রাজ্য

ধর্ষণ থেকে মুক্তির পথ কি সুশাসন ও মৃত্যু দন্ড?

নিজস্ব সংবাদদাতা, টিডিএন বাংলা, কলকাতা: ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরো (এনসিআরবি) ২০১৮ সালের যে তথ্য বলছে, দেশে প্রতিদিন ৯১টি ধর্ষণ, ৮০টি খুন আর ২৮৯টি অপহরণ হয়। তবে বাস্তবের ছবিটা এর থেকে আরও অনেকটাই ভয়াবহ বলে সমাজকর্মীরা মনে করেন। নির্ভয়া কান্ড নিয়ে গত দেশ উত্তাল ছিল। তারপর কত আলোচনা, কত পরামর্শ হয়েছে। কিন্তু ধর্ষণ কমেনি। এমনকি যুবতী, বৃদ্ধ ছাড়াও ধর্ষকদের লালসার শিকার হচ্ছে শিশুরা। শুধু ধর্ষণ নয়, বর্তমানে ধর্ষণের পর খুনের ঘটনাও বাড়ছে। ২০১৯ সালের নভেম্বরের শেষে
হায়দরাবাদের অনতিদূরে শাদনগরে ২২ বছরের তরুণী পশুচিকিৎসকের দগ্ধ দেহ পাওয়া গিয়েছিল, তাঁকে দু’জনে মিলে ধর্ষণের পর খুন করা হয়েছে বলে পুলিশের অনুমান। তাঁর স্কুটির টায়ার ফেটে যাওয়ায় রাস্তার পাশের দোকানে তরুণী পশুচিকিৎসক ওই দু’জনের সাহায্য চেয়েছিলেন। কিন্তু তাকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়। একজন নারী নিরাপদে ঘর থেকে বেরিয়ে ফের নিজের ঘরে ফিরতে পারবেন এমন নিশ্চয়তা পাচ্ছে কই?
২০১৯ সালে উত্তরপ্রদেশের উন্নাওয়ের ঘটনা নিয়ে ব্যাপক আন্দোলন হয়েছিল। কিন্তু ওই বছর শুধু উন্নাওয়ে ১১ মাসে ৮৬টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। আর যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ১৮৫টি। এমনকি উন্নাওয়ে ধর্ষণের শিকার ২৩ বছরের তরুণীকে অভিযুক্তরা পুড়িয়ে মারার দিনেও সেখানে তিন বছরের শিশুকন্যাকে ধর্ষণের অভিযোগ জমা পড়েছে।
২০১৮ সালে রাজধানী দিল্লিতে আট মাসের একটি কন্যাশিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। এছাড়া তিন বছর, ১০ বা ১১ বছর বয়সী কন্যাশিশুদের ধর্ষণের খবর প্রায় শোনা যায়। বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও স্লোগান দিয়েছিলেন। কিন্তু ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৬ সালে দেশে মোট ৩৮ হাজার ৯৪৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ওই বছর ভারতে ধর্ষিত হয়েছে প্রায় কুড়ি হাজার শিশু বা কিশোরী।
তবে তথ্যের বাইরে বহু ধর্ষণের ঘটনা ঘটে যা নথিভুক্ত হয়না। আর এইসব দেখে বিরোধীরা বলছেন,’মেক ইন ইন্ডিয়া থেকে ধীরে ধীরে রেপ ইন ইন্ডিয়ার পথে এগোচ্ছে ভারত।’
১৪ জুলাই ২০১৯ আনন্দবাজার পত্রিকার খবরে বলা হয়,’‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’। শিশুকন্যাদের কল্যাণে এমনটাই স্লোগান নরেন্দ্র মোদী সরকারের। সেই জমানাতেই চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে গোটা দেশে ২৪ হাজারের বেশি শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। শীর্ষে রয়েছে যোগী আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশ। সেখানে ছয় মাসে ৩,৪৫৭টি শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। শিশু ধর্ষণে প্রথম পাঁচটি রাজ্যের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গও রয়েছে পঞ্চম স্থানে। ছয় মাসে সেখানে ১৫৫১টি শিশু ধর্ষণের অভিযোগে এফআইআর জমা পড়েছে।” বর্তমানে বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশে হাতরসের গণধর্ষণ কাণ্ড নিয়ে গোটা দেশ উত্তাল। কিন্তু এর মধ্যেও ধর্ষণ থেমে নেই। ওই রাজ্যের ভাদোহীতে ধর্ষণ করে নৃশংস ভাবে খুন করা হল এক দলিত কিশোরীকে। শুধু উত্তর প্রদেশ নয়, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এই কয়দিনে একাধিক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।
কিন্তু এই ধর্ষণের শেষ কোথায়? নারীদের জন্য কবে একটা সোনালী সমাজ গড়ে উঠবে? কোন পথে ধর্ষণ এড়ানো সম্ভব? আলিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আয়াতুল্লাহ ফারুক বলেন,”চরম নির্মম, কঠোর শাস্তি হোক প্রকাশ্য দিবালোকে। ধর্ষণের ঘৃণ্য চিন্তা যেন কারোও মাথাতেই না আসে।”
ভাষা ও চেতনা সমিতির সম্পাদক অধ্যাপক ইমানুল হক বলেন,’জনসচেতনতা বৃদ্ধি দরকার। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। আন্তর্জালে নীল ছবির প্রদর্শনী বন্ধ করতে হবে। নারী মানেই পণ্য নয়, তা বোঝানো প্রয়োজন। যে-কোনো পণ্যের সঙ্গেই অকারণ নারী শরীরের প্রদর্শন বন্ধে কঠোর আইন আনা।
এ-ছাড়া গ্রাম শহর মহল্লায় নারী ও পুরুষের সম্পর্ক মানে শুধু যৌনতা নয় তা বোঝানো। ভাই বোন মা ছেলে পিসি ভাইপো মাসি বোনপো বা বন্ধুর সম্পর্কও হয়– তা নিয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া প্রচার চালানো।
আমানত ফাউন্ডেশনের কর্ণধার, বিশিষ্ট সমাজকর্মী শাহ আলম বলেন,সুবিচারের উপর জোর দিতে হবে। ধর্ষণের এমন শাস্তি দিতে হবে যাতে সেটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে।
আল আমীন মাইনোরিটি কলেজের অধ্যক্ষ ড: নুরুল হকের মতে,” সরকার যদি জঘন্য অপরাধগুলোর ব্যাপারে সংবেদনশীল না হয় তাহলে কোন পদক্ষেপ কার্যকরী হবে না। সরকারকে হতে হবে সকলের সরকার। সরকার পক্ষপাতিত্ব করছে বলেই যত বিপত্তি তৈরি হয়ে গেছে। কেন্দ্রের বর্তমান সরকারটা হয়েগেছে পুঁজিপতি,একটা ফ্যাসিস্ট সরকার। জনকল্যাণ মূলক রাষ্ট্রের জন্য এ ধরনের সরকার খুবই বিপজ্জনক। দেশে জিডিপির হার ভীষণভাবে নেমে গেছে, বেকারত্বের এতটা বৃদ্ধি স্বাধীনতার এতো বছরের মধ্যে ইতিপূর্বে কখনও হয়নি। সাম্প্রদায়িক হিংসা, অপরাধ যেভাবে বাড়ছে, পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রতি সরকারের অমানবিকতা প্রমান করে এই সরকার কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনের পরিপন্থী। আমার মনে হয়, হাথরাস ধর্ষণ ও হত্যা ঘটানো হয়েছে পরিকল্পিতভাবে দেশব্যাপী কৃষি বিল বিরোধী ব্যাপক আন্দোলনের সম্ভাবনাকে আটকানোর জন্য। সরকারকে তাদের দৃষ্টিভঙ্গীর বদল ঘটাতে হবে। নারী সুরক্ষার জন্য সরকারের প্রাথমিকভাবে যা করা উচিত,প্রথমত,যে আইন ইতিমধ্যে আছে সেগুলো যথাযথভাবে কার্যকরী করার বিষয়ে আন্তরিক হতে হবে।
দ্বিতীয়ত, পুলিশ প্রশাসনে নিরপেক্ষতা আনতে হবে। তৃতীয়ত,ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির এফ আই আর তৎক্ষনাৎ নিতে হবে। কোন গড়িমসি চলবে না। কোন প্রভাবে প্রভাবিত হওয়া যাবে না। চতুর্থত, ” জাস্টিস ডিলেইড ইজ জাস্টিস ডিনাইড “। তাই যত দ্রুত সম্ভব ন্যায় বিচার দিতে হবে। পঞ্চমত, মহিলা কমিশনকে নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। ষষ্ঠতম,সংবাদমাধ্যমের নিরপেক্ষতা এ বিষয়ে খুব জরুরী। সংবাদ জগৎ যদি অপরাধীদের পক্ষ অবলম্বন করে তবে শাস্তির আইন তৈরী করাও খুব দরকার। সপ্তমত, অপরাধী ও তাদের সাহায্যকারী সকলকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে।”

Related Articles

Back to top button
error: