HighlightNewsরাজ্যসম্পাদকীয়

দূর্গা পদযাত্রা: রাষ্ট্র যখন ধর্মে প্রবেশ করে

মুহাম্মাদ নূরুদ্দীন: আজ ১ সেপ্টেম্বর ২০২২। পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় অনুষ্ঠিত হতে চলেছে দুর্গা পূজা যাত্রা। সম্প্রতি ইউনাইটেড নেশনস এডুকেশনাল সাইন্টিফিক এন্ড কালচারাল অর্গানিজেশন বা ইউনেস্কো পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু ধর্মের বৃহত্তম উৎসব দুর্গাপূজাকে ইউনেস্কো কালচারাল হেরিটেজ এর তালিকাভুক্ত করেছে। ইউনেস্কোর দেওয়া এই তকমাকে স্বাগত জানাতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এই পদযাত্রার আয়োজন করেছেন। তিনি একটি সাংবাদিক সম্মেলনে জাতি ধর্ম মত পথ নির্বিশেষে সকল মানুষকে এই পদযাত্রায় অংশগ্রহণ করার আহ্বান জানিয়েছেন। এই পদযাত্রাকে বর্ণময় করার জন্য নানান রঙে সাজিয়ে তোলা হবে অংশগ্রহণকারী মানুষদেরকে। এখানে যেমন আহ্বান জানানো হয়েছে কয়েকশত লোক-শিল্পী কে তেমনি আহ্বান জানানো হয়েছে লক্ষী ভান্ডারের সঙ্গে যুক্ত শত শত মহিলাকে। সেই সঙ্গে সঙ্গে কলকাতা ও কলকাতার বাইরের জেলাগুলি থেকে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীদেরকে পদযাত্রায় অংশগ্রহণ করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এই পদযাত্রা উপলক্ষে সরকারি অফিস আংশিকভাবে বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয়া হয়েছে।

কোন সমাজের কোন উৎসব অনুষ্ঠান বা প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক কোন মর্যাদা অর্জন করলে সেই সমাজের প্রত্যেকের জন্য তা গর্বের বিষয়। কলকাতার বাঙালি হিন্দু সমাজের একান্ত ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। যদিও এই দুর্গাপূজার উৎসবে অন্যান্য ধর্মের মানুষরাও কম বেশি অংশগ্রহণ করে। সেই অংশগ্রহণ অনেকটা সংস্কৃতিক সার্বজনীনতার রূপ দিয়েছে। ইউনেস্কো এই বিষয়টিকে খেয়াল রেখে এটিকে একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। বাঙালি মাত্র প্রত্যেকের নিকট এটি একটি গর্ভের বিষয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকার যেভাবে এই উৎসবকে ঘিরে উন্মাদনা শুরু করেছে এবং ধর্মনিরপেক্ষতার সীমারেখা অতিক্রম করে যেভাবে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসবকে সরকারি উৎসবে পরিণত করছেন তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন তোলার অবকাশ আছে।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উৎসবগুলিকে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করছেন তা নিয়ে ইতিমধ্যে নানা মহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তিনি কি নরম হিন্দুত্বের পথ গ্রহণ করে রাজ্যের সংখ্যাগুরু সমাজের বিশেষ আস্থা অর্জন করতে মরিয়া? এ প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে মানুষের মনে। তিনি কি শুধু উন্নয়ন দিয়ে রাজ্যের সব মানুষের আস্থা অর্জন করার ব্যাপারে সন্ধিহান হয়ে পড়েছেন? তা না হলে তিনি রাজনীতির ময়দানে ধর্মকে টেনে নিয়ে আসতে এতটা মরিয়া কেন।

এমনিতে ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপলক্ষে রাজ্য সরকারের ছুটি বন্টনের বৈষম্য সহজেই নজরে পড়ে। যেখানে পূজা পার্বণগুলোতে ঢালাও ছুটির ব্যবস্থাপনা সেখানে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের দুইটি ঈদে একদিনের বেশি ছুটি দেওয়ার ব্যাপারে সরকারের যথেষ্ট অনীহা। শুধু তাই নয় ঈদের দিন বা তার আগের ও পরের দিন রাজ্যের বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা যথেষ্ট বিড়ম্বনায় ফেলে সংখ্যালঘু সমাজকে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের হাজার হাজার দুর্গাপূজা কমিটিকে বিশেষ অনুদান প্রদান করেন। সরকারি অর্থ কোন বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য ব্যয় করা কতটা যুক্তিযুক্ত তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তারপর এই দুর্গা পদযাত্রা সেই সকল প্রশ্ন সন্দেহ ও সংশয় কে আরো বাড়িয়ে তুলবে।

মুখ্যমন্ত্রী সব মত ও পথের মানুষদেরকে এই পদযাত্রায় অংশগ্রহণ করার আহ্বান জানিয়েছেন। রাজ্যের সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের বিশেষ অংশ এতে জোর প্রতিবাদ জানিয়েছেন। বিশেষ করে লক্ষী ভান্ডারের সুবিধা ভোগী মহিলাদেরকে অংশগ্রহণ করতে বলা হলে মুসলিম মহিলারা কিভাবে তাতে অংশগ্রহণ করবেন? যেহেতু তারা সরকারি সুবিধা পায় এবং যেহেতু মুখ্যমন্ত্রী আহ্বান জানিয়েছেন সুতরাং তার আহবানে সাড়া দিয়ে অনেক মুসলিম মহিলা তাদের আন্তরিকতা না থাকা সত্ত্বেও অংশগ্রহণ করতে পারেন। কিন্তু প্রকারান্তরে এটা একটি সংস্কৃতিক আগ্রাসন। বৃহত্তর সমাজ তাদের ধর্মীয় সংস্কৃতিকে সংখ্যালঘুদের উপরে চাপিয়ে দেবে এটা কাম্য নয়।

একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীদেরকে আজকের পদযাত্রায় অংশগ্রহণ করার আহ্বান জানানো হয়েছে। এখানেও সেই একই প্রশ্ন। মুসলিম সমাজের ছাত্র-ছাত্রীরা কিভাবে একটি ভিন্ন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় পদযাত্রায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে। তাদের কাছে এটা উভয় সংকট। কেননা ধর্মীয় দিক থেকে ভিন্ন ধর্মীয় সংস্কৃতির উৎসবে অংশগ্রহণ করা তাদের জন্য বৈধ নয়। অপরদিকে ভারতের মতো বৈচিত্রপূর্ণ দেশে একটি মিশ্র সংস্কৃতি নিয়ে বসবাস করতে হলে যে পারস্পরিক উদারতা ও সহানুভূতি দেখা প্রয়োজন এই উৎসবে অংশগ্রহণ না করা হলে সে বিষয়ে তাদেরকে বাঁকা চোখে দেখা হতে পারে। হয়তো বলা হবে বাঙালি সমাজের একটি আন্তর্জাতিক সম্মাননাকে স্বাগত জানাতে পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম সমাজ কার্পণ্য করছে। তারা সমাজের চোখে সংকীর্ণমনা বলে বিবেচিত হবে। সমাজের একটি অংশকে পরিকল্পিতভাবে এই বিড়ম্বনার মধ্যে ফেলা রাজ্য সরকারের দায়িত্বহীনতার পরিচয়।

এরপর ও প্রশ্ন আছে? তাহলে কি একই সমাজে বসবাসকারী ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ একে অপরের সুখে-দুখে অংশগ্রহণ করবে না? আনন্দ ও দুঃখ সকলে কি সমান ভাবে ভাগ করে নিতে পারেনা? তা না হলে সম্প্রীতি আর মিলন কোথা থেকে আসবে? হ্যাঁ এইখানেই নাগরিক সমাজ থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবী শিল্পী সাহিত্যিক এবং সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বড় মাছ যখন ছোট মাছকে গ্রাস করে তখন তাকে মৎস্যন্যায় বলা হয়। সংখ্যাগুরু সমাজের ধর্মীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন যদি সংখ্যালঘু সমাজের ধর্মীয় পরিচিতিকে আষ্টেপৃষ্ঠে মেরে ফেলে তাকে তাহলে ধর্মনিরপেক্ষতা বলা যায় না। ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ উদারতা পারস্পরিক শ্রদ্ধা সম্মান ও ভালবাসার অনাবিল উন্মুক্ত পরিবেশ। আমাদের সমাজে সার্বজনীন উৎসব কম নেই আমরা জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে বইমেলায় মেতে উঠি। আমরা শিল্প মেলা করি। শিল্পী মেলা করি। স্বাধীনতা দিবস প্রজাতন্ত্র দিবস মহা মনীষীদের জন্ম দিবস সহ অনেক অনুষ্ঠান পাশাপাশি আমরা অংশগ্রহণ করি। তাতে আমাদের কারো কোন আপত্তি থাকে না বরং এই ভাবেই আমরা একে অপরের কাছাকাছি আসি। সুশীল সমাজের দায়িত্ব প্রকৃত সার্বজনীন উৎসবকে সার্বজনীনতার মাত্রা দেওয়া। কিন্তু বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উৎসবকে সার্বজনীন হিসাবে সকলের উপরে চাপিয়ে দেওয়ার মানসিকতা আগ্রাসন ছাড়া কিছু নয়। আর কোন সরকার যখন পরিকল্পিতভাবে সেই আগ্রাসনে অংশগ্রহণ করে তখন তা ভয়ংকর বিপদের সংকেত বহন করে।

Related Articles

Back to top button
error: