HighlightNewsধর্ম ও দর্শনসম্পাদকীয়

নারীর সুরক্ষা ও নিরাপত্তা

বর্তমান যুগের একটি জ্বলন্ত সমস্যা হলো নারী সমাজের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার অভাব। দিনে দিনে প্রতিনিয়ত বিশ্বজুড়ে বাড়ছে নারী সমাজের প্রতি হিংসা। ঘরে ঘরে যেমন মহিলারা পারিবারিক হিংসার শিকার তেমনি বাইরের জগতে নারী সমাজের প্রতি জুলুম, নির্যাতন, ধর্ষণ ইভটিজিং এমনকি খুন-হত্যার মতো ঘটনা বেড়েই চলেছে।

এনসি ডাবলু বা ন্যাশনাল কমিশন ফর ওমেন শুধু আমাদের দেশের একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে ২০২১ সালে জানুয়ারি মাস থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত ভারতে সরকারি দপ্তরে ১৯৯৫৩ টি নারী নির্যাতনের অভিযোগ জমা পড়েছে। এর বাইরে অসংখ্য নারী নির্যাতনের ঘটনা আছে যার কোনো হিসাব নেই। ঠিক এক বছর আগে অর্থাৎ ২০২০ সালের ওই সময়ে নথিভূক্ত নারী নির্যাতনের সংখ্যা ছিল ১৩৬১৮ এক বছরে বৃদ্ধি ৬৩৩৫ টি ঘটনা অর্থাৎ ৪৬.৫১ শতাংশ বৃদ্ধি। বোঝাই যাচ্ছে আমরা কত দ্রুত ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছি।

আমরা অনেক কথা বলছি। ২০০৫ সালে ভারত পাস করেছে নারী সুরক্ষা আইন। প্রতিবছর ৮ মার্চ পালন করা হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস। অথচ জাতিসংঘের রিপোর্ট বলছে প্রতি ১০ জন নারীর মধ্যে একজন নির্যাতনের শিকার হয়।

সেন্টার ফর সোশ্যাল রিসার্চের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে ভারতে প্রতি ২৫ জনের একজনকে ভ্রুণ অবস্থায় হত্যা করা হয়। বছরে ১০ লাখের উপর কন্যা ভ্রূণহত্যা হয়। পণপ্রথার বলি হয়ে বধূ নির্যাতন, বধূহত্যা তো বর্তমান সমাজে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। রাস্তাঘাটে নারী নিরাপদ নয়। স্কুল-কলেজ সর্বত্রই আতঙ্কের ছায়া। নির্ভয়া আসিফার মত নিষ্পাপ কন্যাদেরকেও আমরা ধর্ষিতা হয়ে খুন হতে দেখছি। দলিত আদিবাসী কন্যাকে ভোগ করা তো বৈধ করে নেওয়া হয়েছে।
প্রায় দেড় হাজার বছর আগে আরবের সমাজের অবস্থা অনুরূপ ছিল। হযরত মুহাম্মদ সঃ যে সমাজে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেই সমাজে কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দেওয়া হত। সমাজে নারী জাতির কোনো মর্যাদা ছিল না। নারীদেরকে দাসি হিসাবে বিক্রয় করে দেয়া হতো। হযরত মুহাম্মদ সৃষ্টিকর্তার নির্দেশক্রমে এমন সমাজ বিপ্লব সাধন করলেন যার ফলে সমাজে আমূল পরিবর্তন সাধিত হলো। যে সমাজ কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দিত সেই সমাজ কন্যা সন্তানকে সম্পদ ভাবতে শুরু করলো। নারী আর তার কাছে অভিশাপ নয় বরং সে হয়ে গেল জান্নাতের উসিলা। মাত্র ২৩ বছরের বৈপ্লবিক পরিবর্তন এর মাধ্যমে নারী-পুরুষ উভয়ের জীবনে নেমে এলো পূর্ণ নিরাপত্তা ও শান্তি।

কাল ক্রমে মানুষ ধীরে ধীরে ইসলামী শিক্ষা থেকে দূরে সরে গিয়েছে। আধুনিকতার নামে তারা গ্রহণ করেছে পাশ্চাত্য শিক্ষা। পশ্চিমী সভ্যতা নারী স্বাধীনতার নামে নারী নির্যাতন বহুগুণে বৃদ্ধি করেছে। বর্তমান সমাজে নারী নির্যাতন এসেছে ভিন্ন মোড়কে ভিন্ন আঙ্গিকে। এখন আর নারীকে ক্রীতদাসী বানানো হয় না। নারী দেহ নিয়ে চলে ব্যবসা। ঘটা করে এর নাম দেয়া হয়েছে যৌনশিল্প। এর সঙ্গে যুক্ত নারীদেরকে বলা হয় যৌণ কর্মী । নারী দেহ আজ কর্পোরেট দুনিয়ার সবচেয়ে আকর্ষণীয় পণ্য। বিজ্ঞাপনে সুন্দরী নারী দেহ প্রদর্শন এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। আধুনিক সমাজে নারী পণ্যে পরিণত হয়েছে।
নারী স্বাধীনতা ও উৎপাদন বৃদ্ধির নামে গৃহের পরিবেশ থেকে নারী সমাজকে বের করে কলে, কারখানায়, বাজারে সর্বত্র লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। পরিবারে পিতা, মাতা, ভাই বোন, সন্তান-সন্ততিদের সেবা করাকে নিচু কাজ মনে করা হচ্ছে। আবার সেই নারী যখন হোটেল-রেস্তোরাঁ বিমানবন্দরে অর্ধনগ্ন হয়ে ভিন্ন পুরুষদের সেবা করে তখন সেটাকে নারীমুক্তি বা আধুনিকতা বলা হচ্ছে।

বিবাহকে মনে করা হচ্ছে সেকেলে বিষয়। আর লিভ টুগেদারকে মনে করা হচ্ছে আধুনিক। এটা চিন্তার দেউলিয়া ছাড়া কিছুই নয়।

আসলে নারী নির্যাতনের মূলে রয়েছে বর্তমান সভ্যতার এই দৃষ্টিকোণের পরিবর্তন। সোভিয়েত রাশিয়ার শেষ প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ বলেছিলেন “নারীদেরকে গৃহের বাইরে বের করার ফলে আমাদের পারিবারিক সিস্টেম ভেঙে গিয়েছে। এতে যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ করা যাবেনা”!

আধুনিকতার নামে আমরা সৃষ্টিকর্তার বিধানকে অস্বীকার করেছি। সৃষ্টিকর্তা নারী-পুরুষ উভয়কে সৃষ্টি করেছে: “লিয়াবলু অ কুম আয়ু কুম আহসানু আমালা”। কে উত্তম আচরণ করে তা দেখার জন্য। সৃষ্টিকর্তার বিধানে নারী-পুরুষ উভয়ের অধিকার সুনির্দিষ্ট। কেউ বড় কেউ ছোট নয় সকলেই সমান। প্রত্যেকের দায়িত্ব ও কর্তব্যকে সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। নারীদেরকে বলা হয়েছে “ওয়াকারনা ফি বুয়ুতি কুন্না।” তোমরা অবস্থান করবে তোমাদের গৃহে। ইসলাম নারীর মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠা করেছে।
দিয়েছে তার পূর্ণ মৌলিক অধিকার ।রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকারসহ মানবাধিকারের সকল ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ কোনো ভেদ নেই।

ইসলাম নারী পুরুষ উভয়ের জন্য হিজাব নির্ধারণ করে দিয়েছে। পুরুষ যেমন তার শরীরের নির্দিষ্ট অংশ ঢেকে রাখবে তেমনি নারীরাও ঢেকে রাখবে তার শরীরের নির্দিষ্ট অংশ। উভয়েই নিজেদের মন পবিত্র রাখবে। আর চোখ রাখবে অবনত করে। বর্তমান সমাজে আধুনিকতার নামে হিজাবের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়েছে। এমনকি স্কুল-কলেজে মুসলিম ছাত্রীদেরকে হিজাব পরতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। বিশ্বে হাজার সমস্যা থাকা সত্ত্বেও সেদিকে খেয়াল না করে হিজাব মানব সমাজের জন্য একটা বড় ক্ষতি বলে মনে করা হচ্ছে। আসলে এটা আত্মপ্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। হিজাব আত্মমর্যাদার রক্ষাকবচ। বিশেষ করে এটা নারী নিরাপত্তার ঢাল।

আমরা যদি আমাদের দৃষ্টিকোণকে পরিবর্তন করি। গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে বিচার করে দেখি কোনটা মানুষের জন্য প্রকৃত কল্যাণকর মানুষের মনগড়া জীবন বিধান না সৃষ্টিকর্তার পাঠানো জীবনাদর্শ তাহলে আমরা সহজেই বুঝতে পারবো সৃষ্টিকর্তার বিধানেই রয়েছে পূর্ণ কল্যাণ ও মঙ্গল। পয়গম্বর হযরত মুহাম্মদ স. সহ যুগে যুগে সকল মহাপুরুষ মানব জাতির ক্রান্তিলগ্নে সৃষ্টিকর্তার বিধান অনুসরণের মধ্য দিয়ে মানবজাতির শান্তি ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠিত করেছে। আজও আমাদের সামনে আছে সৃষ্টিকর্তা প্রেরিত জীবন বিধান আল কোরআন। পয়গম্বর হযরত মুহাম্মদ স. এই বিধান প্রয়োগ করার মধ্য দিয়েই মানবজাতিকে সংস্কার করেছিলেন। তিনি নারীর স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করেছিলেন। আজও সেই বিধান সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। আমরা যদি সৃষ্টিকর্তার বিধানের প্রতি ফিরে আসতে পারি ও তারই নির্দেশ মোতাবেক জীবন গঠন করতে পারি তাহলেই হয়তো আমাদের সার্বিক সমস্যার সমাধানের সাথে সাথে প্রতিষ্ঠিত হবে নারী জাতির অধিকার ও মর্যাদা। নারী পুরুষ সকলেই পাবে পূর্ণ নিরাপত্তা। পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে ভয় ও জুলুম-নির্যাতনের পরিবেশ। আসুন এ বিষয়টিকে উপলব্ধি করার জন্য আমরা আমাদের বিবেককে কাজে লাগাই। জাগ্রত বিবেক গড়ে তুলতে পারে মানবিক সমাজ।

Related Articles

Back to top button
error: