রেবাউল মন্ডল, টিডিএন বাংলা: ২০১৬ সালের ৮ই নভেম্বরে জাতির উদ্দেশে দেওয়া সেই ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জানিয়েছিলেন যে, কালো টাকা, জাল নোট, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসবাদ- দেশের এই চার অভিশাপের সঙ্গে মোকাবিলা করতে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ৮ই নভেম্বর মাঝরাত থেকেই দেশের চালু ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট অবৈধ হয়ে যাবে।সেইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছিলেন, “আমি দেশের মানুষের কাছে ৫০ দিন সময় চেয়েছি। যদি ৩০ ডিসেম্বরের পর আমার কাজে আপনারা কোনও কমতি পান, বা যদি মনে করেন আমার উদ্দেশ্য ভালো নয়, তাহলে দেশবাসী আমাকে যা শাস্তি দেবেন, আমি মাথা পেতে নেব।”
এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই দেশজুড়ে তুমুল হৈচৈ। রাতারাতি বাতিল হল টাকা। আতঙ্কে লম্বা লাইনে দাঁড়ালো গোটা দেশ। ৯ই নভেম্বর বন্ধ করে দেওয়া হল সব ধরণের ব্যাঙ্কিং লেনদেন। তারও পরের দিন থেকে বহু মানুষের নিত্যদিনের রুটিন হয়ে গিয়েছিল সকালে গিয়ে পুরনো নোট ব্যাংকে জমা করে নতুন নোট জোগাড়ের জন্য আবারও লাইনে দাঁড়ানো। মহা ফাঁপরে পড়েছিলেন দেশের খেটে খাওয়া মানুষ। লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে পুলিশের লাঠিচার্জ সহ্য করতে হয়েছে। হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদতে দেখা গিয়েছিল বহু মানুষকে। কত অসহায় গরীব মানুষ না খেতে পেয়ে মারা গেছেন। বিভিন্ন রিপোর্ট বলছে, এই নোটবন্দির কারণে মারা গিয়েছিলেন প্রায় ১৫০ জন সাধারণ মানুষ।
দেশবাসীর এত কষ্ট, ত্যাগ, লাঞ্ছনার পরও কি দেশ মুক্ত হল জাল নোট থেকে? রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার প্রকাশিত একটি রিপোর্ট বলছে, ২০২১-‘২২ অর্থবর্ষে জালনোটের সংখ্যা বেড়েছে ১০.৭ শতাংশ। আশ্চর্যের বিষয় হল, ৫০০ টাকার নোট জাল হওয়ার সংখ্যা বেড়েছে ১০২ শতাংশ। দু’হাজার টাকার নোট জাল হয়েছে ৫৫ শতাংশর বেশি। তবে শুধু ৫০০ এবং ২০০০-এর নোটই নয়, ২০০, দশ, কুড়ি টাকার নোটও প্রচুর জাল হয়েছে।
অবাক হবার বিষয় যে, নোটবন্দির কিছু দিনের মধ্যেই বাজারে ২০০০ টাকার জাল নোট ছড়িয়ে পড়ে। ২০১৭ সালের জুন মাসের মধ্যে সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী এগারো কোটি টাকারও বেশি জাল নোটের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। তাহলে বেসরকারি হিসেব কত হবে, তা সহজেই অনুমেয়। অর্থাৎ জাল নোটের বিরুদ্ধে সরকারের ‘লড়াই’ যে একেবারেই বিফলে গেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এছাড়াও সন্ত্রাসবাদ দমনেও যে মোদীজি ডাহা ফেল তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।
নরেন্দ্র মোদী তাঁর ভাষণের শুরুতেই প্রথম যে উদ্দেশ্যটার কথা বলেছিলেন, তা হল দুর্নীতি বন্ধ আর কালো টাকা উদ্ধার। অর্থনিবিদদের মতে, মোট কালো টাকার খুব একটা সামান্য অংশই এভাবে উদ্ধার করা সম্ভব। বাতিল হয়ে যাওয়া নোটের ৯৯ শতাংশই তো ফেরত এসেছে। তাহলে কালো টাকা উদ্ধার হল কোথায়? পরিসংখ্যান বলছে, কালো টাকা দেশে ফেরত আসেনি উল্টে সুইস ব্যাঙ্কে আরও হাজার হাজার কোটি টাকা গচ্ছিত হয়েছে। জাল নোট বন্ধ তো দূরের কথা উল্টে আরও কয়েক গুণে জাল টাকার কারবার বেড়ে গেছে।
বিভিন্ন সমীক্ষায় উঠে এসেছে, নোটবন্দির প্রথম পঞ্চাশ দিনে দেশের অর্থনীতির ক্ষতি হয় ১.২৮ লক্ষ কোটি টাকা। প্রথম চার মাসে চাকরি যায় ১৫ লক্ষ মানুষের। জিডিপির হার বৃদ্ধি কমে যায় ২.২ শতাংশ। নতুন নোট ছাপতে খরচ হয়েছিল ২১ হাজার কোটি টাকা। এবার সবকিছু যোগ যদি করা যায়, তাহলে মোট ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় পাঁচ লক্ষ কোটি টাকায়। যার জেরে দেশের অর্থনীতিকে এখনও ভুগতে হচ্ছে।
দেশবাসী মোদীজির কথায় বিশ্বাস করেছিল, বিদেশ থেকে কালো টাকা ফিরিয়ে এনে প্রত্যেক ভারতীয়র ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা করে দেওয়া হবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে ৭৫ বছর ধরে তিল তিল করে গড়ে তোলা ভারতীয় সম্পত্তি একের পর এক বিক্রি হচ্ছে। পঞ্চাশ দিন পেরিয়ে কেটে গেছে আরও ছয়টি বছর। প্রধানমন্ত্রী মোদীজি তাঁর নোটবন্দির প্রতিশ্রুতি কবে পালন করবেন?