Highlightপাঠকের কলমে

পড়ুয়াদের বিদ্যালয়মুখী করতে স্কুল ফিরুক আগের নিয়মেই

সালমা সুলতানা, টিডিএন বাংলা: দীর্ঘদিন পর স্কুলে যেতে পারার অভিজ্ঞতার কথা জানতে চেয়েছিলাম আমার স্টুডেন্টদের কাছে। হইহই করে উঠল সারা টিউশন ব্যাচ- সকাল সাড়ে ন’টায় ঢুকতে হবে। একটানা পরপর সাতটা ক্লাস। খিদে পেলেও টিফিনে বাইরে বেরিয়ে দুটো ঝালমুড়ি কেনারও হুকুম নেই। সেই সাড়ে চারটায় ছুটি। বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা। যেন আমরা কোন এক জেল খানার কয়েদি! আপনিই বলুন ম্যাডাম! স্কুলের যে নতুন নিয়ম এভাবে কি স্কুলে যেতে মন চায় নাকি কি পড়ায় মন বসে! ছাত্রছাত্রীদের এই তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা শুনেই আমার এই পত্র।

করোনা অতিমারীর কারণে দীর্ঘ কুড়ি মাস বন্ধ থাকার পর গত ১৬ই নভেম্বর থেকে রাজ্যের স্কুল ও মাদ্রাসা গুলিতে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর পঠন-পাঠন শুরুর সরকারি সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই। অনেকদিন পর বিদ্যালয়ে আসতে পেরে পড়ুয়াদের পাশাপাশি উচ্ছ্বসিত শিক্ষক-শিক্ষিকারাও। খুশি অভিভাবকরাও। নতুন নির্দেশিকায় শিক্ষক ও পড়ুয়াদের সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যে বিদ্যালয়ে পৌঁছে বিকেল সাড়ে ৪টে পর্যন্ত ক্লাস করার কথা বলা হয়েছে। যা নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একাংশের মধ্যেও। আর যেভাবে সময়সীমা বৃদ্ধি করা হয়েছে তা বিজ্ঞানসম্মত নয় বলে মনে করি।

কেননা, অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকাকে ট্রেন বাস পাড়ি দিয়ে শীতের সকালে সাড়ে ৯টায় স্কুলে পৌঁছানো বেশ কষ্টকর-সেকথা না হয় ছেড়েই দিলাম। কিন্তু অনেক অভিভাবকদেরও অসুবিধা হচ্ছে। এই স্বল্প সময়ে গৃহস্থালির কাজ সেরে সন্তানদের তৈরি করে স্কুলে পাঠানো। তবে এতে ছাত্র-শিক্ষক সকলেরই যে অসুবিধা হচ্ছে তা বোঝাই যাচ্ছে। তাছাড়া এত দীর্ঘ সময় ছাত্র-ছাত্রীদের বিদ্যালয়ে থাকা বেশ অসুবিধাজনক। প্রত্যন্ত গ্রামের দরিদ্র পরিবারের ছাত্র-ছাত্রীরা টিফিন আনা তো দুরের কথা, অনেক সময়ই ঠিকমতো বাড়ি থেকে খেয়েও আসতে পারছে না। এদিকে বিদ্যালয়েও মিলছে না মিড-ডে-মিল। আবার বিধিনিষেধের কারণে মাঝে টিফিন আওয়ারও নেই যে খেলাধুলা করবে। আবার বাইরেও বেরুতে পারছে না। ফলে একটা দীর্ঘ সময় অভুক্ত থাকতে হচ্ছে পড়ুয়াদের। আর সারাক্ষন মাস্ক পরে খালি পেটে টানা সাতটা ক্লাস মানে কতটা কষ্টকর একবার ভেবে দেখুন তো! আর এতে পড়ুয়াদের মন মেজাজ স্বাস্থ্যেও বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এর ফলে ধীরে ধীরে পড়ুয়াদের মধ্যে তৈরি হতে পারে স্কুলে না যাবার প্রবণতাও।

যদি ভাবা হয় এভাবে সময়সীমা বাড়িয়ে ‘বসে খাওয়া’ শিক্ষকদের ‘জব্দ’ করে ২০মাসের ঘাটতি ২মাসেই পুরন করা হবে তাতে কিন্তু রবীন্দ্রনাথের তোতা কাহিনীর মত ‘পেটের মধ্যে পুঁথির শুকনো পাতা খস্‌খস্‌ গজ্‌গজ্‌’ করলে আখেরে ক্ষতিগ্রস্থ হবে সেই পড়ুয়ারাই।

শিক্ষকরা এতদিন ঘরে বসে বেতন নিয়েছেন অতএব এবার তারা ‘টাইট’ হোক এই মানসিকতাই যদি থেকে থাকে তাহলে এটাও জানতে হবে যে এতদিন বিদ্যালয়ে পঠন-পাঠন চালুর দাবিতে তারাই বেশি সোচ্চার হয়েছেন। কেননা এতদিন বিভিন্ন কাজে বিদ্যালয়ে গিয়েও সন্তানসম ছাত্র ছাত্রীদের চোখে দেখতে না পাওয়ার যন্ত্রনা নিয়েই তাঁদের ফিরতে হয়েছে ঘরবন্দি জীবনে।

সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢুঁ মেরে দেখলাম এবিষয়ে অনেক শিক্ষকই লিখেছেন তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা। অত সকালে বাড়িতে রান্না করা খাবার খেয়ে আসা সম্ভব হয়নি বলে প্রত্যন্ত গ্রামের ছাত্র-ছাত্রীদের অনেকেই নাকি শুধু মুড়ি খেয়েই বিদ্যালয়ে হাজির! আবার অনেকে সাড়ে নটায় আসতে পারবে না, শুধু এই কারণেই বহু ছাত্রছাত্রী অনুপস্থিত। স্বাভাবিক সময়ে হলে আসত। এমন বয়ানও মিলেছে। একই ব্যাপার শনিবারের পূর্ণদিবসেও। কেননা শনিবারে দুটো পর্যন্ত স্কুল করে অনেকেই টিউশনে যায়। এখন হাফছুটি মিলছে না। এতক্ষণ বন্দি থাকবে না তাই কামাই করে দিচ্ছে।

তাছাড়া আমাদের রাজ্যের পড়ুয়াদের সিংহভাগই টিউশন নির্ভর। যদিও এই টানা দেড় বছরে টিউটররাই ছাত্র-ছাত্রীদের একমাত্র ভরসা জুগিয়ে এসেছে। সকালে ঘুম ভেঙেই অধিকাংশেরই একটা-দুটি টিউশন এখন কমন ব্যাপার। তাতে আবার শীতকাল। ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরতে দশটা। তারপর বাড়ি এসে স্নান খাওয়া। শিক্ষকদের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম পড়ুয়ারাই কিভাবে সাড়ে ন’টায় স্কুলে পৌঁছুবে! ফিরতে আবার সন্ধ্যা। ফলে একদিন স্কুলে গেলেও পরের দিন কামাই করে দিচ্ছে দিব্বি।

শিক্ষকরা সমাজের মেরুদণ্ড। আর এই দীর্ঘ সময় স্নেহের ছাত্র-ছাত্রীদের সংস্পর্শে আসতে না পেরে তারাও যে একঘেঁয়ে বদ্ধ জীবনে হাঁপিয়ে উঠেছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অতএব শিক্ষকরাও যে তাদের সবটুকু দিয়ে পড়ুয়াদের এতদিনের ঘাটতি পূরণ করে মূল স্রোতে ফেরাতে সচেষ্ট হবেন সেই আশা ভরসা তাদের উপর রাখতে হবে। ইতিমধ্যেই সেই প্রচেষ্টা পরিলক্ষিতও হয়েছে। অনেক শিক্ষককে দেখা গেছে লকডাউনে পেটের টানে স্কুল ছেড়ে কাজে যোগ দেওয়া পড়ুয়াদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবদের বোঝানোর কাজ শুরু করেছেন।

আর তাছাড়া চারটি ক্লাসের পঠন-পাঠন শুরু হয়েছে মাত্র। অথচ সকাল ৯:৩০ টা থেকে বিদ্যালয় চালু কোন যুক্তিতে? পর্ষদের উচিত ছিল শুরুর কয়েক সপ্তাহ বিদ্যালয়ের সময়সীমা কমিয়ে পড়ুয়াদের স্কুলমুখী করে ধীরে ধীরে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে পড়ুয়াদের খাপ খাওয়ানো। কেননা পড়ুয়াদের অনেকেই এখন ভিন্ন জীবনযাত্রার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে। এখন হঠাৎ করে অতক্ষন স্কুলে থাকার ভীতিও তাদের কাজ করছে। আর এই অতি নিয়মের বেড়াজালে হাঁসফাঁস হয়ে উঠতে পারে শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ের জীবন। তাতে আখেরে স্কুলে আসার আগ্রহ হারাবে পড়ুয়ারা। শিক্ষা দপ্তরের ঐ হঠকারি সিদ্ধান্ত পড়ুয়াদের স্বাস্থ্য, সুরক্ষা ও স্বার্থ বিরোধী। যত তাড়াতাড়ি এই সিদ্ধান্ত থেকে মধ্যশিক্ষা পর্ষদ সরে আসবে ততই শিক্ষার্থীদের মঙ্গল। পুরাতন সময়সূচি অনুযায়ী বিদ্যালয় পরিচালনা হলে ছাত্র-শিক্ষক সকলেই উপকৃত হবেন এবং পঠন- পাঠনও আরও প্রাণবন্ত হবে বলে আমার বিশ্বাস।

Related Articles

Back to top button
error: