HighlightNewsসম্পাদকীয়

আবার জিতে গেল ঘৃণা শিল্পীর স্বাধীনতায় উগ্র হিন্দুত্বের থাবা

মুহাম্মদ নুরুদ্দিন,লেখক

মুহাম্মাদ নূরুদ্দীন: ২৮ ডিসেম্বর ২০২১। ব্যাঙ্গালোর পুলিশ আবার বাতিল করল কমেডিয়ান মুনাওয়ার ফারুকীর কমেডি শো। উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের চাপে এই জনপ্রিয় শিল্পীর অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে বলে অভিযোগ। গত কয়েক মাসে এই নিয়ে মুনাওয়ার ফারুকীর বারোটি শো বাতিল করল প্রশাসন। ব্যাঙ্গালোরের সভা বাতিল হওয়া প্রতিক্রিয়ায় মুনাওয়ার ফারুকী লিখেছেন “ঘৃণা জিতে গেল, একজন শিল্পী হেরে গেল অনেক করলাম আমি। বিদায়, অবিচার।” তিনি আরো লিখেছেন “আমার নাম মুনাওয়ার আমি এখানেই ইতি করলাম।” তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তাঁর কমেডি শো নাকি হিন্দু ভাবাবেগে আঘাত করে। মুনাওয়ার ফারুকী জানিয়েছেন তিনি এমন কিছু করেন নি যাতে কোন ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষের মনে আঘাত লাগতে পারে তাঁর সেন্সর সার্টিফিকেট আছে। শুধু তাঁর নাম মুনাওয়ার ফারুকী তাই তাঁর বিরুদ্বে এই ঘৃণা।

হিন্দু জাগৃতি সমিতি এবং জয় শ্রী রাম সেবা সংগঠন পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছে যে এই কৌতুক হিন্দু ভাবাবেগে আঘাত করে। তাই পুলিশ আইন শৃংখলার অজুহাতে একের পর এক তার সভা বাতিল করে চলেছে।

ভারতের সংখ্যালঘু ও দলিত সম্প্রদায়ের উপর আঘাত এই প্রথম নয়। দিনের-পর-দিন উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের আক্রমণ বেড়েই চলেছে। কংগ্রেস নেতা শশী থারুর মন্তব্য করেছেন “এটা সুস্পষ্ট ভাবে বাক স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ এবং এটা আমাদের জন্য লজ্জার।”
এদেশে মুসলিম ও দলিতদেরকে নিশানা করে উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি একের পর এক হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। কখনও মব লিঞ্চিং, কখনো মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া, কখনো শিল্পীর স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ, কখনো নামাজের স্থানে জয় শ্রীরাম স্লোগান দিয়ে নামাজে বিঘ্ন ঘটানোর চেষ্টা একের পর এক বহুমুখী আক্রমণের শিকার ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিমরা। এদিকে দলিতদের উপর সামাজিক ও অর্থনৈতিক বঞ্চনা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। দলিত নারীদের ধর্ষণ করে হত্যার ঘটনা দেশ জুড়ে বাড়ছে। অথচ কী রাজ্য সরকার কি কেন্দ্রীয় সরকার এসব বিষয়ে তৎপর বলে মনে হচ্ছে না। ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীন ভারতের জন্য এটা লজ্জার। মনে রাখতে হবে হিংসা-বিদ্বেষ ঘৃণা পরশ্রীকাতরতা কখনো কোন জাতিকে উন্নতির পথ দেখাতে পারেনা। আজ যারা দেশভক্ত বলে নিজেদেরকে জাহির করতে চায় যারা তাদের নিজেদের কৃষ্টি-কালচার সভ্যতা ও সংস্কৃতি অন্যের ঘাড়ের উপর চাপিয়ে দিতে চায় তারা সভ্যতার এই সাধারণ সূত্র মেনে চলে না। সেই সভ্যতা তত উন্নত যে সভ্যতায় মানুষের প্রতিভা সুস্থ ভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়। সেই জনসমাজ টিকে থাকে যে সমাজে মানুষের সম্মান মর্যাদা জীবন ও সম্পদ সুরক্ষিত থাকে। আজকের যারা দেশজুড়ে ঘৃণার রাজনীতি করছে যারা হিংসা বিদ্বেষ ছড়িয়ে গোটা দেশকে অগ্নি কুণ্ডে পরিণত করতে চাচ্ছে তারা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে না বরং দেশকে অন্ধকার জগতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এটা দেশ ভক্তির নিদর্শন নয় বরং এটা দেশদ্রোহীতার নিদর্শন। মনে রাখতে হবে এ দেশের সংবিধান দেশের প্রতিটি মানুষের সমান অধিকার দিয়েছে। প্রতিটি মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছে। যদি কোন সরকার সেই অধিকার সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হয় তাহলে সেটা তাঁর অযোগ্যতা। আর ইতিহাসের অমোঘ বিধান এই যে কোন অযোগ্য ব্যক্তিকে কোন জাতি কখনো মাথায় তুলে রাখে না। তাই আজকের যারা হিন্দুত্ববাদের জিগির তুলে সংখ্যালঘু ও দলিত সমাজের উপর আঘাত করছে তারা মূলত ভারতের অস্তিত্বের মূলে কুঠারাঘাত করছে। হিন্দু ধর্ম সহ কোন ধর্মে এই ধরনের ঘৃণা বিদ্বেষ ও হিংসা কে প্রশ্রয় দেওয়া হয়নি। সব ধর্ম মনুষ্যত্বের শিক্ষা দিয়েছে। সকল মানুষকে আপন করে নেওয়ার শিক্ষাই হল ধর্মের মূল শিক্ষা। আজকের যারা ধর্মের নামে জয় শ্রীরাম স্লোগান দিয়ে রক্তের হোলি খেলতে যাচ্ছে তারা প্রকৃত ধার্মিক নয়। বরং ধর্মের নামাবলী গায়ে দিয়ে তারা উগ্রতা ও হিংসার পূজা করছে। এই অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রয়োজন রুখে দাঁড়ানোর। বিশেষ করে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের উদার মনোভাবাপন্ন নিরপেক্ষ মানুষদের দায়িত্ব অনেক বেশি। তারা যদি এই উগ্রতার কাছে আত্মসমর্পণ করে তাহলে সাংঘাতিক সংকটের মধ্যে পড়বে ভারতের সংস্কৃতি ও সভ্যতা। এক অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাবে দেশ। এ অবস্থা চলতে দেয়া যায় না।

Related Articles

Back to top button
error: