HighlightNewsদেশ

জাতীয় রাজনীতিতে মমতার সক্রিয়তা প্রশ্নের মুখে বিজেপি বিরোধী ঐক্য

মুহাম্মাদ নূরুদ্দীন

ভারতের রাজনীতি এখন এক যুগ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। স্বাধীনতার পর থেকে দীর্ঘ ছয় সাত দশক জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিয়েছে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস। এই সময়ে বিভিন্ন আঞ্চলিক দলের উত্থান ঘটলেও জাতীয় স্তরে তেমনভাবে দানা বাঁধতে পারে নি কোনো রাজনৈতিক দল। কিন্তু দীর্ঘ এক শত বৎসরের অবিরাম প্রচেষ্টার পর উগ্র হিন্দুত্ববাদকে পুঁজি করে উত্থান হয় ভারতীয় জনতা পার্টির। ১৯৮০ সালের আগে পর্যন্ত তারা ভারতীয় জনসংঘ নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু ১৯৮০ সালে ভারতীয় জনতা পার্টি গঠিত হওয়ার পর থেকে ডানপন্থী এই দলটি ভারতীয় রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। ধীরে ধীরে কংগ্রেস দুর্বল হতে থাকে। ১৯৯৮ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত অটল বিহারি বাজপেয়ির নেতৃত্বে এনডিএ জোট ভারত পরিচালনা করে। কিন্তু তারপর আবার ঘুরে দাঁড়ায় কংগ্রেস। ২০০৪ থেকে ২০১৪ মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বে কংগ্রেস সরকার দেশ পরিচালনা করে। ২০১৪ সালে আবার উত্থান ঘটে বিজেপির। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ঘুরে দাঁড়ায় ভারতীয় জনতা পার্টি। ২০১৪ থেকে ২০১৯ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নরেন্দ্র মোদী। ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচন অনেকের কাছে অপ্রত্যাশিত হলেও আবার ফিরে আসে বিজেপি সরকার। দ্বিতীয়বারের জন্য নরেন্দ্র মোদির প্রত্যাবর্তনের পিছনে ছিল বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির ঐক্যের অভাব। সেই সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফেডারেল ফ্রন্ট গঠন করার তৎপরতা চালায়। এতে জনগণ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। বিরোধী ঐক্যজোট ইউপিএ দুর্বল হয়ে পড়ে। লোকসভায় ৫৪২ টি আসনের মধ্যে ৩০৩ টি দখল করে নেয় এন ডি এ।

নরেন্দ্র মোদির দ্বিতীয় ইনিংস জনমনে তেমন কোনো সহানুভূতি তৈরি করতে পারেনি। কেন্দ্রীয় সরকারের একের পর এক জনবিরোধী সিদ্ধান্ত, পেট্রোল ও ডিজেলের লাগামছাড়া মূল্য বৃদ্ধি এবং সেই সাথে সাথে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিসের মূল্য বৃদ্ধি, রাষ্ট্রের উন্নয়নের পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলি কর্পোরেট সংস্থার হাতে বিক্রি করে দিয়ে দেশকে নিঃস্ব করে দেওয়ার প্রচেষ্টা, জাতীয় আয় বৃদ্ধির কোনো বিকল্প সন্ধান করার পরিবর্তে বিলাসিতার বাগাড়ম্বরে বিপুল অর্থ ব্যয়, কোভিড মহামারীর মত বিপর্যয় মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা এবং দক্ষতা দেখানোর পরিবর্তে গায়ের জোরে প্রচার সর্বস্ব কাজ করে চলার নীতি জনগণ ভালো মনে মেনে নিতে পারেনি। তাই দিকে দিকে বিধানসভা ও স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনগুলিতে ভারতীয় জনতা পার্টির বিপর্যয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। জনগণ বিকল্পের সন্ধান করছে।

এই পরিপেক্ষিতে সামনের কয়েকটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টি এখন ড্যামেজ কন্ট্রোলে’ নেমেছে। তারা ইতিমধ্যে জনবিরোধী কৃষি আইন প্রত্যাহার করেছে। দিকে দিকে উন্নয়নের কথা বলতে শুরু করেছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে সরকার যে মানসিকতা পোষণ করছে এবং গোড়া থেকে মাথা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা যেভাবে উগ্রতা ও দুর্নীতিতে ডুবে আছে তাতে তারা সহজে জনগণের আস্থা ফিরে পাবে বলে মনে হয় না। এ অবস্থায় ভারতের রাজনীতিতে বিকল্প শক্তির সন্ধান অব্যাহত। এই যুগ-সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে জাতীয় কংগ্রেস কি আবার নিজেদেরকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারবে? কংগ্রেসের আভ্যন্তরীণ অবস্থা এখন খুবই দুর্বল। এখনো দল কোনো শক্তিশালী নেতা নির্বাচন করতে ব্যর্থ। বিজেপির বিরুদ্ধে দেশজুড়ে আন্দোলন করার শক্তি তাঁরা হারিয়ে ফেলছে। একথা স্পষ্ট যে কোন একক দলের পক্ষে জাতীয় পর্যায়ে শাসকদলের মোকাবেলা করার পরিস্থিতি আর নেই। বিরোধী দলগুলোকে নিয়ে বিরোধী ঐক্য জোট গড়ে তোলা একান্ত জরুরি। এই পরিস্থিতিকে সামনে রেখে জাতীয় স্তরে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তিনি সারা দেশজুড়ে সংগঠন বিস্তার করার তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন।

কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের উচ্চাকাঙ্খার মধ্যে কোন অন্যায় নেই। প্রত্যেকেই নিজেকে বিস্তার করার চেষ্টা করবেন, নিজেকে আরো উপরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আন্দোলনের অভিমুখ এবং বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁর বক্তব্য জনমনে নানা জটিল প্রশ্ন তৈরি করছে। তাঁর আক্রমণের তীর যতটা না বিজেপির বিরুদ্ধে তার থেকে বেশি যেন কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। তিনি মহারাষ্ট্রে গিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করেছেন এনডি এ আবার কি? এখন নতুন জোট করার ভাবনা। অর্থাৎ সরাসরি কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোটের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া। বিভিন্ন পর্যায়ে দেখা গিয়েছে যে সকল রাজ্যে মমতা ব্যানার্জির দল পদক্ষেপ করছেন সেখানে বিজেপির থেকে কংগ্রেসের এমএলএ দেরকে ভাঙিয়ে দলে টানার প্রবণতা বেশি। বিজেপি কংগ্রেসকে শেষ করেছে। কংগ্রেসের যতটুকু অবশিষ্ট আছে তা যেন মমতা ব্যানার্জির হাতে শেষ হয় এটাইকি বিজেপির পরিকল্পনা? স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠছে তাহলে কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তলে তলে বিজেপির হয়ে কাজ করছেন? আরএসএস এর আদর্শ প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যেই ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র পরিণত করার তিনি একজন সহযোদ্ধা? জাতীয় রাজনীতিতে তার পদচারণাকে সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখা যাচ্ছে না। তাই চোরা স্রোত এর মত আরো একটি প্রশ্ন দানা বাঁধছে। অমিত শাহ নরেন্দ্র মোদিরাকি মমতা ব্যানার্জিকে পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে দিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে তাদের অবস্থানটা কে মজবুত করতে চেয়েছেন?

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে যেভাবে বিজেপির চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করে তিনি লড়াই দিয়েছেন তা সারাদেশে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলিকে অক্সিজেন দিয়েছে। বিজেপি বিরোধী প্রধান রাজনৈতিক মুখ হিসেবে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নাতিত। এখন যদি তিনি বিজেপি বিরোধী দলগুলোকে ভাঙার চেষ্টা না করে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখতে পারেন তবেই জাতীয় রাজনীতিতে তার গ্রহণযোগ্যতা অটুট থাকবে। কংগ্রেসকে আক্রমণ করে কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে বিকল্প রাজনৈতিক জোট গড়ে তোলার প্রয়াস হলে বাংলার জননেত্রীর উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।

Related Articles

Back to top button
error: