Highlightইতিহাস ঐতিহ্যদেশ

ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শহীদ হয়েও ভারতীয় ইতিহাসে জায়গা না পাওয়া মুসলিম নারীদের সংগ্রামী জীবন

মোকতার হোসেন মন্ডল, টিডিএন বাংলা: কোলে শিশু।পেটে সন্তান।রাতের খাবার মুখে তোলার সময়টুকু মেলেনি।মুক্তির নেশায় হেঁসেলের সব কাজ করে ওঠাও হয়নি। মাজেরা খাতুন কী পুরুষ? নামটা শুনে তো মনে হচ্ছে না৷ তবে পরনে মোটা পাজামা, পায়ে মোজা, শক্ত জুতো আর গায়ে মোটা কোট কেন? মাথায় যে পাগড়ি দেখছি? হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন, মাজেরা নারী৷ ইংরেজ সরকারের অত্যাচারের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য পুরুষের মতো এমন বেশ ধারণ করে হঠাৎ আক্রমণ চালাতেন৷ মাথায় চুল ঢেকে তার উপর পাগড়ি পরতেন৷ নিজস্ব একটি মহিলা বাহিনীও গড়ে তুলেছিলেন তিনি কিন্তু মাজেরার চালাকি দুর্ধর্ষ ইংরেজ শক্তি একদিন ধরে ফেলল, শুরু হলো দুই পক্ষের প্রচন্ড লড়াই ৷ মাজেরার বাহিনী পরাজিত হল৷ মাজেরা ও তার মহিলা সঙ্গিনীরা শহিদ হলেন ৷ শুধু মাজেরা নয় পুরুষ বেশধারী বহু মহিলাকে পুলিশ গ্রেফতার করে পাশবিক অত্যাচার চালাল৷ কিন্তু অবাক হওয়ার কথা হলো শহিদ বা আটক হওয়ার আগে পর্যন্ত ইংরেজ সরকার বুঝতে পারেনি যে এরা মহিলা না পুরুষ৷ মাজেরা লড়াইয়ে শহিদ হলেন৷ কিছু জামিলা খাতুনের ভাগ্যে তখনই তা জোটেনি৷

অরুণা আসাফ আলি, স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি প্রখ্যাত নাম। জন্মসুত্রে তিনি অরুনা গাঙ্গুলী নামে পরিচিত। আসাফ আলির সাথে বিবাহের পর তিনি ভারতীয় কংগ্রেসের সক্রিয় সদস্য হন এবং সত্যাগ্রহ আন্দলনে যোগদান করেন। পরবর্তীকালে তিনি ভারত ছাড়ো আন্দলনেও যোগ দেন এবং সেই আন্দোলনের এক অন্যতম চরিত্র হয়ে ওঠেন। ১৯৩২ সালে সরকার বিরোধী কাজের জন্য তাঁকে তিহার জেলে পাঠানো হয়। সেখানে রাজনৈতিক বন্দীদের সাথে ভিন্ন ব্যবহার বন্ধ করার উদ্দ্যেশে তিনি অনশন শুরু করেন। তাঁর উদ্দ্যেশ্য সফল হলে খুব শীঘ্রই তাঁকে নির্জন কারাবাসের জন্য আম্বালা পাঠানো হয়।

১৮৫৭-এর মহা-বিদ্রোহের সময় বহু মুসলিমকে যখন ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল তখন বৃটিশ ক্যান্টনমেটে এক সঙ্গে অনেক ইংরেজ সৈন্যকে খতম করার পরিকল্পনা নি়য়েছিলেন জামিলা৷ কী সেই পরিকল্পনা? সৈন্যদের খাবার তৈরির সময় তাতে তীব্র বিষ মিশিয়ে দেওয়া৷ কিন্তু ধরা পড়ে গেলেন৷ প্ল্যান নস্যাৎ হয়ে শুধু গেল, পুলিশ তাকে গ্রেফতার করল৷ চালালো অকথ্য নির্যাতন, অবশেষে ফাঁসি দিয়ে এই বীর মহিলার আন্দোলনের স্পৃহাকে দমন করা হয়েছিল ৷ মাজেরা -জামিলা শহিদ হলে কী হবে, লড়াইয়ে নামলে মৃত্যুকে সঙ্গী করেই থাকতে হয় ৷ কিন্তু ওরা যে মাত্র দুই জন নয় হাজার হাজার মহিলা হেঁসেল সামলিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে পথে নেমেছেন যে৷

মহাম্মদ আলি ও সওকাত আলির মা আবেদা বিবি তো পুত্রদের উদ্দেশ্য ঘোষণা করেছিলেন তোরা অত্যাচারী ইংরেজ সরকারকে তাড়াতে না পারিস তবে কাল কেয়ামতের ময়দানে আমার দুধের ৠণ আমি দাবী করবো৷ বেরিয়ে পড় দুই কলিজার টুকরা, ইংরেজদের নস্যাৎ করে দে৷ তবে কী মুসলিম মেয়েরা যুদ্ধ করেছিলেন? বোরখা, মোল্লা -মৌলবিদের বাঁধা তাহলে কী হলো? না এটা কোন সমস্যাই নয় ৷ বর্তমানে বোরখা পরে হিজাব পরে ইরান, মিশর, লেবাননের মেয়েরা যে ভাবে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে স্বৈর শাসকদের ক্ষমতাচ্যুত করলেন, তেমনি পরাধীন ভারতে মুসলিম মহিলারাও দিন রাত পুরুষের মতোই ব্রিটিশদের বিপক্ষে জীবন -মরণ সংগ্রামে আবতীর্ণ হয়েছিলেন৷তাহলে আসগারী বেগম, মোহসিনা আকবর,রাবেয়া বেগম রুবি, রীনা ইয়াসমিন খান, নাসরিন মাহমুদ, মাহবুবা করিম, লিনভা রহমান, নাসিমুন্নেসা,আতিয়া বেগম জাকিয়াহ মনসুর, হাসুরুন্নিসা বেগম, লেডি মহম্মদ শফী, লেডি ইনাম, ডঃ কুমারী মাহমুদা, বিবি মুলুক, মিস জাফর আলি, ডঃ কে এন খানম,হোসনা বানু,সাকুরা খানম,বেগম হজরত প্রমুখ শত শত মুসলিম নেত্রীদের নাম.ইতিহাসে নেই কেন? এ নিয়ে বিতর্ক অনেক, যেখানে হাজার হাজার মুসলিম পুরুষ বিপ্লবীদের নাম লেখা থাকে না সেখানে আবার মহিলাদের নাম৷ এটি অবশ্যই ইতিহাসের কলঙ্ক৷

স্বার্থপর, সাম্প্রদায়িক, পুরুষতান্ত্রিক ইংরেজ মদদপুষ্ট ঐতিহাসিকদের জন্যই ওরা চাপা পড়ে আছেন৷ তবে আশার কথা এই সব বীর বিপ্লবীদের অবশ্যই খাঁটি ধর্ম নিরপেক্ষ ঐতিহাসিকদের গ্রন্থে এখনও স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে ৷আর আছে বলেই সভ্যতা চলছে৷ তা না হলে এক দিন চলতে চলতে পাপের চাপে আর শহিদদের কান্নায় সভ্যতা থমকে দাঁড়াত৷ শুধু মুসলিম মহিলারা নন, গুটিকতক অমুসলিম মহিলাদের নাম ছাড়া ইতিহাসে পুরুষের মতো তেমন মহিলাদের নাম চোখে পড়ে না৷ ক্ষুদিরাম নেতাজি, গান্ধীজীদের কাহিনি আমার জানি, কিন্তু গোপনে গোপনে এই সব স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতাদেরকে মহিলারা যে ভাবে সাহায্য করেছেন তা আমারা জানি না৷ আমারা জানি না স্বাধীনতা কামীদের মৃত্যুর পর তার পরিবারের মেয়েদের জীবন কী কষ্টের মধ্যে দিয়ে কেটেছে৷

আমারা এও জানিনা মিসেস হাসিনা মুরশেদের মতো ইঞ্জিনিয়ার, কুমারী মাহমুদার মতো শল্য চিকিৎসক, বেগম হাবিবুল্লার ন্যায় ম্যাজিস্ট্রেট, সৈয়েদা ফাতেমার মতো অর্থনীতিবিদ, মুওয়াইদজাদার মতো লেখিকা ও পত্রিকার সম্পাদিকা খাদিমা বেগমের ন্যায় লন্ডনে ডিগ্রী প্রাপ্ত ও আটটি ভাষার পন্ডিত, সুগরা হুমায়ুনের মতো প্রখ্যাত সাংবাদিক হাজার হাজার মহিলাদের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে তাদের কেরিয়ারকে কী ভাবে তিলে তিলে শেষ করে দিয়েছেন৷

পুরুষতান্ত্রিক নীতি বিবর্জিত সমাজ মহিলা স্বাধীনতা সংগ্রামী মর্যাদা না দিলেও দৌলাতুন্নেসার জেল খাটা কাহিনি, ২৪ পরগনার জেল খাটা মহিলা হোসনেআরার আন্দোলন, আসগরী বেগমের ইংরেজদের হাতে জীবন্ত দগ্ধ হওয়ার ঘটনা, আজিজুল বাঈ -এর গুলি খাওয়ার ইতিহাস, বীরঙ্গনা হযরত মহলের মি. নীল ও ক্যাপ্টেন চাপকে হত্যা করার রন কৌশল, নুরুন্নেসার গুপ্তচরবৃত্তির রোমাঞ্চকর কাহিনি আগামী দিনে ভারত ও বিশ্বের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে৷ আর বর্তমান নারী সমাজ পাবে আন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার মন্ত্র৷ দেশ মুক্তির এই মাসে চর্চার আড়ালে থাকা স্বাধীনতা সংগ্রামী মুসলিম বীরঙ্গনাদের প্রতি একটু শ্রদ্ধা জানানো প্রতিটি নাগরিকের স্বাভাবিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। (কলম পত্রিকা থেকে নেওয়া)

Related Articles

Back to top button
error: