HighlightNewsইতিহাস ঐতিহ্যদেশ

স্বাধীনতাকামী বীর যোদ্ধাদের অনুপ্রাণীত করেছিল নজরুলের কবিতা ও গান

টিডিএন বাংলা ডেস্ক: বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন একাধারে কবি, সাংবাদিক, সংগঠক, সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ, দার্শনিক, রাজনৈতিক নেতা, শিল্পী, সুরকার, যন্ত্রবাদক, সম্পাদক, নাট্যকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামী। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সফল করার জন্যই অসাম্প্রদায়িক সার্বজনীন মানুষ এবং কবি হিসাবে আবির্ভাব হয়েছিল তাঁর। তিনি স্বাধীনতার কবি, সাম্যবাদের কবি, মানবতার কবি। বাংলা সাহিত্যের আকাশে ভোরের তারার মত চিরন্তন ও ভাস্বর। রবীন্দ্র প্রতিভার মধ্যগগনে চোখ ঝলসানো দীপ্তির ভেতরে বাংলা সাহিত্যের আর সব অগ্রজ কবি-সাহিত্যিকরা যখন জোনাকীর মত ম্রিয়মান; বাইশ বছরের যুবক কাজী নজরুল ইসলাম তখন জেগে উঠলেন বিদ্রোহের বিদ্যুৎ দীপ্তিতে। হাজারো গুণের সমাহারে বিশ্ব সাহিত্যে এমন কবি আর দ্বিতীয় জন নেই।

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা উদ্ধারে নজরুলের কাব্য ও সঙ্গীত ক্ষেপণাস্ত্রের মত শক্তিশালী ছিল একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। অত্যাচারী ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে আন্দোলনকারী ছাত্র ও আমজনতাকে উদ্দীপ্ত করতে নজরুলের কবিতা গান এটমবোমার চেয়েও ধারালো ভূমিকা রেখেছিল-
‘কান্ডারী তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর
বাঙালীর খুনে লালে লাল হলো ক্লাইভের খঞ্জর’
এ কবিতার মাধ্যমে কবি নজরুল ভারতবাসীর উপর বহিরাগত ইংরেজ শাসকের নির্মমতার চিত্র তুলে ধরেছেন।

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য নজরুল একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন যার নাম ‘অল ইন্ডিয়া স্বরাজ পার্টি’। এ দলের মাধ্যমে সংস্কৃতিমনা লোকদের তিনি সংগঠিত করে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলেন। দেশবাসীকে স্বাধীনতার চেতনায় জাগিয়ে তোলেন। নজরুলের কাব্য ক্ষেপণাস্ত্রে সন্ত্রস্ত হয়ে অত্যাচারী ব্রিটিশ তাঁকে গ্রেফতার করে নির্যাতন করে।

‘লাথি মার ভাঙরে তালা
যত সব বন্দীশালা
আগুন জ্বালা আগুন জ্বালা’
-কারাগারে বন্দি থেকেও দমে না গিয়ে নজরুল রুদ্ররোষ ফুঁসে উঠেন। এ কবিতাই তার প্রমাণ। ‘ছাত্রদলের গান’ রচনা করে তিনি ছাত্রদের স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেন। নজরুলের কাব্য প্রেরণাই ভারতেবর্ষের ছাত্ররা রাজনৈতিক ইতিহাসে স্বর্ণযুগ সৃজন করেছে-
‘আমরা শক্তি আমরা বল
আমরা ছাত্রদল
মোদের পায়ের তলায় মূর্ছে তুফান
ঊর্ধ্বে বিমান ঝড় বাদল
আমরা ছাত্রদল।’

স্বাধীনতা সংগ্রামের দুর্গম পথ সাহসের সাথে অতিক্রম করার প্রেরণা ও উৎসাহে তিনি কবিতা উপহার দিয়ে গেয়েছেন স্বাধীনতাকামীদের-
“দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাপার হে
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রী নিশিথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার।” ১৯২১ সালের দিকে মাওলানা মোহাম্মদ আলীর খেলাফত আন্দোলনের নেতৃত্ব যখন সর্ব ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন সফলতার কাছাকাছি ঠিক তখনি ঈর্ষান্বিত ভারতীয় কংগ্রেস আন্দোলন থেকে পিছু হটে যায় ইংরেজদের প্ররোচনায়। দখলদার ব্রিটিশ এই বলে কংগ্রেস নেতাদের বোঝাতে সক্ষম হয় যে, মোহাম্মদ আলীর দলের যদি বিজয় হয় তবে ভারতবর্ষে আবার মুসলমানী শাসন প্রতিষ্ঠা হবে এবং ব্রিটিশরা এ বলে কংগ্রেসকে আশ্বস্ত করলো, যদি স্বাধীনতা দিতে হয় কংগ্রেসের হাতেই দিবে। এ প্ররোচনায় কংগ্রেস সফলতার দ্বারপ্রান্তে উপনীত আন্দোলনকে ল্যাং মারে। তারই প্রেক্ষাপটে নজরুল লেখেন-

“গিরি সংকট ভীরু যাত্রীরা গুরু গরজায় বাজ
পশ্চাৎ পথযাত্রীর মনে সন্দেহ জাগে আজ
কান্ডারী তুমি ভুলিবে কি পথ? ত্যাজিবে কি পথ মাঝ?
করে হানাহানি তবু চলো টানি নিয়াছো যে মহাভার।” ব্রিটিশ প্ররোচনায় কংগ্রেসের ক্ষমতার মানসিকতায় যখন মাওলানা মো. আলীর আন্দোলন ভেস্তে যাচ্ছিল ঠিক তখনই কবি নজরুলের কলম আবারও গর্জে উঠে-
“অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া জানেনা সন্তরণ
কান্ডারী আজ দেখিবো তোমার মাতৃমুক্তি পণ।
হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোনজন?
কান্ডারী বল- ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা’র।”

১৯২৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি।
নজরুল তখন আলীপুর জেলে বন্দী। নজরুলের আকৈশোর সৃহৃদ পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে ডেকে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘জাতির জীবনে বসন্ত এনেছে নজরুল। তাই আমার সদ্য প্রকাশিত ‘বসন্ত’ গীতি নাট্যখানি ওকেই উৎসর্গ করেছি। ১৯২৮ সালে ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় চিরস্মরণীয় বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। এই সব জ্বালাময়ী লেখার জন্য কবি বৃটিশ শাসক গোষ্ঠীর রুদ্ররোষে পতিত ও কারারুদ্ধ হন। ঐক্যবদ্ধভাবে বৃটিশের বিরুদ্ধে তথা বিদেশী শাসক-শোষকদের বিরুদ্ধে আজীবন আপোষহীন সংগ্রাম করেছেন নজরুল। ভারতীয় জাতীয়তাবোধ এবং স্বদেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ হলেও নজরুল বাঙালী চেতনায়ও উদ্বুদ্ধ ছিলেন। যেমনি তিনি উদ্বুদ্ধ ছিলেন মুসলিম জাতীয়তাবোধে এবং ইসলামী চেতনায়। স্বদেশপ্রেমিক নজরুলের পক্ষেই তাই উচ্চারণ করা সম্ভব ছিল- ‘কিছুতেই যেন ভুলিতে নারি, এ মাটির মায়ের মায়া/মোর ধ্যানে হেরি আল্লাহর পাশে, এই বাঙলার ছায়া।’ স্বদেশ প্রেম ঈমানের অঙ্গ-একথা মনে রাখলে স্বদেশ প্রেমিক নজরুল বক্তব্যের তাৎপর্য উপলব্ধি করা সহজ হবে।

১৯৪২ সালের মাঝামাঝি নজরুল অসুস্থ ও বাকশক্তিহীন হয়ে গেলেও নজরুলের কবিতা, গান ও অন্যান্য রচনা এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অনুপ্রেরণার উৎস হয়েছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে ‘কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙে ফেল কররে লোপাট’, ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর’, ‘ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়েও খাটি আমার দেশের মাটি’-এমনি অনন্য ২০টি দেশাত্মবোধক সংগীত স্বাধীনতাকামী বীর যোদ্ধাদের অনুপ্রাণীত করেছিল। ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে কবির অমর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিশেষ সমাবর্তনে জাতীয় কবিকে সম্মানসূচক ডি-লিট উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

১৯৬০ সালে ভারত সরকার কবিকে ‘পদ্মভূষণ’ ও ১৯৬৯ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডি-লিট উপাধি প্রদান করেছিল। ১৯২০ সনের ২০ জুলাই অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে কলকাতা হাইকোর্টের স্বনামধন্য ও অপ্রতিদ্বনদ্বী আইনজীবী এ.কে. ফজলুল হকের পৃষ্ঠপোষকতায় সান্ধ্য দৈনিক ‘নবযুগ’ প্রকাশিত হলে সদ্য সেনাবাহিনী থেকে প্রত্যাগত একুশ বছরের টগবগে তরুণ হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলামের সাংবাদিক জীবনের সূত্রপাত ঘটে।কবি নজরুলই বাংলা সাহিত্যের প্রথম কবি, যিনি সাংবাদিকতা ও রাজনীতিকে সাহিত্য ও কাব্যের প্রাণবন্ত করে তুলেছিলেন।

অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্ব হিসাবে কাজী নজরুল ইসলামকে তৎকালীন বাংলার হিন্দু-মুসলমান মিলনের অগ্রদূত হিসাবে গণ্য করা হত। অনন্য সাধারণ ও আপোষহীন সরকার বিরোধিতার খেসারত কবিকে দিতে হয়েছে বহুকাল কারাভোগ করে। একবিংশ শতাব্দিতেও এক মহান মানবতাবাদী উপনিবেশবাদ তথা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম দেশবাসীর মন প্রাণে চির উজ্জ্বল।

Related Articles

Back to top button
error: