HighlightNewsসম্পাদকীয়

ধর্মসংস্কার থেকে স্বাধীনতায় ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ এর ভূমিকা

আব্দুস সালাম,টিডিএন বাংলাঃ মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ লগ্নে ভারতীয় মুসলিম সমাজে চরম অধঃপতন শুরু হয়। এমতাবস্থায় শাহ ওলিউল্লাহ দেহলভীর নেতৃত্বে শুরু হয় ধর্মসংস্কার আন্দোলন। এরই ধারাবাহিকতায় হাজী শরীয়তউল্লাহ বাংলাতে শুরু করেন মুসলিমদের মধ্যে ধর্ম সংস্কারের প্রচেষ্টা। যা পরবর্তীতে ‘ফরায়েজী আন্দোলন’ নামে পরিচিতি লাভ করে। ফরায়েজী কথার অর্থ হচ্ছে ‘ইসলামে ফরজ বা বাধ্যতামূলক কর্তব্য’। হাজী শরীয়ত উল্লাহ অনুভব করেন মুসলিমরা প্রকৃত ইসলাম থেকে দূরে সরে গিয়ে মনগড়া ধর্মাচরণের মধ্যে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। তিনি ধর্মীয় কুসংস্কার ও শির্ক-বিদআত ছেড়ে মুসলিমদের প্রকৃত ইসলামের দিকে ফিরে আসার আহ্বান জানান। এ আন্দোলন ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা লাভ করতে শুরু করে। প্রাথমিক পর্যায়ে ফরায়েজী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ এই আন্দোলনকে শুধু ধর্মীয় সংস্কারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেন। কিন্তু ক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তারা রাজনৈতিক অন্যায়, অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে শুরু করেন। এখান থেকেই ‘ফরায়েজী আন্দোলন’ ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন থেকে ধীরে ধীরে স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপ নেয়।

এই ধর্মসংস্কার আন্দোলন শাহ ওলিউল্লাহ দেহলভীর সময় থেকে শুরু হলেও ‘ফরায়েজী আন্দোলনে’র প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা হয় হাজী শরীয়ত উল্লাহকে। তিনি বাংলার ফরিদপুর জেলার বন্দর পরগনায় ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি দীর্ঘ ১৮ বছর ধর্মশাস্ত্র,তর্ক শাস্ত্র, সমাজবিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন। প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি ধর্মপ্রাণ কতিপয় মুসলিম বুদ্ধিজীবিদের নিয়ে ধর্ম সংস্কারের কাজে মন দেন। অচিরেই তিনি জনপ্রিয়তা লাভ করেন। এরপর ফরায়েজী আন্দোলনের নেতৃত্ব অনুভব করেন বাংলা তথা ভারত জুড়ে ইংরেজদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে সাধারণ জনতার উপর নির্মম অত্যাচার, জুলুম ও শোষণ শুরু চলছে। এখানে মানুষকে ধর্মাচরণে বাধা দেয়া হচ্ছে। এসময় বাংলা জমিদাররা ছিলেন অধিকাংশ হিন্দু। তারা মুসলিম প্রজাদের উপর বিভিন্ন ভাবে অত্যাচার করছিল। এমনকি তারা বিভিন্ন পুজোর চাঁদা দিতে মুসলিম প্রজাদের বাধ্য করতো। গরুর মাংস কম দাম ও সহজলভ্য হওয়ায় মুসলিমরা গরুর মাংস ভক্ষণ করত। কিন্তু এ সময় বিভিন্ন এলাকায় গরু কুরবানী বন্ধ করে দেওয়া হয়। এছাড়াও বিভিন্ন ভাবে ধর্মাচরণে বাধা দেওয়া হচ্ছিল। অন্যদিকে জমিদার, মহাজন ও নীলকর সাহেবদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকল প্রজারা। এমতাবস্থায় তার নেতৃত্বে ফরায়েজীরা জমিদার, মহাজন, নীলকর সাহেব ও তাদের প্রশ্রয়দাতা ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। তিনি ইংরেজ শাসিত ভারতকে ‘দারুল হারব’ অর্থাৎ বিধর্মীদের দেশ বলে ঘোষণা করেন। তাই ভারতকে ‘দারুল ইসলামে’ অর্থাৎ ইসলামের দেশ বা ভূমিতে পরিণত করার জন্য ভারত থেকে ইংরেজদের বিতাড়ন এর প্রয়োজন অনুভব করেন। ফলে ফরায়েজী আন্দোলন ধীরে ধীরে ইংরেজবিরোধী ও ইংরেজদের তল্পিবাহক জমিদার, নীলকর সাহেব ও মহাজন বিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে এই আন্দোলন বাংলার ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিং, ফরিদপুর, বরিশাল, খুলনা, যশোহর, চব্বিশ পরগনা প্রভৃতি জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। একইসঙ্গে এ আন্দোলন ত্রিপুরা ও অসামের কিছু অংশে ছড়িয়ে পড়েছিল।

হাজী শরীয়তুল্লাহ ঢাকার রামনগরে প্রচার কেন্দ্র স্থাপন করে সেখান থেকে গোটা অঞ্চলে আন্দোলন পরিচালনা করছিলেন। কিন্তু এই আন্দোলনে তৎকালীন হিন্দু জমিদারদের পাশাপাশি একশ্রেণীর মুসলিম নেতৃত্ব বিচলিত হয়ে পড়েন। কারণ এ সময় যারা ধর্মের নামে ব্যবসা করছিল হাজী শরীয়ত উল্লাহর ফরায়েজী আন্দোলনের ফলে তাদের সে ব্যবসা হুমকির মুখে পড়েছিল। ফলে ঢাকার জমিদার ও সেই মুসলিম শ্রেণির ষড়যন্ত্রে হাজী শরীয়তুল্লাহকে রামনগর থেকে উচ্ছেদ করা হয়। তিনি সৈয়দ আহমদ বেরলভীর নেতৃত্বে পরিচালিত মোহাম্মদিয়া তরিকা বা তথাকথিত ‘ওহাবী আন্দোলনে’র সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন। সৈয়দ আহমদের সাহায্যার্থে তিনি বাংলা থেকে অর্থসম্পদ ও মুজাহিদ সংগ্রহ করে পশ্চিম ভারতের সিত্তানা কেন্দ্রে পাঠাতেন।

হাজী শরীয়ত উল্লাহর ফরায়েজী আন্দোলন তৎকালীন বাংলায় কি পরিমাণে সাড়া ফেলেছিল তা বোঝা যায় ১৮৩৭ সালের ২২শে এপ্রিল তারিখের ‘সমাচার দর্পণে’ প্রকাশিত একখানি পত্র থেকে। তার কিছু অংশ এখানে তুলে ধরছি। । ” ইদানীং জেলা ফরিদপুরের অন্তঃপতি শিবচর থানার সরহদ্দে বাহাদুরপুর গ্রামে সরিতুল্লা নামক একজন বাদশাহী লওনেচ্ছুক হইয়া নূন্যাধিক বার হাজার জোলা ও মুসলমান দলবদ্ধ করিয়া নতুন এক শরা জারি করিয়া নিজ মতাবলম্বী লোকদিগের…. ঐ থানার সরহদ্দে পোড়াগাছা গ্রামে একজন ভদ্রলোকের বাটিতে রাত্রিযোগে চড়াও হইয়া সর্বস্ব হরণ করিয়া…. শ্রুত হওয়া গেল, ফরিদপুরের ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের হুজরে জে সকল আমলা ও মোক্তার –কারেরা নিযুক্ত আছে, তাহারা সকলেই সরিতুল্লা যবনের মতাবলম্বী। তাহাদের রীতি এই যেদি কাহার নামে মিথ্যা অভিযোগ করিতে হয়, তবে কেহ ফরিয়াদী কেহ বা সাক্ষী হইয়া মোকদ্দমা উপস্থিত করে সুতরাং ১২০০০ লোক দলবদ্ধ… সরিতুল্লা যবন যে প্রকার দলবদ্ধ হইয়া উত্তর উত্তর হইতেছে অল্পদিনের মধ্যে হিন্দুধর্ম লোপ পাইয়া অকালে প্রলয় হইবেক। সরিতুল্লার চোটপাটের শত অংশের এক অংশ তিতুমীর করিয়াছিল না।”

১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে হাজী শরীয়তুল্লাহর মৃত্যুর পর এ আন্দোলনের নেতৃত্ব যায় তার পুত্র হাজী মুহাম্মদ মহসিন এর উপর। হাজী মোহাম্মদ মহসীন ওরফে দুদু মিয়া জন্মগ্রহণ করেন ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে। তিনি ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে মক্কায় হজের উদ্দেশ্যে যান। পাঁচ বছর সেখানে অবস্থান করার পর ফিরে এসে তিনি পিতার আন্দোলনে শরিক হন। তিনি ফরায়েজী আন্দোলনের দায়িত্ব পাওয়ার পর জমিদারদের সঙ্গে সংঘাত তীব্র হয়ে ওঠে। ঐতিহাসিকদের মতে হাজী শরীয়তউল্লাহ থেকেও মোহাম্মদ মহাসিন এর সাংগঠনিক যোগ্যতা ছিল অনেক বেশি। তাঁর সময়ে এ আন্দোলন আরো বৃহৎ আকার ধারণ করে। ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর নেতৃত্বে ফরায়েজীরা ফরিদপুরের জমিদার বাড়িতে আক্রমণ করে মদন নারায়নকে বন্দি করে ও পরে হত্যা করে। এ ঘটনায় পুলিশ ১১৭ জন ফরায়েজীকে গ্রেফতার করে। কিন্তু প্রমাণের অভাবে অনেকের সঙ্গে মুহাম্মাদ মহসিনকেও ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। অবশ্য ২২ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

১৮৪৬ সালে এনড্রিও এন্ডারসন এর গোমস্তা কালি প্রসাদ মনিবের আদেশে সাত আটশ’ লোক নিয়ে দুদু মিয়ার বাড়ী চড়াও করে এবং প্রায় দেড় লক্ষ টাকা মূল্যের অলংকারাদিসহ বহু ধনসম্পদ লুণ্ঠন করে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় বিচার চেয়ে তিনি মামলা করেন কিন্তু কোনো বিচার না পাওয়ায় অবশেষে নিজেই শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তার বাহিনী নিয়ে ডানলপের কারখানা আক্রমণ করে আগুন ধরিয়ে দিয়ে পুড়িয়ে ফেলেন এবং তার গোমস্তা কালি প্রসাদকে হত্যা করেন। তার এই সাফল্যে জমিদার ও নীলকর সাহেবরা শংকিত হয়ে পড়েন। তারা ষড়যন্ত্রমূলকভাবে একের পর এক মামলায় মোহাম্মদ মহসিন ও তার অনুসারীদের ফাঁসাতে শুরু করে। অবশেষে তাদের চাপে পড়েই ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহের আবহাওয়া তৈরি হলে বিদ্রোহীদের সাহায্য করতে পারে এই অজুহাতে হাজী মুহাম্মদ মহসিনকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর তার শারীরিক অবনতি দেখা দিলে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে মুক্তি দেয়। তবে তিনি ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।

মোহাম্মদ মহসিন এর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র নাবালক হওয়ায় একটি পরিষদ ফরাজি আন্দোলন পরিচালনা করে। মোহাম্মদ মহসিন এর পুত্র নয়া মিয়া প্রাপ্তবয়স্ক হলে এই আন্দোলনের নেতা নির্বাচিত হন। তাঁর নেতৃত্বে আন্দোলন আবার প্রাণ ফিরে পায়। তবে তিনি পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে সরকারের সঙ্গে সংঘর্ষে না গিয়ে আপসে দাবি-দাওয়া মিটানোর পক্ষপাতী ছিলেন। তাই তার সময়ে প্রশাসনের সঙ্গে বড় ধরনের কোনো সংঘর্ষ দেখা দেয়নি। ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে তার মৃত্যুর পর এ আন্দোলনের দায়িত্ব পড়ে তার অপর ভাই গিয়াসউদ্দিন এর উপর। তিনি ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময় বঙ্গভঙ্গের পক্ষে নবাব সলিমুল্লাহকে সমর্থন করেন।কিন্তু ১৯০৬ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এরপর ফরাজি আন্দোলনে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো নেতৃত্বের আবির্ভাব ঘটেনি।

তথ্য সূত্র-
১) বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস-আব্বাস আলী খান,
২) বাংলা পিডিয়া, বাংলাদেশ জাতীয় জ্ঞান কোষ,

Related Articles

Back to top button
error: