HighlightNewsধর্ম ও দর্শন

কারবালার আদর্শ || মাওলানা আবুল কালাম আজাদ

মাওলানা আবুল কালাম আজাদ: হযরত ইমাম হোসেনের রা শাহাদাতের হৃদয়বিদারক ঘটনা ইসলামের ইতিহাসের সর্বদা রক্তাক্ত করে লেখা রয়েছে এবং অশ্রুলচনে তা পঠিত হয়ে চলেছে। কিন্তু এই মর্মান্তিক ঘটনার ভিতরে ইসলামের যে অজস্র শিক্ষনীয় ব্যাপার নিহিত রয়েছে তা যেন শোকের প্রবল প্লাবনের অতলে তলিয়ে গেছে। তার ভিতরকার সর্বাঙ্গীন সুন্দর আদর্শ শোকের সুনিতাক্ত চাদরের তলায় ঢাকা পড়েছে আজ।
তাই প্রাচীনকাল থেকে শোকের যে ধারা অব্যাহত গতিতে চলে আসছে যে ধরনের মাতমের মজলিস এতদিনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে চলেছে তার সাথে আজ আসুন একটা নতুন ধরনের শোকের মজলিস গড়ে তুলি। সেখানে আমরা কারবালার আঘাতে জর্জর অন্তর থেকে শত উৎসারিত শনি থাকতো অশ্রু ধারা ক্ষণিকের জন্য মুলতুবি রেখে শাহাদাতের অমর কীর্তি তাকে ইসলামী আদর্শের পবিত্র উৎসব করে তুলতে চাই।
বস্তুত আমি হোসেনের শাহাদাত নিয়ে মাতাম করার এটা একটা সার্থক পরিণতি হবে। ইসলামী সংবিধান উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য এ ধরনের শোক সভা করার নির্দেশ দেয়।

পৃথিবীতে পূর্বপুরুষকে শ্রদ্ধা জানাবার স্বাভাবিক প্রবণতা সব জাতির ভিতরে সব সময় ছিল তাই দেখা যায় সব জাতির তাদের পূর্বপুরুষদের নিয়ে বিভিন্ন পদ্ধতিতে সব পালন করে চলেছে তাদের কীর্তিকলাপকে এভাবেই দিয়ে রেখে ভাবি বংশধরদের তা থেকে প্রেরণা ও উপদেশ গ্রহণ করানোই হল এর উদ্দেশ্য। তবে পূর্বপুরুষের স্মৃতি রক্ষার ব্যবস্থা পৃথিবীতে রয়েছে তার ভিতরে সবচাইতে জনপ্রিয় ব্যবস্থা হচ্ছে প্রতিমা পূজার ধারণাটি। মূলত মূর্তি পূজার আদি ও অন্ত সবখানেই যেন এ প্রবণতা প্রকট। আদিতে এজন্যে যে প্রায়ই দেখা গেছে মানুষ এ পথেই ধীরে ধীরে গিয়ে প্রতিমা পূজার সন্ধান পেয়েছে। আর অন্ধ এজন্য যে প্রতিমা পূজা চলে যাবার পরেও পূর্বপুরুষ পূজার রূপ নিয়ে তা আবার আত্মপ্রকাশ করেছে। এখানে আমি পূর্বপুরুষের স্মৃতি রক্ষার সেই ব্যবস্থাটির প্রতি ইঙ্গিত করলাম, যাতে পূর্বপুরুষদের মূর্তি তৈরি করে যুগে যুগে অর্ঘদানের প্রচলন রাখা হয়েছে তাদের এ জন্য এভাবে অর্ঘ্য দেওয়া হয়েছে যে তাদের কীর্তি করা পরবর্তীতে চলার পথ দেখাবে ও প্রেরণা যোগাবে।
যদিও পূর্বসূরীদের স্মৃতি রক্ষার এটা অত্যন্ত পুরনো পদ্ধতি এবং হযরত নূহের কাল পর্যন্ত এ ধরনের কয়েকটি প্রতিকৃতি গড়ে উঠেছিল যেগুলোকে প্রকাশ্যেই পূজা করা হতো তথাপি এটা সত্য যে গ্রীক ও মিশরীয় সভ্যতা এসে তাকে সভ্যতাসুলভ রঙ জড়িয়ে অত্যন্ত আকর্ষণীয় করে তুলেছে । আজ ইউরোপের সভ্যতা ও সংস্কৃতির স্রষ্টাদের যে প্রতিকৃতি প্রদর্শিত হচ্ছে তাতে গ্রিক সভ্যতার সুস্পষ্ট ছাপ দেখতে পায়। হিন্দুদের দর্শন স্তম্ভে যে সকল প্রতিকৃতি দৃষ্টিগোচর হচ্ছে তাতেও তার আভাস দেখতে পাচ্ছি।
কিন্তু ইসলাম হচ্ছে একক ও অদ্বিতীয় মতবাদ। তাই তা চাচ্ছে নির্ভেজাল একত্ববাদের প্রতিষ্ঠা। সুতরাং মানবীয় গুরুত্ব ও মর্যাদার সকল পথ ইসলাম রুদ্ধ করতে চাইলো। কারণ কোনক্রমেই যেন কোন মানুষকে আল্লাহর সমান বা তার কাছাকাছি মর্যাদা দেওয়ার সম্ভাবনা না থাকে। এর ভিত্তিতে ইসলাম মানবীয় স্মৃতি রক্ষার এরূপ কোন পন্থায়ী অনুসরণ করল না যার প্রভাবে মানুষের অতীতে বারংবার পদস্খলন ঘটেছে।
ইসলাম আত্মপ্রকাশ করেই সব ধরনের কার্যকলাপ ও রীতিনীতি প্রতি দৃষ্টিপাত করে নিল শুধু তাই নয় সবকিছুরই তত্ত্ব ও তথ্য পুরোপুরি জেনে নিল এবং সেগুলির মূল সত্তাটুকু গ্রহণ করে বাহ্যিক আবরণ বর্জন করলো।
বর্বরতা যেসব সত্যকে আঁধার পর্দায় ঢেকে রেখেছিল তা হঠাৎ ছেড়ে গেল মূর্খতা যে সব মনিমুক্তা পাথরের স্তুপ এর ভিতরে লুকিয়ে ফেলেছিল তাও মুক্ত হয়ে পৃথিবীর বুকে ঝলমল করে শোভা পেতে লাগলো। কৃত্রিম সভ্যতা যেসব সুস্পষ্ট জ্ঞান ও শিক্ষার উপর রং চড়িয়ে আসল রূপ চাপা দিয়েছিল তা আবার স্পষ্ট হয়ে ধরা দিল। এমন কি সত্য আবার সূর্যের মতো উজ্জ্বল হয়ে প্রতিটি মানুষের সামনে উদিত হলো অশেষ জ্ঞানের অক্ষর অক্ষয় ভান্ডার কুরআন এই বিরাট বিপ্লবটি মাত্র নিম্ন কয়টি শব্দে প্রকাশ করল।
আল্লাহ ঈমানদারদের বন্ধু। তাই তিনি তাদের সব অন্ধকার ও অস্পষ্টতা থেকে মুক্ত করে সঠিক জ্ঞানের ঐশি আলোকে উদ্ভাসিত করেন। পক্ষান্তরে অবিশ্বাসীদের বন্ধু হচ্ছে তাদের পূয্য দেবতারা। তারা তাদের খোদা প্রদত্ত আলো থেকে বঞ্চিত করে বর্বর ও বিভ্রান্তির গভীর অন্ধকারে টেনে নেয়।

মানব জীবনে এ ছিল এক বিস্ময়কর ও ব্যাপক বিপ্লব। ইসলামের প্রতিটি শিক্ষার ভিতরে এর আভাস স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়। এমনকি বিখ্যাত পূর্বপুরুষ ও মহা মানবদের উপরে শোক প্রকাশের যে পদ্ধতি ইসলাম দেখিয়েছে তাতেও এ বিপ্লবের তরঙ্গ সমভাবে দেখা দিয়েছে। বস্তুত পূর্বসূরীদের স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখার জন্য আদিকাল থেকে যে পদ্ধতি চলে আসছিল ইসলাম তার ভিতরেও এক অন্য বিপ্লব সৃষ্টি করল। ইসলাম মুসলমানদের মুক্তি করে পূর্বগামীদের পূজা করার অনুমতি দেয়নি। কারণ তা শেষ পর্যন্ত মূর্তিপূজায় পরিণতি লাভ করে। অথচ ইসলাম কখনো জীবিত মানুষের মর্যাদার শির নির্জীব পাথরের কাছে নত হতে দেয়নি। পক্ষান্তরে ইসলাম বিখ্যাত ও মহান পূর্বকামীদের আদর্শ জীবনস্মৃতিকে লোক পেতেও দেয়নি।
করার অনুমতি দেয়নি। কারণ, তা শেষ পর্যন্ত মূর্তিপূজায় পরিণতি লাভ কপূজ অথচ ইসলাম কখনও জীবিত মানুষের মর্যাদার শির নির্জীব পাথরের কাছে নত হতে দেয়নি। পরন্তু, তাঁদের পূণ্য জীবনস্মৃতিকে প্রতিটি মুসলমানের কাছে সর্বযুগে অমর করে রাখার জন্যে এ ব্যবস্থাও অবলম্বন করেছে যে, প্রত্যেক দিন সে পাচবার নামাযের সময়ে খোদার কাছে সেই পথে চলার শক্তি প্রার্থনা করবে, যে পথে সেই মহাত্মাগণ চলে নিজেদের ধণ্য করে গেছেন। (এ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। তাই এ নিয়ে এখানে ব্যাপক আলোচনা সম্ভবপর নয়। বলেই আমি আমার কৃত সূরা ফাতিহার তফসীর পড়ে নেয়া প্রয়োজন মনে করি।)

সুতরাং শোক প্রকাশের পদ্ধতির মাধ্যমে বর্বরতা তার মূল উদ্দেশ্যের ওপরে যে কালো পর্দা টেনে দিয়েছিল, বিকৃত সভ্যতা ও সংস্কৃতি তার ওপরে যে ধরনের রঙ চড়িয়ে মূল রূপ বদলে দিয়েছিল, ইসলাম এসে সে সব ঘোর যবনিকা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিল। সাথে সাথে এর পেছনে যে সত্য লুকিয়েছিল তা মানুষের সামনে দিবালোকের মত উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।

জ্ঞান-ভাণ্ডার কুরআন অতীতের নবীদের যেসব ইতিহাস তুলে ধরেছে, তাঁদের জীবনের যেসব উল্লেখযোগ্য ঘটনা আলোচনা করেছে, তার ভেতরে ঠিক সেই উদ্দেশ্যই নিহিত রয়েছে, যা মূর্তির ভেতরে আত্মগোপন করে এতদিন মানুষকে ধোকা দিয়ে চলছিল। কুরআন মহান পূর্বগামীদের ও আদর্শ মহামানবদের জীবন কাহিনীকে ‘উত্তম আদর্শ’ বলে আখ্যায়িত করেছে এবং মুসলমানদের দৃষ্টি বিভিন্ন স্থানে সেদিকে আকৃষ্ট করেছে ।

এই কারণেই আপনারা কুরআন শরীফে বারংবার দেখতে পেয়েছেন যে, হযরত ইব্রাহীমের (আঃ) জীবনাদর্শকে মুসলমানদের লক্ষ্যস্থল ও গন্তব্যস্থল বলে উল্লেখ করা হয়েছে
“তামাদের জন্যে ইব্রাহীম ও তাঁর সংগীদের জীবনাদর্শকে উত্তম নমুনা করে রাখা হয়েছে।”
সুতরাং এ কথা নির্ঘাত বলা চলে, ইসলামই হচ্ছে পয়লা ধর্ম যাতে পূর্ববর্তীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের সত্যিকারের পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছে। সেই সঠিক পদ্ধতির ভিত্তিতে আজ হযরত ইমাম হোসায়েনের (আঃ) শাহাদতের আদর্শকে জিইয়ে রাখা আমাদের কর্তব্য, অর্থাৎ তাঁর শাহাদতের ভেতরে যে ধৈর্য ও স্থৈর্য, অটল ও অটুট মনোভাব, দমননীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার প্রেরণা, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, সত্য প্রতিষ্ঠা ও অসত্যের মূলোচ্ছেদের মহান ব্রত ইত্যাকার বিরাট বিরাট আদর্শ রয়েছে, তা সর্বযুগে আমাদের ভেতরে অমর করে রাখব। অন্তত বছরে একবার সত্যধর্মের স্বার্থে আত্মোৎসর্গের প্রেরণা ও শিক্ষা সমগ্র জাতির ভেতরে ছড়িয়ে দেয়া চাই।

কিন্তু এসব শিক্ষণীয় ব্যাপার ছাড়াও হযরত ইমাম হোসায়েনের (রাঃ) নিজের অবস্থার ভেতরেও আমাদের জন্যে বিরাট এক আদর্শ নিহিত রয়েছে। ধর্মের ইতিহাসের গোড়া থেকেই তা চলে এসেছে এবং ইসলামের পরিপূর্ণতায় এসে তা থেমেছে।

পৃথিবীতে আমরা দেখতে পাই, ধর্মের ইতিহাসের প্রারম্ভ আশ্চর্য অসহায় অবস্থায় হয়েছে। আমরা এ জগতের যে কোন কঠিনতম অবস্থায়ও পুত্রের সাথে পিতাকে, ভাইয়ের সাথে ভাইকে, স্বামীর সাথে স্ত্রীকে সহযোগিতা করতে দেখেছি। কেবল ধর্মের আধ্যাত্মিক দুনিয়ায়ই পুত্রকে পিতা, ভাইকে ভাই এবং স্বামীকে স্ত্রী ত্যাগ করে গেছে। শুধু তাই নয়, তাদের বিপদ আরও বাড়িয়ে তোলার ব্যাপারেও সহযোগিতা করেছে।

এই কারণেই নবী-পরিবার সর্বদা আত্মীয়-স্বজনদের সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। হযরত নূহ (আঃ) দীর্ঘকাল ধরে দিন-রাত তাঁর জাতিকে ধর্মপথে আহ্বান করেছেন। কিন্তু, তাঁর জাতি বিদ্বেষ ও শত্রুতার বশে সেই একত্ববাদের ডাকে সাড়া দিল না। শুধু তাই নয়, তারা কানে আঙ্গুল দিয়ে অন্য দিকে চলে যেত এবং শেষ পর্যন্ত দলবদ্ধভাবে তাঁকে বর্জন ও বয়কট করল। এ সম্পর্কে কুরআন বলছে :
” হযরত নূহ (আঃ) আরয করল : খোদাওন্দ! আমি দিন রাত সত্যের পথে আহ্বান জানিয়ে ফিরলাম। কিন্তু, তার ফল দাঁড়াল বিপরীত। তারা আমার থেকে আরও দূরে সরে চলল ।
আমি যখন তাদের তোমার ক্ষমা লাভের জন্যে ডাকলাম, তারা কানে আঙ্গুল দিয়ে অন্য দিকে চলে গেল। কানে কাপড় জড়িয়ে নিল যেন তোমার বাণী তারা শুনতে না পায়। আহা! সত্য সম্পর্কে এই অজ জাতি সর্বদাই ঘাড় বাঁকা করে অসত্যের পূজায় মত্ত হয়ে চলল ।”

শুধুমাত্র তাঁর জাতিই যে তার আহ্বানকে উপেক্ষা করেছে, তাই নয়। এমন কি তাঁর নিজ ঘরের দ্বার ও দেয়ালে ঘা পেয়েও খোদার বাণী ব্যর্থ হয়ে ফিরেছে। নবী-পরিবারের আশা-আকাংখার একমাত্র প্রতীক স্বয়ং নবীর পুত্র কেনানই বিদ্রোহী সেজেছে। অবশেষে খোদার গযব যখন প্লাবনের সংহারমূর্তি নিয়ে। আবির্ভূত হল, তখনও তিনি পুত্রকে খোদাদত্ত আশ্রয়ে স্থান গ্রহণের জন্য আহ্বান জানালেন। তখনও তার সম্বিৎ ফিরল না। ফলে ধ্বংশের কবলে নিপতিত হল।
“হযরত নূহ (আঃ) তার পুত্রকে (কর্মদোষে পুত্র খোদার গযবে নিপতিত হল) ডেকে বলল : হে আমার সন্তান! আমার সাথে এসে কিশতীতে বস এবং কাফেরদের সঙ্গ ত্যাগ কর। সে জবাব দিল : আমি পাহাড়ে চড়ে তুফান থেকে বেঁচে যাব। নূহ বলল : (তুই কি সব ভ্রান্ত ধারণায় ডুবেছিস?) আজ খোদার আযাব থেকে কেউই বাঁচবে না। হাঁ, তিনি যাদের ওপরে সদয়, তারাই শুধু বাঁচবে । এভাবে নূহের আহ্বান ব্যর্থ হল । তাঁর ও পুত্রের মাঝখানে প্রবল এক তরঙ্গ এসে ব্যবধান সৃষ্টি করল এবং অন্যান্য পাপীর সাথে সেও ডুবে মরল ।”
হযরত লুতের (আঃ) গোটা পরিবার যদিও তাঁর সাথী হয়েছিল, তথাপি স্বয়ং তাঁর স্ত্রী বিরোধী সেজে খোদার আযাবে নিপতিত হল। কুরআনে দেখছি

” আযাবের ফেরেশতারা বলল : আমরা এই পাপিষ্ঠ জাতির পাপের সাজা দেবার জন্যে প্রেরিত হয়েছি। আমাদের সাজা থেকে শুধু লুত এর পরিবার রক্ষা পাবে। তার ভেতর থেকে কেবল তাঁর স্ত্রী পাপীদের সাথে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। কারণ, সেও কাফেরদের সাথী।”

কিন্তু হযরত ইব্রাহীম (আঃ) থেকে হযরত মুহাম্মদ (সঃ) পর্যন্ত নবী বংশের ভেতরে এক বিরাট পরিবর্তন দেখা গেল। হযরত নূহ (আঃ) পুত্রের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ ঘটালেন। হযরত লুতের (আঃ) স্ত্রী তাঁর সাথে রইল না। কিন্তু, হযরত ইব্রাহীমের (আঃ) যুগে পুত্র পিতার, স্ত্রী স্বামীর, ভাই ভাইয়ের সত্যের ডাকে সাড়া দিল। শুধু তাই নয়, প্রচারের জন্যে যা কিছু ত্যাগ ও সাধনার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল, তারা তাতেও পরান্মুখ ছিল না। সর্বপ্রথম হযরত হাজেরা (রাঃ) এ পথে পা বাড়ালেন এবং তিনি স্বামীর ইংগিতে স্বীয় প্রাণাধিক পুত্র নিয়ে এক বন্ধ্যা ভূমিতে গিয়ে আশ্রয় নিলেন। তার চারপাশে কয়েক মাইলের ভেতরে খাবার বা পানীয় কিছুই ছিল না। খোদা কঠিন পরীক্ষার জন্যে সর্বপ্রথম হযরত ইসমাঈলকে (আঃ) নির্বাচন করলেন। যখন সেই কঠিন মুহূর্ত এল, তখন ইসমাঈল (আঃ) পিতার পূর্ণ আনুগত্য মেনে নিলেন ।

” ইসমাঈল (আঃ) যখন ইব্রাহীমের সাথে চলাফিরা করার মত সামর্থ্য পেল, তখন একদিন পিতা-পুত্রকে বলল : হে পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখলাম তোমাকে যেন খোদার পথে কোরবানী করছি। আমি বুঝি না এর রহস্য কী হতে পারে । তুমিই এখন ভেবে দেখ, কী করা উচিত। পুত্র বিনা দ্বিধায় তক্ষুনি জবাব দিল: হে পিতা! এ স্বপ্নে তো মনে হয় যেন এটা খোদারই ইংগিত। সুতরাং আপনি এখন খোদার নির্দেশ পালন করুন। আমাকে ইনশাআল্লাহ্ ধৈর্যশীল ও অটল দেখতে পাবেন । যখন পিতা-পুত্র উভয়ই খোদার ইচ্ছা পূরণের জন্যে প্রস্তুত হল এবং পিতা-পুত্রকে যবেহ করার জন্যে মাটিতে শোয়াল, তখন আমি ডেকে বললাম: হে ইব্রাহীম! এখন থেমে যাও। তুমি তোমার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করে দেখিয়েছে। আমি পুণ্যবানদের এ ভাবেই প্রতিদান দেই। সত্যিকারে তুমি যে ত্যাগের জন্যে উদ্যোগী হলে, তা বিরাট ত্যাগ বটে!

হযরত মূসার (আঃ) সাথেও তাঁর পরিবার সহযোগিতা করেছিল। যখন তুর পাহাড়ে প্রজ্বলিত আলো তাঁকে নবুয়তির সুসংবাদ দান করল, তখন তাঁর স্ত্রীও সঙ্গে ছিলেন। তাঁরই অনুরোধে আগুন সংগ্রহ করার জন্য মুসা (আঃ) সেখানে গিয়েছিলেন।

“যখন মূসা (আঃ) স্বীয় স্ত্রীকে নিয়ে মাদায়েন থেকে চলল, তখন তুর পাহাড়ের পাদদেশে সে আগুন দেখতে পেল। সে তাঁর স্ত্রীকে বলল : এখানে অপেক্ষা কর। আমি আগুন দেখতে পাচ্ছি। আমি খবর নিয়ে দেখি। হয়ত তোমার প্রয়োজন মেটাবার জন্যে আগুন নিয়ে আসতে পারব।

কিন্তু ইয়ামনের মাঠে গিয়ে বুঝতে পারল, এ কোন আগুনের শিখা নয়; বরং চোখ ধাধানো আলোর শিখা। এ যেন ফেরাউনের জোরযুলুমের ও শান শওকতের রাজত্ব জ্বালিয়ে দিতে চাচ্ছে। তাই, খোদা যখন সেখানে তাঁকে যষ্টি ও শ্বেত হস্ত’-এ দুই মারাত্মক হাতিয়ার দিয়ে ফেরাউনকে হেদায়েত করার জন্যে বললেন, তখন তিনি প্রার্থনা জানালেন স্বীয় ভাই হারুনকে সেই দায়িত্বের অংশী করে দেবার জন্যে । খোদা তাঁর সে প্রার্থনাও মঞ্জুর করলেন। কুরআনে রয়েছে :
” খোদা বললেন : আমি তোমার ভাইয়ের সাহায্যে তোমার বাহু শক্তিশালী ও জোরদার করে দিব। অবশেষে তোমাদের ফেরাউনের ওপরে জয়ী করব।
তাই দেখছি, হযরত হারুন (আঃ) শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত হযরত মূসার (আঃ) সহযোগিতা করেছেন এবং তিনি হযরত মূসার (আঃ) নবুয়তির কর্তব্যে সর্বদা অংশ গ্রহণ করেছেন।

হযরত মূসার (আঃ) পরে এই ধারার আরও উন্নতি ঘটে। একদা খোদার এক ত্যাগী বান্দা খোদার পথে নিজ পুত্র উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হয়েছিলেন। অবশেষে একদিন হযরত ঈসা (আঃ) স্বয়ং খোদার রাস্তায় আত্মোৎসর্গ করতে পা বাড়ালেন। তাঁর জন্যে শূলের যে আসন গড়া হল, তিনি বিনা দ্বিধায় তাতে আরোহণ করে প্রাণ উৎসর্গ করতে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু তাঁর পরিণতি সম্পর্কে কুরআনে আল্লাহ্ বলেন
” তারা ঈসাকে হত্যা করেনি, শূলেও চড়ায়নি; বরং তাঁর সে ত্যাগের পরিণতিটা তাদের কাছে গোপন করা হয়েছে।”

কিন্তু ইসলামের আবির্ভাব কাল পর্যন্ত খোদার পথে যত আত্মত্যাগ ঘটেছে, তা ছিল নেহাৎ ব্যক্তিগত। মানে, নবীগণ হয় নিজ সন্তানকে অথবা নিজেকে খোদার পথে উৎসর্গ করতেন। এ ছিল জেহাদের প্রারম্ভ-আদিরূপ। কিন্তু তার পূর্ণতা ইসলামী সংবিধানে এসে দেখতে পাই। ইসলাম যেভাবে তার ভেতরে আকায়েদ, ইবাদত, জীবন পদ্ধতি, এক কথায় ঐহিক ও পারলৌকিক সর্ববিধ কল্যাণকর পদ্ধতির পূর্ণতা ঘটিয়েছে, অতীতের সব ধর্মের আংশিক ও অসম্পূর্ণ বিধান যেরূপ ইসলামে এসে পূর্ণরূপ লাভ করেছে, তেমনি জেহাদের পূর্ণরূপ ও ইসলাম আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। এ পর্যন্ত কোন পয়গম্বরের গোটা পরিবার কোনদিন জেহাদে অংশ গ্রহণ করেনি।

শুধু তাই নয়, ব্যক্তিগতভাবে যখন কেউ আত্মত্যাগ করতে উদ্যত হয়েছেন, খোদা তাকে পথের মাঝেই থামিয়ে দিয়েছেন। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) তাঁর প্রাণপ্রিয় সন্তানকে খোদার পথে উৎসর্গ করতে গিয়েও সুযোগ পেলেন না। হযরত ঈসা (আঃ) শূলেতে আত্মদানের জন্যে এগিয়ে গেলেন। অথচ তাঁকে বাঁচিয়ে নেয়া হল। এ পর্যন্ত কোন নবীর গোটা পরিবার একত্র হয়ে খোদার পথে আত্মোৎসর্গ করার সুযোগ লাভ করেনি। এ পর্যন্ত কোন নবীর জীবনে দেখা যায়নি যে, শুধু পুত্র, স্ত্রী বা ভাইই নয়; বরং পরিবারের সবাই মিলে খোদার পথে আত্মদান করেছেন।
ইয়াজিদের একনায়কত্ব মেনে নেবার জন্য যারা হাত বাড়িয়েছিল তারা ইসলামী খেলাফতের গণতান্ত্রিক ভিত্তিকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করার ষড়যন্ত্রে যোগ দিয়েছিল। ধর্মের ভেতরে জেহাদ তো সত্যের প্রতিষ্ঠা ও অসত্যের মূলোচ্ছোদের জন্যেই রাখা হয়েছে। তাই, যখনই হযরত ইব্রাহীমের (আঃ) কোরবানীর আদর্শ বাস্তবায়নের সুযোগ এল, তখন নবী পরিবারের প্রত্যেক নর-নারী, কিশোর এক কথায় সবাই একযোগে অংশ গ্রহণ করলেন। খোদার পথে কোরবানী শূন্য শোনিতে এ পর্যন্ত ধরনীর বুক রঞ্জিত হয় না। ইসলাম এসে সে অপূর্ণতাও পূর্ণ করে দিল কারবালার রক্তস্রোতের ভেতর দিয়ে শিশু

সুতরাং হযরত ইমাম হোসায়েনের (রাঃ) ঘটনা যেমন ব্যক্তিগত ঘটনা নয়-বিচ্ছিন্ন ঘটনাও নয়। তার সম্পর্ক শুধু ইসলামের ইতিহাসের সাথেই নয়; বরং ইসলামের মূল রূপের সাথেই জড়িত। মানে, ইসলামের যে রূপ হযরত ইসমাঈলের (আঃ) ভেতরে আত্মপ্রকাশ করেছিল এবং তা ধীরে ধীরে উন্নতি লাভ করে হযরত ঈসা (আঃ) পর্যন্ত পৌঁছে আবার লোপ পেয়েছিল। তাকেই হযরত ইমাম হোসায়েন (রাঃ) নিজের মাথা বিকিয়ে চূর্ণ করে দিলেন।

পৃথিবীকে আবাদ করার জন্যে নবী পরিবার ধীরে ধীরে উজাড় হয়ে চলেছিল। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) দেশ ছেড়ে হিযরত করলেন, হযরত মূসা (আঃ) ঘর-বাড়ি ছেড়ে নীল দরিয়ায় পাড়ি জমালেন। হযরত ঈসা (আঃ) সন্ন্যাসী হয়ে পালিয়ে ফিরলেন। এবং হযরত মুহম্মদের (সঃ) পরিবার হযরত ইমাম হোসায়েনের (রাঃ) নেতৃত্বে কারবালার ময়দানে সংসার উজাড় করার ব্রতটি পূর্ণতায় পৌঁছালেন।

হযরত ইসমাঈলের (আঃ) সাথে আমাদের নবী পরিবারের সরাসরি রক্তের সম্পর্ক রয়েছে। তিনি আহার্য ও পানীয় শূন্য এক মরুপ্রান্তরে প্রবল তৃষ্ণায় ছটফট করে পায়ের গোড়ালি দিয়ে মাটি খুঁড়ে পানি বের করেছিলেন। হযরত ইমাম হোসায়েন (রাঃ) কারবালার ময়দানে সেই গোত্রীয় ধারাকে পুনর্জীবিত করলেন। সম্ভবত ইমামিয়া মতবাদের তফসীরকারগণ এই কারণেই ‘ওয়াফায়নাহ বেজবুহিন আজীম’ দ্বারা হযরত ইমাম হোসায়েনের (আঃ) শাহাদতকে নির্দেশ করেছেন। কোন কোন ইগাম এর সমর্থনে নবী পরিবারের দু’একজনের অভিমতও উদ্ধৃত করেছেন।

তরজমা রুহুল আমিন

Related Articles

Back to top button
error: