অর্ক ভাদুড়ী, টিডিএন বাংলা : এমন সময় খুব বেশি আসে না, যখন বেঁচে থাকা অর্থবহ বলে মনে হয়। ফিলিস্তিনে চলমান গণহত্যার বিরুদ্ধে দিনের পর দিন বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন জাতির লক্ষ লক্ষ মানুষের সঙ্গে হাঁটতে পারছি, এ আমার পরম সৌভাগ্য। প্যালেস্টাইন নিয়ে লেখা খুব কম মানুষের কাছে পৌঁছবে। রিচ কমিয়ে দেবে ফেসবুক। তবু লিখি।
গোটা সপ্তাহ ধরে চলে মিছিলের প্রস্তুতি, স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহ। অসংখ্য ছোট-বড়-মাঝারি বৈঠক। ইউনিয়নগুলির ব্রাঞ্চে ব্রাঞ্চে প্রচার৷ দেশ ছেড়ে চলে আসা ফিলিস্তিনিদের মাধ্যমে গাজা এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের সর্বশেষ পরিস্থিতি জানা, রেডক্রসের সঙ্গে যোগাযোগ। প্যালেস্টাইনের পক্ষে কথা বলে চাকরি হারানো বা বরখাস্ত হওয়া কর্মীদের আইনি সাহায্য দেওয়ার চেষ্টা। লক্ষ লক্ষ মানুষের সই সংগ্রহ করে কর্তৃপক্ষকে জমা দেওয়া।
এই সব টুকরো টুকরো জল প্রতি শনিবার প্রতিবাদের সমুদ্র হয়ে আছড়ে পড়ে লন্ডনে। প্রথম মিছিলে এসেছিলেন দেড় লক্ষ মানুষ। দ্বিতীয় মিছিলে তিন লক্ষ। আগামীকাল আবারও মিছিল।
আশ্চর্য সব চরিত্রের সঙ্গে পরিচয় হল এই কয়েকদিনে৷ ইজরায়েলের হামলায় কারও হাত উড়ে গিয়েছে৷ কারও দু’টো পা-ই নেই। কেউ দৃষ্টিহীন৷ দেশছাড়া মানুষগুলো হুইল চেয়ারে বসে স্লোগান দিচ্ছেন মুক্ত, স্বাধীন প্যালেস্টাইনের পক্ষে।প্রথম নকবায় ঘরছাড়া যে শিশু এখন বৃদ্ধ, তাঁর হাতে স্বাধীনতার পতাকা। এক ছেলেকে নিয়ে স্বামী থাকতেন গাজায়। দুই মেয়েকে নিয়ে মা লন্ডনে। বৃহস্পতিবার স্বামী-ছেলের মৃত্যুসংবাদ পেয়েছেন। শনিবার মেয়েদের নিয়ে সেই মা হাঁটছেন মিছিলে। প্রথম ইন্তিফাদায় পরিবারের সকলকে হারানো মানবাধিকার কর্মী হাঁটছেন। হাঁটছেন কমিউনিস্ট গেরিলা বাহিনী পিএফএলপি-র পতাকা হাতে তাঁদের সমর্থকরা।
হাঁটছেন লম্বা টুপি, কালো কোট, বিনুনী চুলের ইহুদিরা। অতিকায় ব্যানারে লেখা, ‘নট ইন মাই নেম’। জায়নবাদীদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাঁদের হাঁটা। হাঁটছেন হিটলারের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বন্দি দম্পতির মেয়ে। বৃদ্ধার হাতে ব্যানার, ‘আমি ইহুদি, আমি ফিলিস্তিনের পক্ষে’। সমুদ্রের জলে রোদ পড়লে যেমন ঝিকমিক করে ওঠে, জনসমুদ্রের বুকজুড়ে তেমনই অসংখ্য, অজস্র প্যালেস্টাইনের পতাকা। সমুদ্রে ভেসে চলা ছোট ছোট ডিঙির মতোই তার মাঝে মাঝে চোখে পড়ে লাল কাপড়ের বুকে আঁকা হাতুড়ি-কাস্তের নিশান৷
কত রকমের মানুষ, কত জাতের নিশান! কত পরস্পরবিরোধী মতাদর্শের মানুষ মিছিলে। বৃষ্টি পড়ছে৷ সাতরঙা পতাকার ছায়ায় নমাজ পড়ছেন একদল। স্মোক বম্ব। আকাশজুড়ে লাল ধোঁয়া। সবুজ ধোঁয়া। জনসমুদ্রের মাথার উপর পাক খেতে খেতে ওঠে স্বাধীন প্যালেস্টাইনের রং। গোটা মধ্য লন্ডন স্তব্ধ। পিছলে যাচ্ছে ডাউনিং স্ট্রিট, পিছলে যাচ্ছে ওয়েস্টমিনস্টার। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের রাস্তার পাশ দিয়ে, ট্রাফলগার স্কোয়ারকে পাক দিয়ে মিছিল হাঁটছে। চারদিকে ঘোড়সওয়ার পুলিশ, রায়ট পুলিশের নজরদারি৷ মোড়ে মোড়ে ব্যারিকেড। আকাশে হেলিকপ্টার।
মিছিলের মুখে বক্তৃতা করছেন বৃদ্ধ করবিন। সেই শব্দ মিছিলের গলার কাছে এসে ফুরিয়ে যায়। মিছিলের বুক, পেট, উরু বা লেজ তখনও বহুদূরে৷ পুলিশের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধে বা মুক্ত ফিলিস্তিনের গানে বাঁধা পড়ে আছে।
আমি সোভিয়েতের পতনের বয়সী। আমি ভিয়েতনাম দেখিনি। ইরাক-আফগানিস্তানের যুদ্ধ বিরোধী মিছিলে হাঁটিনি। ফিলিস্তিনের গণহত্যার আপডেট নিতে নিতে মনে হয় সমস্ত শরীর বুঝি অসাড় হয়ে যাবে৷ হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়, এর বুঝি কোনও শেষ নেই৷ দ্রৌপদীর শাড়ির মতো অলৌকিক মিছিল। তাতে ঢুকে পড়ছে হাতে নাম লিখে ঘুমোতে যাওয়া আরব শিশুর দল, যাতে বেওয়ারিশ লাশ হতে না হয়। ঢুকে পড়ছে প্রথম নকবায় মরে যাওয়া লোকজন, ইন্তিফাদায় শহীদ গেরিলারা। যারা মরতে ভয় পায় না, তাদের সমর্থনে স্লোগান দেব কোন সাহসে! ফিসফিস করে বলি, ভূতগ্রস্তের মতো বলি, বিড়বিড় করে বলি, ফ্রি ফ্রি প্যালেস্টাইন.. প্যালেস্টাইন একদিন মুক্ত হবে..