রাজ্য

বছর ঘুরলেও কাশ্মীরে কাজ করতে গিয়ে একই গ্রামের পাঁচ শ্রমিকের মৃত্যুতে এখনও স্তম্ভিত মুর্শিদাবাদের বাহালনগর

নিজস্ব সংবাদদাতা, টিডিএন বাংলা, মুর্শিদাবাদ: ২৯ শে অক্টোবর ২০১৯। ঠিক রাত্রি নয়টা। নিত্যদিনের মতো রাতে খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছিলেন আবিদা বিবি, রওসনারা বিবি, সাইরা বিবি, মবিয়া বিবি, সমীরণ বিবিরা। ভরসন্ধায় পড়া শেষে মায়ের সাথে খাবার খেয়ে শুয়ে গিয়েছিল ছোট্ট শিশু নেসবান খাতুন, সুহানা খাতুনরা, আফরোজা, ইস্তাক সেখরাও। হঠাৎ রাত এগারোটা নাগাদ বাড়ির দরজায় পুলিশের কড়া? প্রথমে চমকে উঠলেও নাম ধাম জিজ্ঞেস করেই জানিয়ে দেওয়া হয় কাশ্মীরে জঙ্গি হানায় মৃত্যু হয়েছে পরিবারের কর্তার। একই গ্রামের পাঁচ পাঁচজন ব্যক্তির মৃত্যুতে রাতের অন্ধকারেই কান্নার রোল পড়েছিলো মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘির বাহালনগর গ্রামে। কে কাকে সান্তনা দেয়! নিজ পরিবারের মৃত্যু নিয়ে হাহাকার অবস্থা সৃষ্টি হয় সকলের। তাদের ছেলে, স্বামীরাও মারা যায়নি তো? আতঙ্কে বিদেশে কাজে যাওয়া পরিবারের সদস্যদের ফোন করার হুড়োহুড়ি পড়ে যায় এলাকাজুড়ে। ভয়াবহ সেই ঘটনার আজ এক বছর অতিবাহিত। সেসময়ের ভীতিকর ও তটস্থ অবস্থার মূর্ছনা যেন আজও মিটে যায়নি। এখনও যেন স্তম্ভিত বাহালনগর। যদিও মানবিক মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে চাকুরী পেয়ে কিছুটা হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল সাগরদীঘি।

উল্লেখ করা যেতে পারে, সাগড়দিঘির বোখারা-১ গ্রাম পঞ্চায়েতের সংখ্যালঘু অধ্যুষিত বাহালনগর গ্রামে হাজার তিনেক মানুষের বসবাস। পেশায় চাষি হলেও চাষবাসে লোকসান হওয়ায় বিকল্প পেশা হিসেবে ও ছেলেমেয়েদের শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে এবং পরিবারের মুখে সুখে দু মুঠো অন্ন তুলে দিতে চাষবাস ছেড়ে বিদেশ পাড়ি দেন যুবক থেকে মাঝবয়সী কিংবা বৃদ্ধ প্রায় সবশ্রেণীর মানুষ। কেউ রাজমিস্ত্রি আবার কেউ আপেল ভাঙা অথবা চাষবাসে অভিজ্ঞতা থাকায় কাশ্মীর সহ দেশের নানান প্রান্তে ধান কাটার কাজে যেতে শুরু করেছিলেন। সেই তালিকায় ছিলেন মোরসালীন শেখ , রফিক শেখ, নইমুদ্দিন শেখ, কামিরুদ্দিন শেখ ও রফিকুল শেখ, জহিরউদ্দিনরাও। কিন্তু আকস্মিক এক জঙ্গি হামলায় নিথর হয়ে বাড়ি ফিরতে হয় পাঁচ শ্রমিককে। জখম অবস্থায় বাড়ি ফিরতে হয় জহুরুদ্দিনকে। বেকারত্বের জন্য রাজ্যের বাইরে কাজে গিয়ে যেভাবে কাশ্মীরে নিরীহ শ্রমিকদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয় তাতে গোটা গ্রামের শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্কের পরিবেশ এখনও বিদ্যমান। হারিয়েছে বাইরে কাজে যাওয়ার ইচ্ছা।।

যদিও কাশ্মীরের কুলগাম কাণ্ডে নিহত সাগরদিঘির বাহালনগরের শ্রমিকদের পরিবারের সদস্যদের রাজ্য সেচ দফতরের রঘুনাথগঞ্জ শাখায় চতুর্থ শ্রেণির কর্মী হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। নিহত শ্রমিক মুরসেলিম শেখের স্ত্রী সায়রা বিবি , রফিকুল শেখের মেয়ে পারভিন সুলতানা ও জখম জহিরুদ্দিন শেখ ঘটনার প্রায় মাস দুয়েক পরেই চাকুরিতে যোগদান করেন। স্বজন হারালেও সরকারি চাকরি পেয়ে মানবিক মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে নিহত শ্রমিকদের পরিবার ।

জঙ্গিদের গুলিতে জখম জহিরউদ্দিন এখন সরকারি চাকুরিজীবি। তিনি জানান, গতবছরের দুর্বিষহ স্মৃতি যেন এখনও আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। বন্ধুদের চোখের সামনে চলে যাওয়া কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। যদিও তিনি তাকে জখম অবস্থায় নিয়ে আসা ও পরবর্তী সময়ে চাকুরী প্রদান নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন। অন্যদিকে গ্রামের বাসিন্দা বাণী ইসরাইল জানান, আকস্মিক গ্রামের পাঁচ বাসিন্দার মৃত্যু এখনও আমরা ভুলতে পারিনি। বছর পেরালেও গোটা গ্রাম যেন সেই ঘটনায় স্তম্ভিত।

Related Articles

Back to top button
error: