HighlightNewsআন্তর্জাতিক

হাসপাতালে ইসরাইলি হামলায় ৮০০ ফিলিস্তিনির মৃত্যুতে বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদের ঝড়, ‘এসব অপরাধ চলতে থাকলে কেউ মুসলিমদের থামাতে পারবে না’ হুঁশিয়ারি খামেনেয়ীর 

টিডিএন বাংলা ডেস্ক: ফিলিস্তিনের গাজার একটি হাসপাতালে ইসরাইলি বিমান বাহিনীর বর্বরোচিত হামলায় কমপক্ষে ৮০০ ফিলিস্তিনির মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছে ব্যাপক প্রতিবাদের ঝড়। সারা বিশ্বের বিভিন্ন শহরে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহমর্মিতা জানাতে এবং ইসরাইলি হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করার দাবিতে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। ইরান, ইরাক, জর্ডান, লেবানন, মিশর, সিরিয়া, তুরস্কের মতো দেশগুলিতে যেমন প্রতিবাদ বিক্ষোভ চলছে। একই ভাবে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, কানাডার মতো দেশগুলিতেও ইসরাইলি বাহিনীর নৃশংস হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিক্ষোভ শুরু হয়েছে।

ফিলিস্তিনি হাসপাতালে ইসরাইল বাহিনী হামলা চালানোর পর ‘ইসরাইলের এসব অপরাধ চলতে থাকলে কেউ মুসলিমদের থামাতে পারবে না’ বলে ইসরাইল সরকার ও পশ্চিমা বিশ্বকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী। ইরানের বিদেশমন্ত্রক স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে ইসরাইলকে দেওয়া সময়সীমা শেষ হয়ে গিয়েছে। এবার যে কোনো পরিণতির জন্য তৈরি থাকতে হবে ইসরাইল ও তাদের দোসরদের। লেবাননের প্রতিরোধ সংগঠন হিজবুল্লাহ হুমকি দিয়েছে তারা ইসরাইলের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের জন্য সর্বাত্মক ভাবে প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। সঠিক সময় আসলেই তারা সরাসরি সম্মুখ সমরে নামার হুঁশিয়ারি দিয়েছে। এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য বেশ কিছু সংগঠনও এই ধরনের মনোভাব পোষণ করেছে।

 

অর্থাৎ বলা যায় ইসরাইলি বাহিনীর এই কাপুরুষোচিত হামলার পরপরই রাতারাতি পাল্টাতে শুরু করেছে মধ্যপ্রাচ্যের চিত্র। এতদিন পর্যন্ত যে সমস্ত মুসলিম দেশ ফিলিস্তিনে ইসরাইলের বর্বোরোচিত হামলার পরেও নরমপন্থি মনোভাব দেখাচ্ছিলেন। এই সংঘাত যুদ্ধের পরিবর্তে আপোষে মিমাংসা করার প্রচেষ্টা করছিলেন তারা এই হামলায় একেবারে হতভম্ব এবং প্রচন্ড ক্ষুদ্ধ। দেশ তথা বিশ্বের মুসলিম জনমতের চাপে এবার তারাও কঠোর অবস্থান নিতে বাধ্য হবে বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

এদিকে ইসরায়েলের উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। মিত্র ইসরায়েলের প্রতি সমর্থনের অংশ হিসেবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও শীর্ষ প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের পর এবার তেল আবিব সফরে আসছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ইসরায়েল সফর শেষ করে জর্ডানের রাজধানী আম্মানে যাওয়ার কথা ছিল বাইডেনের। সেখানে জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ, মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি ও ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে বৈঠকের কথা ছিল তাঁর। কিন্তু ইসরাইলের এই বর্বরোচিত হামলার প্রতিবাদে বাইডেনের সঙ্গে নির্ধারিত এ সম্মেলন বাতিল ঘোষণা করেছে দেশগুলো। বাইডেনের সঙ্গে সম্মেলন বাতিলের ঘোষণায় জর্ডানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আয়মান সাফাদি বলেন, ‘যুদ্ধ বন্ধ করা ছাড়া এখন আর আলোচনা করে কোনো লাভ নেই।’

বিবিসি সংবাদদাতারা জানাচ্ছেন পশ্চিম তীরের বেশ কয়েকটি শহরে রাতেই ফিলিস্তিনিরা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেন। বিভিন্ন জায়গায় তারা পাথর ছুঁড়তে থাকেন নিরাপত্তা বাহিনীকে লক্ষ্য করে।সেখানে প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়া হয়। একপর্যায়ে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নিরাপত্তা বাহিনী কাঁদানে গ্যাস ও স্টান গ্রেনেড নিক্ষেপ করে।

অন্যদিকে মুসলিম দেশ গুলোতে অবস্থিত ইসরাইলের দোসর হিসেবে পরিচিত পশ্চিমাদের দূতাবাসগুলিও জনরোষের মুখে পড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। এমনকি বেশ কিছু মুসলিম দেশের প্রতিরোধ সংগঠনগুলো আমেরিকাকে হুমকি দিয়েছে তারা যদি ইসরাইলের পক্ষে অবস্থান নেয় তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের সমস্ত অবস্থান গুলিকে লক্ষবস্ত বানাবে তারা। ইতিমধ্যেই লেবাননের রাজধানী বেইরুতে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসের সামনে ক্ষুব্ধ বিক্ষোভকারীরা জড়ো হয়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছে। এছাড়া ফরাসি দূতাবাসের বাইরে আরেকটি দল জড়ো হয় এবং ভবনটি লক্ষ্য করে পাথর ছোঁড়ে বলে জানা গেছে। এর বাইরে ত্রিপোলি এবং লিবিয়ার অন্যান্য শহরেও শত শত মানুষ ফিলিস্তিনি পতাকা বহন করে এবং গাজাবাসীদের সমর্থনে স্লোগান দেয়।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী ইসরাইলকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, “এসব অপরাধ চলতে থাকলে মুসলিম ও প্রতিরোধ বাহিনী অধৈর্য হয়ে পড়বে। কেউ মুসলিমদের থামাতে পারবে না। ইহুদিবাদী সরকার যাই করুক না কেন, তারা যে কলঙ্কজনক ব্যর্থতার সম্মুখীন হয়েছে, তা পুষিয়ে নিতে পারবে না।”

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, গাজায় হাসপাতালে হামলা চালিয়ে শত শত বেসামরিক নাগরিককে হত্যার ঘটনায় তিনি ‘হতভম্ব’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রধান তেদরোস আধানম গেব্রেয়াসুসের কথায়, “‘ডব্লিউএইচও এ হামলার কঠোর নিন্দা জানাচ্ছে। অবিলম্বে বেসামরিক নাগরিক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার আহ্বান জানাচ্ছি। স্থানীয়দের এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তা–ও প্রত্যাহারের আহ্বান জানাচ্ছি।” গাজার হাসপাতালের হামলার নিন্দা জানিয়েছে আরব লীগও। সংস্থাটির প্রধান আহমেদ ঘেতি বলেছেন, বিশ্ব নেতাদের অবিলম্বে এই ‘ট্রাজেডি’ বন্ধ করতে হবে।

২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ইসরাইল গাজার প্রতিরোধকামী সংগঠন হামাস ও ইসলামি জিহাদ আন্দোলনের বিরুদ্ধে পাঁচটি যুদ্ধ করেছে কিন্তু এর আগে একটি হামলায় একসাথে এত বেশি মানুষ মারা যায়নি। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, বিস্ফোরণের পর হাসপাতালের বহুতল ভবনটি জ্বলছে। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মরদেহ। ধ্বংসস্তূপ থেকে ভেসে আসছে আহত ব্যক্তিদের আর্তচিৎকার। মৃত্যুর হার যে ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে ধ্বংস্তুপের নিচে আরও বহু মানুষের মৃত্যু হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল বলেন, “আমরা এর আগে অনেক যুদ্ধ দেখেছি কিন্তু কোনদিন এমন হামলা হয়নি। এবার ইসরাইল যে হামলা চালালো তা নজিরবিহীন। এটি নিতান্তই গণহত্যা।”

এই আক্রমণে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি পাশ্চাত্যের যে সমস্ত দেশ ইসরাইলের বন্ধু হিসেবে পরিচিত তারাও গাজায় হাসপাতালে হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ একে ‘গণহত্যা’ অভিহিত করে বলেন, এই পরিস্থিতিতে কেউ চুপ থাকতে পারে না। এভাবে সাধারণ মানুষকে হত্যা ‘মানবতার জন্য লজ্জাজনক’। হাসপাতালে ইসরায়েলি বাহিনীর বোমা হামলায় শত শত মানুষের মৃত্যুকে ‘জঘন্য অপরাধ’ অভিহিত করে তীব্র নিন্দা জানিয়েছে সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

ইসরায়েলি বাহিনীর হাসপাতালে বোমা হামলার ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে কাতার। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রলায় বলেছে, ইসরায়েল যেভাবে গাজার হাসপাতাল, স্কুল ও জনবহুল এলাকায় হামলা করছে এতে সংঘাত ভয়ংকর ভাবে বিস্তৃত হচ্ছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়ের এরদোয়ান বলেছেন, ইসরায়েল যে ন্যুনতম মানবিক মূল্যবোধেরও তোয়াক্কা করছে না গাজায় হাসপাতালে হামলা তার সর্বশেষ উদাহরণ। গাজায় ‘নজিরবিহীন নৃশংসতা’ বন্ধে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘ইসরায়েলি বাহিনী নির্বিচার বিমান হামলা চালিয়ে গাজার নিরস্ত্র ও অসহায় মানুষদের হত্যা করছে। জঘন্য এই অপরাধের মাধ্যমে ইহুদী এই রাষ্ট্রটি আরও একবার বিশ্বের সামনে তাদের অমানবিক ও পাশবিকাতেই তুলে ধরেছে।’

ইসরায়েলি হামলার নিন্দা জানিয়েছে বর্তমানে মুসলিম বিশ্বের মধ্যে ইসরাইলের সবচেয়ে বন্ধুভাবাপন্ন দেশ মিসরও। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, গাজার বেসামরিক নাগরিকদের ওপর এভাবে নির্বিচার হামলা ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের চরম লঙ্ঘন’। মিসরের প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ আল–সিসি বিবৃতি দিয়ে হাসপাতালে হামলার নিন্দা জানিয়েছেন। বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, ‘ইসরায়েলের এই হামলার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।’ সিরিয়ার প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ও এই হামলাকে ‘মানবতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে নৃশংস, জঘন্য, রক্তক্ষয়ী গণহত্যাগুলোর একটি’ অভিহিত করে এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছে।

গাজায় হাসপাতালে হামলার ঘটনাকে ‘ভয়ংকর’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। তিনি বলেন, এটা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। এসব ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি সম্মান জানানো উচিত। যুদ্ধের কিছু নিয়মনীতি আছে। কোনো হাসপাতালে এভাবে হামলা করার ঘটনা কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। রাশিয়া অবিলম্বে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকার আহ্বান জানিয়েছে। গাজার হাসপাতালে প্রাণঘাতী হামলার ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে ফ্রান্সও। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, মানবাধিক বিষয়ক আন্তর্জাতিক আইন সবার জন্য প্রযোজ্য। বেসামরিক মানুষের নিরাপত্তা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।

এদিকে এই হামলার পর হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া বলেছেন, ‘শত্রুরা (ইসরায়েল ও দেশটির মিত্ররা) যে কতটা পাশবিক হাসপাতালে চালানো এই গণহত্যা তারই প্রমাণ।’ ইসরায়েলের দখলদারদের বিরুদ্ধে লড়তে সব ফিলিস্তিনিকে রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানিয়েছেন হামাস প্রধান। এদিকে হামাসের মুখপাত্র ওসামা হামদান বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ‘সবুজ সংকেত’ পাওয়া ছাড়া ইসরায়েলের পক্ষে এই হামলা চালানো সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ‘সবারই বোঝার কথা মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেন গতকাল ইসরায়েলের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার সঙ্গে পাঁচ ঘণ্টার বেশি বৈঠক করেন। এদিকে জো বাইডেনও আজ ইসরায়েল সফরে আসছেন।’ সূত্র – প্রথম আলো, পার্সটুডে, আল জাজিরা, বিবিসি ও রয়টার্স

Related Articles

Back to top button
error: