পাঠকের কলম

পেরেকবিদ্ধ প্রতিবেশী আর নয়, আসুন, তাদের আগলে রাখি

পাঠকের কলম, টিডিএন বাংলা: সদ্য চলে গেল আরও একটা ৫ই জুন। বালতি, কোদাল হাতে শিশু উদ্ভিদের সঙ্গে আমরা আনন্দে মাতলাম, সেলফি তুলাম। সেই ছবিতে ভরে উঠল ফেসবুকের পাতা। যদিও মাসখানেক পর ক’জন উদ্ভিদ-শিশুর শরীরে কচিপাতা গজাবে, এবং গজালেও সে-পাতা ছাগলে খাবে কিনা, সে খোঁজ রাখার অবসর আমাদের অনেকেরই হবে না। তাদের কচি শরীরের যত্ন নিতে বয়েই যাবে আমাদের !

আসলে তো আমরা সিংহভাগই দিন ভালোবেসে গাছ লাগাই, গাছ ভালোবেসে নয়। ভালোবাসলে প্রিয় প্রতিবেশীকে ক্রুশবিদ্ধ করে মহোৎসবে মাততে পারতাম না। বিশ্ব পরিবেশ দিবসেও চোখে পড়ল বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং, ফ্লেক্স নিয়ে পেরেকবিদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বহু গাছ। সদ্য শেষ হয়েছে একটা ভোট-পর্ব। খরচ এবং সময় বাঁচাতে রাজনৈতিক নেতারাও গাছে পেরেক ঠুকে ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন দলীয় পতাকা। গাছের বুকের ক্ষত থেকে সেইসব ক্ষমতার নিশান আজও সদর্পে উড়ছে রাস্তার দুপাশে।

কোনও রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা ইস্তাহারেই পরিবেশ পরিচিতি পায়না। আমরাও অধিকাংশরা সারা বছর ভুলে থাকি পরিবেশ নামের কিছু একটা আছে। তাই যে গাছ আমাদের বেঁচে থাকার নূন্যতম প্রয়োজন খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান জোগায় এবং এর থেকেও প্রয়োজনীয় প্রাণবায়ু দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে, তার বুকেই পেরেক পুঁতি আমরা, বিনা অপরাধে হত্যা করি তাকেই। আমরা নির্লজ্জভাবে ভুলে থাকি, গাছ কাটা অপরাধ। এমনকী গাছের গায়ে পেরেক পোঁতাও বেআইনি। অমানবিকও। ভুল বললাম, অ-উদ্ভিদিক। গাছের শরীরে পেরেক পুঁতলে তাদের সংবহনতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বেশিদিন পোঁতা থাকলে পেরেকে মরচে পড়ে গাছের স্বাভাবিক জৈবিক প্রক্রিয়া নষ্ট হয়। তাদের জীবনীশক্তি কমে যায়। কিন্তু, তাতে আমাদের কী ! আমরা মনুষ ! আমরা  আমাদের জীবন ও শক্তি বাড়ানোর জন্য যা খুশি তাই করতে পারি ! এভাবে ভাবের ঘরে চুরি করেই না আমরা পৃথিবীর ‘শ্রেষ্ঠ জীব’ উপাধি নিয়েছি !

গাছ পৃথিবীর সিনিয়র সিটিজেন, আমাদের জীবন যাপনের সমস্ত রকম জোগান আসে গাছের ঘর থেকে। তবুও আমাদের সব প্রয়োজনে, সব উন্নয়নে, শিল্পায়নে, নগরায়নে প্রথমেই আমরা গাছের গলায় করাত চালাই। এমনকী, শুধুমাত্র পাতা ফেলে বাড়ির উঠোন অথবা ছাদ নোংরা করার অজুহাতেও খুন হতে হয় অনেক গাছকে। এ আমাদের সভ্যতার পাপ। শাস্তিও পাচ্ছি তার। তবুও হুঁশ ফিরছে না।

মন্বন্তরে খাদ্যের আকাল হয়, জানি। ইদানীং জল সংকট কথাটাও শুনছি। কিন্তু  কোনদিন ভাবিনি যে-বাতাসের ২১% অক্সিজেনে ঠাসা, তার মধ্যে ডুবে থেকেও অক্সিজেনের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতে হবে আমাদের ! আমরা থার্মোমিটারে জ্বর মাপি, যন্ত্রে ওজন মাপি, সুগার, প্রেসার, কোলেস্টেরল সব মাপি। এখন ঘনঘন শরীরের অক্সিজেন লেবেলও মাপতে হবে ভাবিনি কোনদিন। আমরা মানুষ তো, পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী কিনা, তাই আমরা সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য ব্যাংকে টাকা জমাই, গাড়ি কিনি, বাড়ি বানাই ! কিন্তু তার শ্বাসের জন্য অক্সিজেন জমাই কি ? আমরা নিজেরাই আমাদের বুদ্ধির গোড়ায় গজাল পুঁতে রাখিনি কি? এখনও সময় আছে গজাল উপড়ানোর, গাছের শরীর থেকে আর আমাদের মাথা থেকেও।

সারথি বিশ্বাস (শিক্ষিকা)
পিপুলখোলা প্রাথমিক বিদ্যালয়
থানারপাড়া নদীয়া

Back to top button
error: