Highlightসম্পাদকীয়

ফ্যাসিবাদের মোকাবিলায় বাংলার জনগনের রায়কে অভিনন্দন

মুহাম্মাদ নুরুদ্দীন
মুহাম্মাদ নুরুদ্দীন

মুহাম্মাদ নুরুদ্দীন, টিডিএন বাংলা : ‘হুজুগে বাঙ্গাল’ বলে বাঙ্গালীদের একটা বদনাম আছে। আবার গোপালকৃষ্ণ গোখলে বাঙ্গালীদের দূরদৃষ্টির প্রশংসা করে বলতেন “বাংলা আজ যা ভাবে বাকি ভারত তা ভাবে আগামীকাল” বাঙালি মননে আপাত বিপরীতমুখী এই দুটি চরিত্র রীতিমতো ঘুম কেড়ে নিয়েছিল বুদ্ধিজীবি মহলের। টানটান উত্তেজনায় কেটেছে দিনের-পর-দিন। মাসের-পর-মাস।

শেষ পর্যন্ত কি হবে? সচেতন বাংলা কি হেরে যাবে হুজুগে বাংলার কাছে? মেরুকরণের রাজনীতি কি জয়লাভ করবে সম্প্রীতির এই বাংলায়? অমিত মোদির বর্গী আক্রমন কি শেষ পর্যন্ত ছারখার করে দেবে বাঙালির সৃজনশীল সংস্কৃতিকে? সত্যি সত্যিই কি রামমোহন, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের লালিত আদর্শ শেষ পর্যন্ত পদদলিত হবে উগ্র সাম্প্রদায়িকতার কাছে? টান-টান উত্তেজনায় বারবার এ প্রশ্ন উঠে এসেছে।

সচেতন মানুষ কান পেতে শুনতে চেয়েছে যে এনআরসি প্রশ্নে কি মতুয়া সমাজ বিজেপির ধোঁকায় পা দেবে? কোন দিকে যাবে তারা? হরিচাঁদ গুরুচাঁদ এর আদর্শ না অমিত শাহের গালভরা বুলি? বারবার উঠে এসেছে এ প্রশ্ন।

মানুষ জানতে চেয়েছে যে শুভেন্দু অধিকারীর নোংরা সাম্প্রদায়িকতার খেলা কি মেনে নেবে বাংলার মানুষ? বাংলা তার চির লালিত ঐতিহ্যের প্রতি অনুগত থাকবে কি না। আব্বাস সিদ্দিকী, আসাদউদ্দিন ওয়াইসিরা বাংলায় যে হুজুকে রাজনীতির আমদানি করতে চাচ্ছেন তাকি শেষ পর্যন্ত কিছু মানুষকে প্রভাবিত করবে? শেষ পর্যন্ত কি এই হুজুগে রাজনীতির প্রভাব ধর্মনিরপেক্ষ ভোটকে বিভাজিত করে বর্গী হানার পথকে সুগম করে দেবে? এরূপ নানা প্রশ্নের উত্তর পেতে উত্তেজনার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে বিগত কয়েক মাস।

গণনা শুরু হতেই যেন এক ঝটকা কালো মেঘ ঘিরে ফেলল বাংলার আকাশকে। মুহূর্তের মধ্যে যেন নিভে গেল সকল আলো। তাহলে কি আশঙ্কা বাস্তবায়িত হতে চলেছে? ব্যালট ভোটের মতোই যদি সাধারন ভোট হয় তাহলেতো রক্ষে নেই। কিন্তু না, বেলা বাড়ার সাথে সাথেই চিত্র পাল্টাতে শুরু করলো। দুশ্চিন্তার কালোমেঘের ঘনঘটা কাটতে বেশি সময় লাগল না। চাকুরীজীবী বাঙালি বাবু আর বাঙালি আমজনতা যে এক নয় তা আবার বোঝা গেল। বাংলা জানিয়ে দিল তার রায়। বাংলা জানিয়ে দিল তারা সম্প্রীতি ভালোবাসে সাম্প্রদায়িকতা নয়। বাংলা জানিয়ে দিলো তারা শুধু হুজুগে নয় বরং সচেতন।তারা অনেক সুদুরপ্রসারি চিন্তাভাবনা করেই সিদ্ধান্ত নিতে জানে। বাঙালি সম্পর্কে গোখলের ভাবনা যে অমূলক নয় বাঙালি সমাজ তা আবার প্রমান করে দিল।

টেলিভিশনের পর্দায় এক বাঙালি বিশ্লেষক তো মন্তব্য করেই ফেললেন, যে আমরা মুসলমানের দোকানে বিরিয়ানি খাওয়া হিন্দু। অমিত শাহজি সে ব্যাপারটা বুঝতে পারেননি। তাই তিনি আমাদেরকে বিভাজন করতে চেয়েছেন। এই জায়গাটাতেই তার সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা । তাই আজ এই পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে তাকে ফিরতে হলো।

বাংলার ভোট আবার প্রমাণ করলো আমাদের মুনি-ঋষিদের গোড়ে তোলা সম্প্রীতির আদর্শ থেকে বাংলা আজও হটে যায় নি। যে যাই বলুক না কেন মেরুকরণের ফাঁদে তারা আর পা দিতে চায়না। এবারের বিধানসভা ইলেকশনে তা পরিষ্কার হয়ে গেল। একদিন বাংলার বিদ্রোহী কবি প্রশ্ন তুলেছিলেন, “হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কান্ডারী বলো, ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার।’ আজ বাংলার জনগণ ইভিএম মেশিনে তাদের রায় প্রদান করে সেই একই প্রশ্ন ছুড়ে দিল সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের দিকে। কথায় কথায় হিন্দু-মুসলিম প্রশ্ন কেন? কেন নির্বাচনের ইস্যু হবে না উন্নয়ন? কেন মানুষের ভালো থাকা না থাকার থেকে বড় হয়ে উঠবে তার ধর্ম পরিচয়? গ্যাসের দাম, তেলের দাম, কোভিড নাইনটিনের মুকাবিলায় চূড়ান্ত অব্যবস্থা। তার মোকাবেলা করতে ব্যর্থ কেন্দ্রীয় সরকারের দায়– এসব প্রশ্ন নিয়ে নির্বাচনে কোনো আলোচনা হবে না? শুধু হিন্দু মুসলিম, হিন্দু মুসলিম করে গেলে যে মানুষের মন পাওয়া যায় না বাংলার রায় তা আবার বুঝিয়ে দিল।

মতুয়া সমাজ বাংলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সব সময় টানটান উত্তেজনার মাঝে আলোচনায় উঠে এসেছে মতুয়া সমাজের প্রসঙ্গ। কোনদিকে যাবে তারা? নাগরিকত্বের দোলাচলে তারা কি অমিত শাহের অমৃত বাণীতে ভুল বুঝবে? তারা কি নাগরিকত্ব পাওয়ার লোভে তাদের বাধা ফাঁদে পা দেবে? নাকি সিএ এনআরসির এইসব ধাপ্পাবাজি ফু দিয়ে উড়িয়ে তারা সনাতন ভারতের পাশে থাকবে? এবারের এই নির্বাচনে মতুয়া সমাজ মনে রেখেছে তাদের আরাধ্য হরিচাঁদ গুরুচাঁদ এর আদর্শ। তারা বিজেপির ধোকায় পা দিয়ে বোকা হতে চায়নি। তারা বুঝিয়ে দিয়েছে তোমার সোনার বাংলা আমার চাই না। আমার চাই, মিলনের ভারত বর্ষ। তাই তারা সমস্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও গেরুয়া শিবিরকে হতাশ করেছে।

মতুয়াদের মত মুসলিম সমাজ ও সমানভাবে ছুঁড়ে ফেলেছে হুজুকে রাজনীতিকদের। যারা কোনো প্রস্তুতি না নিয়েই গরম গরম বুলি আউড়ে কিং মেকার হতে চেয়েছিল। যারা কথায় কথায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে আস্ফালন করেন কিন্তু রাজনীতির আঁতুড়ঘর থেকে বেরোনোর আগেই দুর্নীতির পাকে নিমজ্জিত হয়ে যান বাংলার মুসলমানরা তাদেরকেও পাত্তা দেয়নি। এক্ষেত্রে জোশের থেকে হুঁশকে তারা গুরুত্ব দিয়েছে।

উগ্র ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে উদার মানবিকতা বাদের, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের এই লড়াইয়ে অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য সেই সকল সেনানী যারা প্রকাশ্যে এবং গোপনে নিরলসভাবে পরিশ্রম করে গেছেন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য। প্রকৃত অর্থে পশ্চিমবাংলার ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচন নিছক একটি নির্বাচনের বন্ধনে আবদ্ধ ছিল না। এর সঙ্গে ছিল অনেক বড় প্রশ্ন জড়িয়ে। গোটা ভারতবর্ষ যে ফ্যাসিবাদের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ তার সামনে প্রধান বাধা। পশ্চিমবঙ্গকে কব্জা করতে পারলেই তবে ফ্যাসিবাদের ষোলোকলা পূর্ণ হবে। তাদের সামনে বাধা দেওয়ার মত শিরদাঁড়া সোজা করে কথা বলার কেউ আর থাকবে না। সেইজন্যে নরেন্দ্র মোদী অমিত শাহরা বার বার ছুটে এসেছেন বাংলায়। যাতে বাংলাকে দখল করে নিয়ে ভারতবর্ষে প্রশ্ন তোলার রাজনীতিকে শেষ করে দেওয়া যায়। কিন্তু সে আশা সফল হয়নি। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সর্বপ্রথম অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য বাংলার আমজনতা। তারা যে দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা এবং সচেতনতার পরিচয় দিয়েছে তাকে উপেক্ষা করার কোন জায়গা নেই। তাদেরকে প্ররোচিত করার সবরকম প্রয়াস চালানো হয়েছে। অর্থ শক্তি, বেশি শক্তি, রাজ শক্তি সবকিছু কাজে লাগানো হয়েছে। কিন্তু সবকিছুকে পায়ে ঠেলে নিজেদের মতামত সাহসিকতার সঙ্গে পেশ করতে ভুল করেনি বাংলার জনগণ। সেই সাথে অভিনন্দন প্রাপ্য সেই সকল সংগ্রামী অরাজনৈতিক কর্মীদের। যারা রাজনীতির ময়দানে না থেকেও দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন ফ্যাসিবাদের মোকাবেলায়। সারা বাংলা জুড়ে যারা চষে বেড়িয়েছেন বাংলার গ্রাম গঞ্জ। মানুষকে বুঝিয়েছেন ফ্যাসিবাদের বিপদের কথা। রাজনীতি না করা সত্ত্বেও শাসকদলের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে যারা মানুষকে আবেদন জানিয়েছিলেন ঐক্যবদ্ধভাবে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার জন্য। অভিনন্দন প্রাপ্য তাদের ফ্যাসিবাদ বিরোধী রাজনীতির মুখ্য ভূমিকায় যারা আছেন।

ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের অগ্রণী নেতা মমতা ব্যানার্জিকে বাংলার জনগণ আর একবার সুযোগ দিয়েছে। তিনি যদি এই সুযোগকে কাজে লাগাতে পারেন তাহলে তা শুধু বাংলার নয় গোটা ভারতের জন্য কল্যাণকর হবে। কিন্তু তিনি যদি পুর্বের মতো আবারও অসহিষ্ণু অসংবেদনশীল উগ্র মূর্তি ধারণ করেন। তাহলে তিনি ভুল করবেন। সাম্প্রদায়িক শক্তিকে শুধুমাত্র রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা নয় বরং যদি তিনি বাংলার মাটিতে আদর্শগত মোকাবেলা করতে পারেন, রাজ্যে তাদের যাবতীয় সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক কর্মসূচি বন্ধ করার সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন। তাহলে তা দেশকে এক অন্য বারতা দেবে। সারাদেশ আজ মমতা ব্যানার্জির কাছে সেটাই প্রত্যাশা করে।

Related Articles

Back to top button
error: