HighlightNewsদেশসম্পাদকীয়

বাবরী থেকে জ্ঞানবাপী হয়ে মথুরা দেশে চলমান সাম্প্রদায়িক সংঘাত, বিচ্ছিন্ন ঘটনা নাকি বিচ্ছেদের পরিকল্পিনা

আব্দুস সালাম:

বাবরী মসজিদের পর এবার জ্ঞানবাপী মসজিদ, মথুরা মসজিদ, কাটরা মসজিদ, তাজমহল, কুতুব মিনার প্রভৃতিকে হিন্দুদের মন্দির বলে দাবি করা, প্রতিনিয়ত মুসলিমদের পিটিয়ে হত্যা, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে একের পর এক দাঙ্গার নামে মুসলিম নিধন, বেআইনি বসতি উচ্ছেদের নামে বুলডোজার চালিয়ে বেছে বেছে মুসলিমদের বাড়ি-দোকান ভেঙে ফেলা, উচ্চ শিক্ষিত সম্ভাবনা ময় মুসলিম যুবক-যুবতীদের মিথ্যা মামলায় জেল ইত্যাদি ভারতের বর্তমান পরিস্থিতি দেখে আমার আপনার মতো সাধারণ নাগরিক নিশ্চয় হতভম্ব। আমরা হয়তো ভাবছি হঠাৎ এতটা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ালো কিভাবে। এতদিন তো বেশ ভালোই চলছিল। অনেকেই বলছেন একটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আশার পর থেকেই শুরু হয়েছে এই সাম্প্রদায়িক সংঘাত।

কিন্তু বিষয়টা মোটেও হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং অবস্থা দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে এটি আসলে বৈচিত্র্যময় ভারতের বিভিন্ন জাতি ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে বিচ্ছেদের ন‍্যাক্বার জনক পরিকল্পনা। আমরা যদি একটু সচেতন হতাম তাহলে নিশ্চয় অনেক আগেই দেখতে পেতাম যে কিভাবে স্লো-পয়জনিং এর মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে নষ্ট করা হচ্ছিল কয়েক দশক আগে থেকেই। কিভাবে মুসলিম ও হিন্দু সম্প্রদায়কে একে অপরের শত্রুতে পরিণত করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছিল এক শ্রেণীর মানুষ বেশি হায়নারা। আর আমি মনে করি এরা কোনো একটি রাজনৈতিক দলের সদস্য নয়। বরং এরা বিভিন্ন রঙের আড়ালে থেকেই তাদের গোপন অভিসন্ধি বাস্তবায়নের প্রোপগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছে। কোনো রাজনৈতিক দলের আশা বা যাওয়ার ফলে এদের মূল কাজের বিশাল কোনো পার্থক্য হয় না। হয় তো সাময়িক ভাবে তারা তাদের কর্ম পদ্ধতির পরিবর্তন করে মাত্র।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আজ আমরা এই কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হলাম কেন? কেন এতদিন আমরা বুঝতেই পারলাম না আমাদেরই চারপাশে সামাজিক কীট গুলো ধীরে ধীরে বড়ো হচ্ছে? আর কেউ কেউ বুঝতে পারলেও কেন এর বিরুদ্ধে আমরা পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারলাম না? আর আজ আমরা যখন সব কিছু দিনের আলোর মত স্বচ্ছ দেখতে পাচ্ছি তখন কেন এত অসহায় মনে হচ্ছে? কেন শুধুই দর্শকের মতোই আমরা সব দেখে চলেছি নির্বিকার ভাবে? এমন অজস্রো কেন আমাদের মনে ভীর জমাচ্ছে যার কোনো সদুত্তর নেই। এই অজস্রো প্রশ্নের উত্তর কোনো এক ভাই একটি ছোট্ট উদাহরণ দিয়ে খুব সুন্দর ভাবেই দিয়েছেন। সেটি আমি হুবহু এখানে তুলে ধরছি-

“বয়লিং ফ্রগ সিনড্রোম একটা জনপ্রিয় মেটাফোর। একটা ব্যাঙ কে যদি আপনি একটি জল ভর্তি পাত্রে রাখেন এবং জলকে উত্তপ্ত করতে থাকেন তবে ব্যাঙটি জলের তাপমাত্রার সাথে সাথে নিজের শরীরের তাপমাত্রা ভারসাম্যে রাখতে থাকে। সে জলের উত্তাপ সহ্য করতে থাকে, লাফ দিয়ে বেরোনোর পরিবর্তে।কিন্তু একসময় জলের প্রচন্ড তাপমাত্রা ব্যাঙের শরীর আর মানিয়ে নিতে পারে না।

যখন সে আর জলের প্রচন্ড তাপমাত্রা তার শরীরের তাপমাত্রার সমতায় আসতে পারে না, তখন ব্যাঙটি ফুটন্ত জলের পাত্র থেকে লাফ দেয়ার স্বিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু হায়! সে লাফ দিতে পারে না তখন, কারন সে তার সমস্ত শক্তি তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রনে ব্যায় করে ফেলেছে। অত:পর সে জলেতে সেদ্ধ হতে থাকে। তার মৃত্যুর কারনটা আসলে গরম জল না, বিপদজনক পরিস্থিতির শুরুতে সেই পরিস্থিতি অস্বীকার করে লাফ না দেয়াটা তার মৃত্যুর কারন। সব কিছু সহ্য করে নেবার মত বড় ভুল তার মৃত্যুর কারন। মানিয়ে নেবার, পাত্রের জল গরম কেন তার প্রতিবাদ না করে বরং তার সাথে সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়াই তার জীবন্ত সেদ্ধ হবার কারন। সঠিক স্বিদ্ধান্ত সঠিক সময়ে না নেয়াই তার মৃত্যুর কারন।

হটাৎ করে সেই সেদ্ধ হওয়া ব্যাঙের কথা মনে পড়লো। খুব সম্ভবত আমরাও ঐ ব্যাঙের মত মানিয়ে নিচ্ছি আমাদের চারপাশের সাথে। সহ্য করছি সব, আর ভাবছি টিকে আছি, টিকে থাকবো। আসলে আমরা সেই বয়লিং ফ্রগ সিনড্রোমে আক্রান্ত। যখন বুঝবো, তখন ডিসিশান মেকিং এর কোন শক্তিই আর শরীরে অবশিষ্ট থাকবে না।”

অর্থাৎ আমাদের সামনেই হায়নারা বেড়ে উঠেছে কিন্তু আমরা তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলাম। আসলে আমাদের সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হচ্ছে অপরের ঘর জ্বললেও যতক্ষণ না আমাদের ঘরে আগুন লাগে ততক্ষণ আমরা ঘরের মধ্যেই নিজেকে নিরাপদ ভাবতে থাকি। এক ধর্মের মানুষের ঘরে আগুন লাগলে অন্য ধর্মের মানুষ ভাবে আমার তাতে কি সে তো অন্য ধর্মের? আবার একই ধর্মের মানুষরাও আমার ঘরতো ঠিক আছে ভেবে নিশ্চিন্তে ঘুমায়। কিন্তু সবাই ভুলে যায় যে আগুনের লেলিহান শিখা রং-ধর্ম বোঝে না। সে সব কিছুকে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়।

আর যারা ভাবছেন যে এই অশুভ শক্তি কেবল মুসলিমদেরই ক্ষতি করবে। তারা ভুলের মধ্যে আছেন। ইতিহাস বলছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধলে কিন্তু শুধু একটি সম্প্রদায়ের মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। সকলেই কম বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাছাড়া আপনারা খেয়াল করলে দেখতে পাবেন বর্তমানে যে পরিমাণে মুসলিমরা নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন তার থেকে বেশি নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন আদিবাসী, তথাকথিত নীচু সম্প্রদায়ের মানুষেরা। আর আকাশ ছোঁয়া মূল‍্যবৃদ্ধি, সমস্ত সরকারি সক্টরে দূর্ণীতি-ঘুষ, চিকিৎসা ব‍্যবস্থার বেহাল দশা, প্রতিটি নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের উপর প্রতি নিয়ত ট‍্যাক্স বৃদ্ধি, একে একে সব সরকারি সম্পত্তি বিক্রি করে দেওয়া, দূর্ণীতি-ধর্ষণ-হত্যা-ক্ষুধার সূচকে বিশ্বের প্রথম সারিতে থাকা, আর জিডিপির গ্ৰোথ বা শান্তির সূচকে শেষের দিকে থাকা ইত্যাদিতে কি শুধু একটি সম্প্রদায়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন? অন‍্যেরাও কি সমান ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না? এ প্রশ্নের উত্তর আপনাদের উপরই ছেড়ে দিলাম।

তবে শেষে একটাই কথা বলবো যদি আমরা ওই ব‍্যাঙের মতো সব অন‍্যায় সহ‍্য করে নিতে থাকি। তাহলে সেই দিন খুব বেশি দুরে নয় যেদিন আমাদের পরিণতিও অনিবার্য ভাবে ওই ব‍্যাঙের মতোই হবে। সেদিন হয়তো আমরা বাঁচার আপ্রাণ প্রচেষ্টা করবো। কিন্তু তখন আমাদের সব প্রচেষ্টাই বৃথা যাবে। তাই সময় থাকতেই আশুন আমরা বিভক্ত না হয়ে এক‍্যবদ্ধ ভাবে এই অশুভ, মানবতাবিরোধী, স্বার্থান্বেষীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলি।

Related Articles

Back to top button
error: