HighlightNewsইতিহাস ঐতিহ্যদেশ

স্বাধীনতা সংগ্রামে জীবন দিয়েও ইতিহাসে স্থান না পাওয়া বাংলার সশস্ত্র বিপ্লবীদের কাহিনী

আব্দুর সালাম,টিডিএন বাংলাঃ আগামী কাল ১৫ ই আগষ্ট ভারত জুড়ে পালিত হবে ভারতের স্বাধীনতা দিবস। কিন্তু যাদের রক্তে রঞ্জিত হয়ে আজ আমাদের স্বাধীনতা এসেছে। যারা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে দেশকে স্বাধীন করেছে। এমন অনেক বিখ্যাত শহীদদের কথা আজ আমরা ভুলে গিয়েছি বা ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। এমনই কয়েকজন সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নিয়ে এই লেখা।

স্বাধীনতা আন্দোলনের শেষ লগ্নে এসে বাংলা তথা ভারতে গড়ে ওঠে বেশ কিছু গুপ্ত সশস্ত্র সংগঠন।যারা সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে দেশকে স্বাধীন করার পক্ষপাতী ছিলেন। যদিও তাদের মধ্যে অনেকেই নৈতিকতা ভুলে নিরপরাধ বিদেশীদেরকে হত্যা করেছিল। তাই অনেকে গুপ্ত সংগঠনগুলিকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলে আখ্যা দিয়েছেন। আজকের এই লেখা সেই বিতর্ক নিয়ে নয়। বরং স্মৃতির অন্তরালে চলে যাওয়া কয়েকজন বিখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামীকে নিয়ে যাদের নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে।

১) সেই সময়ের কয়েকটি গুপ্ত সংগঠন হল অনুশীলন, যুগান্তর যাদের কথা আমরা পাঠ্য বইতে পড়েছি। যেখানে মুসলমানদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু এদেরই সমকক্ষ সংগঠন ‘ইনকিলাব পার্টির’ কথা আমরা ভুলে গিয়েছি। আমাদের পাঠ্য বই তো দূরের কথা অন্যান্য ইতিহাস বই গুলিতেও তাদের ঠাই হয়নি। ইনকিলাব পার্টির নেতা ছিলেন পালোয়ান শিশু খান। পালোয়ান শিশু খান ইংরেজ বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে শাহাদাত বরন করেন। আজ এই শহীদ শিশু খান ইতিহাসে কোথাও ঠাঁই পেলনা!

২) মাওলানা আজাদ দেশি বিদেশী বিভিন্ন গুপ্ত ও বিপ্লবী সমিতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অবশেষে কলকাতায় এসে ‘হাবিবুল্লাহ’ নামে একটি বিপ্লবী সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমান বাংলাদেশ ও বাংলার বাইরের বহু স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং বুদ্ধিজীবী এই সমিতিতে যোগ দিয়ে ছিলেন। কিন্তু আমরা এ সমিতির নাম পর্যন্ত জানি না ।

৩)ক্ষুদিরাম বসুর নাম জানেনা এমন মানুষ পাওয়া মুশকিল। আমরা সবাই জানি তিনি অত্যাচারি কিংসফোর্ডকে হত্যা করে তার অত্যাচারের হাত থেকে আমাদের মুক্তি দিতে এবং অত্যাচারিদের হুঁশিয়ারি দিতে চেয়ে ছিলেন। যদিও দূর্ভাগ্য বসত তিনি কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে ব্যর্থ হন। সবাই ক্ষুদিরামকে সম্মানের সঙ্গে মনে রেখেছে। অথচ সেই অত্যাচারি কিংসফোর্ডকে হত্যাকারী সফল বিপ্লবী শের আলীকে আমরা কেউ চিনিনা। এই শের আলির বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের জন্য ১৪ বছরের জেল হয়। শের আলীকে বিপদজনক বন্দি হিসাবে আন্দামানে জেলে পাঠানো হয়।এই জেলে মূলত বিপদজনক, দুর্ধর্ষ ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামীদের বন্দি করে রাখা হতো। তিনি তখনও জেলের একজন বন্দি। কিন্তু তার মনে স্বাধীনতার আগুন জ্বলছে। আর এই আগুনকে নেভাতে পারেনি বন্দি শিবিরের চার দেওয়াল ও নির্মম অত্যাচার।

এমন সময় ১৮৭২ সালে কুখ্যাত লর্ড মেয়ো আন্দামান সেলুলার জেল পরিদর্শনে আসেন। শের আলী সুযোগ বুঝে রক্ষীদের পরাস্ত করে তাঁর উপরে চাকু হাতে ঝাপিয়ে পড়েন। লর্ড মেয়ো আন্দামান জেলেই শের আলীর চাকুর আঘাতে মৃত্যু বরণ করেন। শের আলীর দ্বিতীয়বার বিচার আরম্ভ হয়। বিচারে ফাসির রায় হয়। শের আলী বীর শহীদের মত হাসতে হাসতে ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলে পড়েন। কিন্তু অত্যন্ত আশ্চর্যজনক হল সেই শের আলীর নাম ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের পাতা থেকে ঝেরে ফেলা হল।

কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি নরম্যান যিনি অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামীকে নিষ্ঠুরভাবে প্রহসনমুলক বিচারে ফাসির আদেশ দিয়েছিলেন তাঁ অত্যাচারে জনগণ অতিষ্ট হয়ে ওঠে। ১৭৭১ সালের ২০ শে সেপ্টেম্বর মহম্মদ আব্দুল্লাহ তাঁকে একাই কোর্টের সিড়িতে অসম সাহসে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করেন। কিংসফোর্ডকে হত্যায় বিফল হওয়া ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকির নাম যদি ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকে তাহলে মহম্মদ আব্দুল্লাহ ইতিহাসে স্থান পেলনা কেন?

৫)সময়টা ছিল ১৯২৫ সাল তখন আবেদন- নিবেদন নীতিমালা ছেড়ে একটি বৃহৎ শ্রেণীর নেতৃত্বে ইংরেজদের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে সশস্ত্র আন্দোলন। এই সশস্ত্র আন্দোলন পরিচালনার জন্য বিপ্লবীদের প্রয়োজন ছিল প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও টাকা পয়সা। ১৯২৫ সালের ৯ মার্চ স্টেশন মাষ্টার মারফত খবর আসে সুজাপুর থেকে লখনৌ গার্ড ভ্যানে টাকার বস্তা নিয়ে যাচ্ছে। এই খবর পেয়ে শহীদ আসফাকুল্লাহ ও তার সঙ্গিরা বেরিয়ে পড়েন অভিযানে। তিনি ও তাঁর সঙ্গী সাথীরা অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে অভিযান পরিচালনা করে সেই টাকা বোঝাই বস্তা ছিনিয়ে আনেন। কাকরি নামক একটি গ্রামের কাছে ঘটনাটি ঘটে। ইংরেজ সরকার তাদের বিরুদ্ধে ‘কাকরি ডাকাতি’ নামে মামলা করে। ইংরেজদের প্রহসনমূলক বিচারে সরকার বিরোধী আন্দোলনের জন্য তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। অবশেষে ১৯২৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর এই বিখ্যাত সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধার ফাঁসি হয়। হাসতে হাসতে তিনি মৃত্যুকে বরন করে নেন। কিন্তু অত্যন্ত দূর্ভাগ্য জনক হলেও সত্য এই শহীদ স্বাধীনতা সংগ্রামীর শুধু নাম টুকুই আমরা জানি তার মহান কীর্তি সম্পর্কে কোনো উচ্চবাচ্য নেই। অবশ্য আসফাকউল্লা খুব ভাগ্যবান যে তার নাম টুকে অন্তত থেকে গেছে ইতিহাসে।

৬) মীর নিসার আলী যার নাম বিকৃত করে ইতিহাসে তিতুমীর আখ্যায়ীত করা হয়েছে। তখন গোটা বাংলা তথা দেশ জুড়ে চলছে ব্রিটিশদের অত্যাচার নিষ্পেষণের পালা। ব্রিটিশদের দোসর জমিদার সম্প্রদায়ের অত্যাচারে তখন গ্রাম বাংলার সাধারণ তাঁতি, জোলা, কৃষক সম্প্রদায়ের প্রাণ ওষ্ঠাগত। এমনই সময় অসহায় মানুষদের ত্রাতা হয়ে আবির্ভূত হন মীর নিসার আলী। তিনি অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে একান্ত অনুগত কর্মীদের নিয়ে রুখে দাঁড়ান জমিদারদের নির্মম অত্যাচারের বিরুদ্ধে। তার সুদৃঢ় মোনোভাব ও অসম সাহসীকতার কারনে তার দলে ভিরতে থাকে গ্রাম বাংলার সাধারন প্রজারা। তিনি বারাসাত ও তৎসংলগ্ন এলাকার মানুষদেরকে জমিদারদের অত্যাচার থেকে রক্ষা করেন। কিন্তু তাঁর এই সাফল্যে অচিরেই তার পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাঁর ক্ষমতা বৃদ্ধিতে শঙ্কিত হয়ে জমিদারগণ ব্রিটিশদের সাহায্যে তাঁর বাঁশের কেল্লা আক্রমণ করে। কয়েকবার ব্রিটিশরা ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেলেও অবশেষে ব্রিটিশ বাহিনীর আধুনিক অস্ত্র ও গোলাবারুদের কাছে পরাজিত হন বাংলার বিখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী মীর নিসার আলী। ব্রিটিশরা তার বাঁশের কেল্লা সহ তাকে ধ্বংস করে দেয়। তাঁর সেনাপতি গোলাম মাসুম গ্রেফতার হন ইংরেজদের কাছে। গোলাম মাসুমকে ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাঁশেরকেল্লার সামনেই ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। মীর নিসার আলী অন্যান্য সহযোগীদেরও ভাগ্যে জোটে হত্যা ও জেল। কিন্তু আজ আমরা দেখছি এই অসম সাহসী মীর নিসার আলীকে ইতিহাসে একজন আখ্যাত গোঁড়া সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় নেতা হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।

তথ্য সূত্র-

১) ইতিহাসের ইতিহাস – গোলাম মোর্তজা

২) বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস- আব্বাস আলি
খান

৩) ভারতের মুসলমান ও স্বাধীনতা আন্দোলন-
মোহাম্মদ ইনাম-উল-হক

Related Articles

Back to top button
error: