Highlightসাহিত্যসাহিত্য ও সংস্কৃতি

গল্পের নাম:- “রিজু বাঁচতে চেয়েছিলো” গল্পকার:-মোস্তফা কামাল (পর্ব-১৭)

 

রিজুর বড়ো মেয়ে হাসি অত্যন্ত সাদাসিধে। সবাইকে খুব বিশ্বাস করে। দেখতে সুন্দরী। হাসি দাদুর বাড়ি যেতে খুব পছন্দ করে। ওর কাকুদের সাথে শালবন, নদীর ধার,মাঠ ঘাট ঘুরে আসে। যেখানে ওর বাবার বাল্যকালের স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে সেগুলো ঘুরে ফিরে দেখে। সোঁদা মাটির ঘ্রাণে হাসির প্রাণ জুড়ায়। একমাত্র শহুরে ভাইঝিকে কাছে পেয়ে তার পিসিরাও ভীষণ খুশি হয়।

ওর সবে মাত্র বারো ক্লাস। গরমের ছুটি চলছে। মায়ের কাছে আবদার, দাদিমার বাড়ি বেড়াতে যাবে। মায়ের কাছে অনুমতি চায়।

মিতা: এখন যেতে হবে না দাদির বাড়ি।

হাসি: ছুটিটা তাহলে ঘরের মধ্যেই কাটাবো মা?

মিতা: ছুটির পরেই তোর পরীক্ষা। পরীক্ষার আগে কোথাও যাবি না।

হাসি: একটু ঘুরে আসতে দিন মা। আমি ফিরে এসে সব পড়া পুষিয়ে নেবো।

মিতা: আমি ওসব বলতে পারবোনা।সর এখান থেকে।

হাসি বাবার কাছে যায়। বলে, “পাপা, ছুটির দুটো দিন দাদিমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসবো?”

রিজু: তোমার মাকে বলো।

হাসি: বলেছি। মা বারণ করছেন।

রিজু: ঠিক আছে আমি তোমার মায়ের সঙ্গে কথা বলছি।

রিজু মিতার সঙ্গে কথা বলে। মেয়েটি আমার কোথাও যায়না। ও একটু ঘুরে আসুক না দাদির বাড়ি থেকে। তাহলে ওর একঘেয়েমিটা কাটবে।

মিতা: আমি ওসব কিছু বলতে পারবোনা। নাতিদের কত খোঁজ নেয় দাদু দাদি যে দাদির বাড়ি যাবে! গলায় একটা অভিমানের সুর।

রিজু: খোঁজ নিক আর না নিক ওরাই তো ওর আপনজন। তাই বলে দাদু দাদির বাড়ি যাবেনা?

মিতা: আমাকে বিরক্ত করোনা। আমাকে কাজ করতে দাও। সরো এখান থেকে। তোমার মেয়ে, তোমার বাপের বাড়ি যাবে তো আমাকে এত বলার কি আছে?

রিজু: আমার বাপের বাড়ি, তোমার কেউ নয়?

মিতা: ঝাঁঝালো গলায় বলে, না! আমার কেউ নয়!

রিজু: তুমি এটা বলতে পারলে? আব্বা মা ছোট ভাই বোনেরা তোমাকে কত ভালবাসে। তুমি ভুলে গেলে?

মিতা: ভালোই যদি বাসতো তাহলে আমার অসময়ে তাদের পাশে পেতাম। কোন দিন পেয়েছি বলো তো? আমি কি ভুলে গেছি মনে করছো? তানু হবার পর তোমার মা কী করেছেন! আমি সিজারের রুগি, তোমার মা কয়েকদিন থেকে চলে গেলেন। বলে গেলেন দিন পাঁচেক পর আসছি। আর এলেন না। আমার কষ্ট একটু বুঝেছেন তোমার মা? আমি ঐ অবস্থায় বাড়ির সব কাজ করেছি। কী করে,কত কষ্ট করে করেছি আল্লা জানেন। তোমার মা আসতে চেয়েছিলেন তোমার আব্বা আসতে দেননি। আমার কষ্ট ওরা কোনদিনও বোঝার চেষ্টা করেছে?——- চোখ মুছে মিতা।

রিজু: সত্যিই সেই সময় খুব অন্যায় হয়েছিল তোমার প্রতি। আব্বা অসুস্থ থাকার জন্য মা আসতে পারেন নি। তাছাড়া মা, সেও তো সুস্থ নয়।

মিতা: না তা নয়। আমি সব বুঝি। আমি যদি ঐ বাড়ির মেয়ে হতাম ঠিক আসতেন।

রিজু: তুমিও তো ঐ বাড়ির বড়ো বৌ। তুমি কোনোদিন মায়ের কাজে লেগেছো, না সেই সুযোগ পেয়েছো?

মিতা: রাখোনি কেন ওখানে রাখলেই পারতে?

রিজু:(মজা করেই বলে) ঠিক আছে চলো তোমাকে রেখে আসছি।

মিতা: ভারি তো! আমি ওখানে থাকার জন্য বিয়ে করেছি নাকি?

রিজু: আমি যদি ওখানে থাকতাম?

মিতা: তুমি ওখানে থাকলে আমিও থাকতাম। আমি তো তোমার বাড়ির ঝি গিরি করতে এসেছি।

রিজু: এসব কী বলছো যা তা?

মিতা: ঠিকই বলছি। ঝি নয় তো কী? আমি তো সারাজীবন খেটেই মরলাম। বিয়ের পর আমাকে তুমি কোন জিনিসটা দিয়েছো? তোমার সংসারে থেকে আমার কী লাভ হয়েছে? একটু খাই তাইতো? আমি এমনি খাইনা, কাজ করে খাই।

রিজু: তুমি একথা বলতে পারলে? তোমাকে আমি কিছুই দিইনা?

মিতা: কোন জিনিসটা দিয়েছো দেখাও। ঈদের দিনে সবাই নতুন শাড়ি পরে আনন্দ করে। বিয়ের এতোগুলো বছর পার করলে, তুমি কোনোদিন ভেবেছো তোমার বাড়িতে একটা ঝি আছে, তারও শখ আহ্লাদ আছে? আমার আব্বা দেয়নি বলে আজ পর্যন্ত একটা সোনার গহনা দিতে পেরেছো? তামার চুড়ি হাতে পরে সব জায়গায় যায়, তোমার কি একটুও লজ্জা লাগে না? তুমি তো মাস্টার। অন্য মাস্টারের বৌ গুলোকে দেখেও তো তোমার লজ্জা পাওয়া উচিত। সবার বৌ এর হাতে দামি দামি চুড়ি,গলায় সোনার গহনা থাকে। আমার কী আছে বলো তো? তুমি আমাকে কোনটি দিয়েছো? সারা জীবন তো মা-বাপ-ভাই-বোন করে গেলে? আমি তোমাকে কোনদিন কিচ্ছু বলিনি, কিচ্ছু চাইনি। কিন্তু চাকরি করা স্বামী পেয়ে আমার কী লাভ হয়েছে বলো ? শুধু দুটো পেটে খাবার খাওয়া ছাড়া……….!!!!

রিজু চুপ করে যায়। ঠিকই তো বলেছে মিতা। বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত ওকে কিছু দিতে পারেনি। মরুভূমির বুকে শূন্য থেকে সংসারটা শুরু করেছে সে। অভাব যেন যায়না। মরুভূমিতে একটি গাছ কতটাই বা ফল ফুল দিয়ে সজীব থাকতে পারে? চাকরির শুরু থেকেই ও চেষ্টা করেছে ভাই বোনদের সন্তুষ্ট করতে। বাবা মাকে সন্তুষ্ট করতে। তারা সন্তুষ্ট হয়েছে কিনা তার বাবা মা ভাই বোনেরাই বলতে পারবে। হয়তো পারেনি। ব্যর্থ সে!

মিতা: আমার কথা না হয় ছেড়ে দাও। হাসি বড়ো হয়েছে। খুশিও বড়ো হওয়ার দিকে। আজ পর্যন্ত ওদের জন্য তুমি কিচ্ছু করোনি। এসব কবে করবে?

রিজু: সবে তো ঋণ মুক্ত হয়ে একটু স্বস্থির নিঃশ্বাস নিচ্ছি। তুমি তো জানো, চাকরি,জমি বাড়ি সব কিছুই ঋণ নিয়ে করা। আজ পর্যন্ত কোনো দিক থেকে কারও বিন্দুমাত্র সহযোগিতা পাইনি। মাথা গোঁজার জন্য বাড়িটার খুব দরকার ছিল। সেটা হয়েছে। এবার আস্তে আস্তে বাকি গুলো ঠিক হয়ে যাবে।

মিতা: এবার অন্য চিন্তা বাদ দাও। নিজের ছেলে মেয়েদের চিন্তা করো। তুমি ছাড়া ওদের কে আছে ? যাদের জন্য ভাবো, তুমি চোখ বন্ধ করলে তোমার ছেলে মেয়েদের ওরা কেউ দেখবে ভেবেছো?

রিজু: তুমি খুব স্বার্থপর হয়ে গেছো মিতা। সব সময় নিজের চিন্তা করলে জন্মদাতা পিতা মাতার চিন্তা আর কবে করবো? বাইরে থাকার ফলে তাদের প্রতি আমার কর্তব্য ঠিক মতো পালন করতে পারিনা। পিতা মাতা যাই-ই করুন না কেন সন্তান কখনোই তাদের ঋণ শোধ করতে পারেনা। তারা লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন বলেই তো আজ শহরে একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে। সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে পারছি।

মোয়াজ্জেম মাস্টারের কথা তোমাকে বলেছিলাম মনে আছে? তিনি একটা হাই স্কুলের হেডমাস্টার হয়েও তার সন্তানদের লেখা পড়া শেখাননি। উনার যুক্তি, “এত কষ্ট ক‌‌‌রে ব্যাটাদের লেখাপড়া শেখাবো আর ওরা বড়ো হয়ে বাপ মার থেকে পালিয়ে বৌ নিয়ে মজা লুটবে,বাপ মায়ের অসুখ বিসুখ হলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার কেউ থাকবেনা,মরে যাওয়ার সময় মুখে পানি দেওয়ার কাউকে পাবোনা, তাদের হাতের মাটি পাবো কি পাবোনা তারও ঠিক নেই, তো তাদেরকে পড়ালেখা শিখিয়ে মানুষ করে আমার লাভ কী? ওটা আমি হতে দিইনি। সবগুলোকে চাষা করে রেখেছি। মাঠে খাট্ আর বাপের কাছে থাক্। ভায়ে ভায়ে ঝগড়া ঝামেলা হলেও বাপ মায়ের কিছু হলে ওরাই কাঁধে করে নিয়ে দৌঁড়াবে। আপনাদের মতো ব্যাটাকে লেখাপড়া শিখিয়ে আপনার বাপ মায়ের কী লাভ হয়েছে শুনি? চাকরি পেয়েছেন, বাপ মাকে ফেলে বৌ নিয়ে পালিয়ে এসেছেন। কিছু মনে করবেন না রিজু সাহেব, বাপ মাকে ফেলে পালিয়ে আসা আপনাদের মতো মাস্টার গুলোকে গাছে বেঁধে কাঁচা কঞ্চি দিয়ে পেটানো উচিত।”

একটু থেমে আবার বলে, জানো মিতা, মাস্টার মশাই এর সেই কথাগুলো আমার কানে সব সময় বাঁজে। উনাকে কোনো মতেই যুক্তি দিয়ে বোঝাতে পারিনি, কেন আমাকে দূরে থাকতে হয়।

মিতা: উনি নিজের স্বার্থের জন্য সন্তানদের মূর্খ করে রেখে ঠিক করেন নি। কাছে থাকলেই যে পিতা মাতার সেবা করা যাবে আর দূরে থাকলে করা যাবেনা সেটা ভুল কথা।যে করবে সে কাছে থাকলেও করবে, দূরে থাকলেও করবে। যে করবেনা সে কাছে থাকলেও করবে না। তুমি হাজার করলেও তোমার নাম কোনোদিনও হবে না। তুমি চাকরি পাওয়ার পর থেকে ওদের অনেক কিছুই তো দিলে, মা বাপের হাতে টাকা গুঁজে দেওয়া, তাদের ডাক্তার দেখানো, ঔষধ কিনে দেওয়া কোনটি বাদ দিয়েছো? তবুও কোনদিন ওদের মুখে শুনতে পেয়েছো তুমি ওদের কিছু দাও? তুমি যতোই দাও ওদের চাহিদা কোনদিনই মেটাতে পারবে না।

রিজু কথা বাড়ায় না। শুধু বলে, না নাম করুক,ওদের জন্য আমি কী করেছি তা আল্লাহ দেখছেন। তুমি হাসি খুশিকে নিয়ে অতো চিন্তা করো না। ওদের দুই বোনকে অনেক দূর পড়াবো। ওরা নিজেরাই তো এক একটা খাঁটি সোনা হবে গো! ওদের জন্য ভাবনা কিসের? আল্লাহ ঠিক ম্যানেজ করে দেবেন। আব্বা মায়ের বয়স হয়েছে। ওরা কি সারাজীবন থাকবেন? এখন ওদের দিকেই বেশি নজর দিতে হবে।

মিতা ঝাঁঝিয়ে ওঠে। বলে, “দ্যাখো গানা তোমার বাপ মাকে। কেউ মানা করেছে নাকি?”

এসব ঝামেলা হাসি খুশির একদম পছন্দ নয়। ওরা মিতাকে সান্ত্বনা দেয়। রিজুকে চুপ করতে বলে। তারপর তানুর সাথে খেলায় মেতে ওঠে। তানু একটু বড়ো হয়েছে। তানু ওদের ছোট ভাই। ও সবসময় রিজুর একটা কালো গগলস পরে বাটুল নিয়ে শিকারির ঢঙ্গে গোটা ছাদময় পায়চারি করে বেড়ায়। ওর খেলার সাথী বলতে হাসি খুশি আর তার বাবা মা।

মিতা একটু স্বাভাবিক হলে কয়েকদিন পরে রিজু হাসিকে দুদিনের জন্য দাদির বাড়ি পাঠায়।

শহুরে মেয়ে হলেও হাসি সবার থেকে আলাদা। কোনো অহঙ্কার নেই। সরলতায় ভরা তার মন। সদ্য ষোলোতে পা দিয়েছে। এই সময়ে তাদের হিতাহিত জ্ঞান কম থাকে। আবেগ প্রবণ হয়। এটাই বয়সের ধর্ম। সিফা পিসির সঙ্গে হাসি ওর মৌরিয়া পিসির বাড়ি বেড়াতে যায়।পিসিরা ওর বন্ধুর মতো। রিজু ভেবেছে, পিসির বাড়ি যাবে সেখানে আপত্তির কীইবা থাকতে পারে। ওরা নিশ্চয়ই ওদের ভাইঝিকে খারাপ পথে নিয়ে যাবে না। তবুও মৌরিয়ার বাড়িতে হাসিকে পাঠানোর জন্য মিতা রিজুর উপর রাগ করে।

হাসিকে পেয়ে মৌরিয়া খুব খুশি হয়। মাংস ভাত হাসির খুব প্রিয়। পোল্ট্রি মুরগির মাংস ভাত দিয়ে হাসির মন জয় করে মৌরিয়া। সে এই দিনেরই অপেক্ষায় ছিলো এতদিন। হাসিকে পেয়ে গোপনে ভয়ঙ্কর স্বপ্নের জাল বোনে সে। তার বাড়ির বৌ করার ষড়যন্ত্র শুরু হয়। রিজু যাদের প্রাণাধিক ভালবাসে,বিশ্বাস করে তাদের মধ্যে অনেকেই এই ষড়যন্ত্রে সামিল হয়। তারা মৌরিয়াকে সাহস যোগায়। শুরু হয় নোংরা খেলা। এই খেলায় রিজু একা পড়ে যায়। বাকি খেলোয়াড়রা রিজুর সম্মান নষ্ট করে হৃৎপিণ্ড উপড়ে ফেলতে মহানন্দে গোপনে মাঠে নামে। রিজু কিছুই জানতে পারে না। হাসি বাড়ি ফিরে পড়াশোনায় মন দেয়। বেশ কিছুদিন পর মৌরিয়া হাসিকে ফোন করে।

মৌরিয়া: হ্যালো, হাসি?

হাসি: হ্যাঁ, পিসিমা বলো। কেমন আছো?

মৌরিয়া: তুমি সেই কবে বেড়াতে এসেছিলে, দুদিন থেকে চলে গেলে আর খোঁজ নিলে না। তোমার জন্য আমার খুব মন খারাপ করছে গো আম্মু। তুমি আবার কবে আসবে?

হাসি: আমার তো যেতে ইচ্ছে করে।কিন্তু পাপা এখন যেতে দেবেন না।

মৌরিয়া: তুমি তো এখন বড়ো হয়েছো। সবসময় পাপার অনুমতি নিলে হবে? পরীক্ষা তো হয়ে গেছে তুমি চলে এসো।

হাসি: একা কী করে যাবো অতদূর?

মৌরিয়া: তুমি চিন্তা করো না। আমি সব ব্যবস্থা করবো। শুধু তুমি রাজি হলেই হবে। ভুলেও তোমার পাপাকে বলবেনা। পরে আমি ভাইকে বলে সব ঠিক করে নেবো। তুমি তো জানো তোমার পাপা আমাকে কতটা ভালোবাসেন।

প্ন্যান হয় ভাইঝি এবং পিসিতে। রিজু ঘুণাক্ষরেও টের পায়না।মৌরিয়ার কথায় ভরসা করে হাসি বেরিয়ে পড়ে ওর পিসিমার বাড়ির উদ্দেশ্যে। তার যে অন্য মতলব রয়েছে তা হাসি টের পায়না। সেটা বোঝার ক্ষমতা ওর ছিল না।

বিকালে বাড়ি না ফেরায় হাসির খোঁজ পড়ে। পাগলের মত ছুটে বেড়ায় রিজু। একে একে সব জায়গা থেকে হতাশ হয়। মৌরিয়াকে ফোন করে। মিতা কান্না করতে করতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। খুশি মায়ের চোখে মুখে জলের ঝাপটা দেয়। এদিকে রিজুর মাথাটা বনবন করে ঘুরতে থাকে। কাওকে কিছু বলতে পারে না।গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। বাড়ির মেয়ে পাওয়া যাচ্ছে না এটা জানাজানি হলে রিজুর সম্মান বলে কিছুই থাকবেনা। কিন্তু তবুও খোঁজাখুঁজির বৃথা চেষ্টা করে। যুগ জামানা ভালো নয়। একটা আতঙ্ক গ্রাস করে রিজুকে। সন্ধ্যে বেলায় থানায় একটা মিসিং ডায়েরি করে আসে।

রিজু আবিরকে ঘটনাটি জানায়।ইদানিং মৌরিয়াকে কেমন যেন রিজুর সন্দেহ হয়। আবির ও মাহি ছুটে যায় মৌরিয়ার বাড়ি। কিছুক্ষণ পর ওরা জানায় মৌরিয়ার চক্রান্তের কথা। রিজুর কাছে সব পরিষ্কার হয়। এতো বড় গাদ্দার ও! বড়ো ভাইয়ের সঙ্গে প্রতারণা! না, না!এর ক্ষমা নেই! ওকে এতো ভালোবাসার মূল্য মৌরিয়া এভাবে দিচ্ছে? রিজু চারদিকে অন্ধকার দেখে। আর ভাবতে পারে না। দুই ভাইকে ওখানে থাকতে বলে রিজু মিতার বাবাকে ফোন করে ডেকে নেয়। কান্না করতে করতে মিজানুর সাহেবকে ফোন করে সব জানায়।বলে,

“আব্বা আপনি তৈরি হোন মৌরিয়ার বাড়ি যেতে হবে।”

রিজুর বাবা যেতে রাজি হোন না। এই কথা শুনে মিতার বাবা বলেন,
“বেয়াই মশাই আপনি বলছেন কী? আপনার নাতনিকে আপনার মেয়ে লুকিয়ে রেখেছে আর আপনি বলছেন যাবেন না?”

অসময়ে রিজুর বাবার এই আচরণ রিজুর ভালো লাগেনি। তাকে এক প্রকার জোর করেই গাড়িতে তুলে নিয়ে রিজু মৌরিয়ার বাড়ি পৌঁছায়।

মৌরিয়ার বাড়িতে তখন গোটা গ্রামের লোক ভেঙে পড়েছে। রিজুর মুখে আজ চুনকালি মাখিয়ে দিয়েছে তার আদরের ছোট বোন। রিজু কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবেনি তার ছোট বোনটি কবে কবে তার শত্রু হয়ে গেছে।

“বড়ো ভাই ভালো থাকবেন, শহরে থাকবেন আর তার বোন ধুঁকে ধুঁকে গ্রামেই পড়ে থাকবে?” ভাইয়ের প্রতি এই হিংসা তাকে এতো নিচে নামিয়ে দিয়েছে। ও ভেবেছে এই ভাবেই ভাইকে জব্দ করে তার কাছ থেকে অনেক কিছু আদায় করা যাবে। ছিঃ! ছিঃ! ! ছিঃ!!! ভাবতেও লজ্জা লাগে রিজুর। আনন্দ পেতে মৌরিয়ার বাড়িতে গোটা গ্রামের লোক ভেঙে পড়ে। নানা জনে ফিসফিস করে কী সব বলাবলি করে। মাথা উঁচু করে থাকা রিজুর মাথা আজ ওদের সামনে নিচু হয়ে যায়। মৌরিয়ার হাতটি ধরে রিজু কাঁদে। রিজুর কান্নায় মৌরিয়ার হৃদয় গলে না। সমস্ত লজ্জা ত্যাগ করে মৌরিয়ার পা জড়িয়ে ধরে বলে,

“বোনটি আমার! আমার মেয়েটিকে তুমি ফিরিয়ে দাও মৌরিয়া! ওকে তুমি কোথায় লুকিয়ে রেখেছো বলো। আমার সম্মান ধূলোয় মিশে গেল যে! তুমি আমার সম্মান ফিরিয়ে দাও! হাসি যে আমার হৃদয় গো! ওকে না দেখতে পেলে আমি থাকতে পারিনা। ওকে আমি ভিক্ষা চাইছি তোমার কাছে! তুমি যা বলবে আমি তাই করবো! শুধু আমার কলিজার টুকরোকে ফিরিয়ে দাও। না হলে আমি বাঁচবো না গো!”

মৌরিয়ার পায়ের তলায় পড়ে হাও হাও করে কাঁদে রিজু। তাকে এই ভাবে কাঁদতে কেউ কোনদিন দেখেনি। তার হৃদয় বিদারক কান্নার আওয়াজ স্বপ্নবিলাসী ষড়যন্ত্রের মায়াজালে আটকে পড়া মৌরিয়ার কর্ণকুহরে প্রবেশ করেনা।

মৌরিয়ার জবাব, “আপনি আগে সমস্ত লোকের সামনে কথা দিন, আমার ছেলের সঙ্গে হাসির বিয়ে দেবেন। তবেই আমি বলবো ওরা কোথায় আছে।”

মৌরিয়ার স্পর্ধা দেখে রিজুর মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। তার মনে হয়, এক্ষুনি এই রাক্ষুসীকে গলা টিপে মেরে ফেলে। সম্পদের লোভে সে এতটা নিচে নেমে যাবে রিজু ভাবতেও পারেনা। ক্ষণিক সংযত হয়ে অনেক অনুনয় বিনয় করে। লাভ হয়না। তাকে খালি হাতে ফিরতে হয়। বাবা চিৎকার করে বলেন, “তোমার বড়ো ভাই তোমার হাতে পায়ে ধরলো তবুও তুমি মেয়েটাকে ফিরিয়ে দিলে না,ও কোথায় আছে জানালেনা? আফসোস! আজ থেকে আমি জানবো আমার মেয়ে মরে গেছে। মৌরিয়া নামে আমার আর কোনো মেয়ে নেই, ছিল না!”

পাশে থেকে মৌরিয়ার শাশুড়ি ফোড়ন কাটে, “মোলবি লিজের মেঈর এই বাড়িতে বিহা দিতে প্যারিছে,তখন লজ্জা লাগেনি আর এখন লাতনির বিহা দিতে প্যাইরবেনা?”

কথা শুনে রিজুর মনে হলো, মাটি ফেটে গেলে ও ঢুকে পড়ে। সকলের সামনে ছোটো বোনের কাছে অসম্মানিত হয়ে ওর বাঁচতে ইচ্ছে করে না। রিজুর রাগ তার বাবার উপর গিয়ে পড়ে। সবই বাবার রুচিবোধের অভাবের ফল। একজন শিক্ষকের রুচিবোধ বাবার রুচিবোধের সাথে মেলে না। এই নিম্নমানের বাড়িতে মৌরিয়ার বিনা পণে বিয়ে দিয়ে তিনি শিক্ষকের সম্মানটাই নষ্ট করেছেন। না হলে মৌরিয়ার শাশুড়ি আজ একথা বলতে পারতো না। চোখ মুছতে মুছতে রিজু বেরিয়ে আসে। বহরমপুর এসে থানায় ওদের নামে এফ আই আর করে।

Related Articles

Back to top button
error: