্রেস সরকার সাম্প্রদায়িক হিংসা এবং ঘৃণাজনিত অপরাধ রোধে পশ্চিমবঙ্গে এই ধরণের আইন প্রণয়ন করছে না কেন?

২০১৬, ২০১৭, ২০১৮-তে পশ্চিমবঙ্গে দুর্গাপুজোর ভাসান, মহররম, রামনবমী, নবী দিবস ইত্যাদি ধর্মীয় উদযাপনকে কেন্দ্র করে রাজ্যে একের পর এক জায়গায় সুপরিকল্পিত ভাবে দাঙ্গা লাগানো হয়েছিল, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ করার লক্ষ্যে। চন্দননগর, হাজিনগর, ধূলাগড়, বাদুরিয়া, বসিরহাট, আসানসোল — ঘটনাগুলি অনেকেরই মনে আছে। এই দাঙ্গাগুলিতে দোষীদের চিহ্নিত করে শাস্তি দিতে পারলে আজ বাংলাদেশ নিয়ে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেওয়ার সাহস কেউ পেত না। ভারতের দণ্ডবিধিতে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা বা হিংসা ছড়ানোর বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট বেশ কয়েকটি ধারা আছে। কিন্তু অন্যান্য রাজ্যের মতনই পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ-প্রশাসন রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ইত্যাদি বিষয়গুলিকে শাসক দলের রাজনৈতিক স্বার্থের চশমা দিয়েই দেখতে অভ্যস্ত, তাই হিংসা-দাঙ্গা ঘটলেও সুবিচার হয় না।

বরং সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে রাজ্য সরকার কখনো দুর্গাপুজোর কমিটিগুলিকে ৫০ হাজার টাকা সরকারি অনুদান দেয়, আবার কখনো সরকারি কোষাগার থেকে ইমামদের ভাতা দিতে যায়, কখনো হনুমান জয়ন্তীর মিছিল করায় — এর কোনটাই ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষা নয়, বরং সব ধর্মের নামেই সুড়সুড়ি দেওয়া প্রচেষ্টা। এইসব বন্ধ করে পশ্চিমবঙ্গে যাতে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা-হিংসার রাজনীতিকে প্রতিহত করা যায়, সরকার-পুলিশ-প্রশাসনের অবিলম্বে সেই ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ।

বাংলাদেশ হোক বা পশ্চিমবঙ্গ, দুই বাংলার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই হিন্দু এবং মুসলমানদের মিলেমিশে, সৌহার্দ্যের পরিবেশে থাকার পক্ষপাতী। বিগত প্রায় আট-নয় শতক ধরে বাংলায় মুসলমান এবং হিন্দুরা একসাথেই থেকে এসেছে। কিন্তু দুই সম্প্রদায়েরই কিছু মুষ্টিমেয় লোক আছে, যারা মানবিকতা এবং সম্প্রীতির পরিপন্থী সাম্প্রদায়িক এবং মৌলবাদী মতাদর্শকে বেছে নিয়ে বিভাজনের রাজনীতিতে মেতে থাকে। এদের জন্যেই একসময় দেশভাগ হয়েছিল।
আজকের প্রেক্ষিতেও দুই বাংলার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে, সমস্ত রঙের সাম্প্রদায়িক এবং মৌলবাদী শক্তিদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে হবে, এদের জনবিচ্ছিন্ন করতে হবে। বিপদের দিনে, এক বাংলার মানুষ অন্য বাংলার মানুষের পাশে দাঁড়াবেন, এটাই ত আমাদের ঐতিহ্য।

প্রসেনজিৎ বসু
কলকাতা, ১৭.১০.২১

Back to top button
error: