Highlightসম্পাদকীয়

রোহিত ভেমুলা থেকে হাথরাস, হায়দ্রাবাদ থেকে উত্তরপ্রদেশ দলিতদের প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা জারি আছে

অমিত দাশগুপ্ত,টিডিএন বাংলা: আজ থেকে ৫ বছর আগে হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি ছাত্র রোহিত ভেমুলা আত্মহত্যা করেন। যদিও তিনি নিজেই আম্বেদকার ছাত্র সমিতির (যে সমিতির তিনি কর্মকর্তা ছিলেন)   একটি ব্যানার দিয়ে নিজের গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন, কিন্তু সামগ্রিকে রোহিত ভেমুলার মৃত্যু একটি প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যবস্থা-উদ্ভুত (সিস্টেমিক) হত্যা। মিথ্যা অভিযোগে তাঁকে অভিযুক্ত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের এবিভিপির নেতা। তাকে সাসপেন্ড করার জন্য তদ্বির করে কেন্দ্রীয় বিজেপি মন্ত্রী বান্দারু দত্তাত্রেয়। এর পরে তৎকালিন সিক্সামন্ত্রীও নাকি রোহিত ও তার ৪ বধূর সাসপেনশনের জন্য বিশ্বিদ্যালয় প্রসাসনের উপর চাপ সৃষ্টি করে। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তাঁরা সাসপন্ডেড হণ, ও ডিসেম্বর মাসে সেই সাসপেনশন বহাল রাখা হয়। মূলত: দলিত বলেই এই বৈষম্য, অত্যাচার ও অমানবিকতা। পিএইচডি-র ভাতা বন্দ করে দেওয়ার ফলে রোহিত চরম আর্থিক অনটনে পড়ে, অন্যদিকে হোস্টেল থেকে বের করে দেওয়ার কারণে ঠান্ডার মধ্যে একটি অস্থায়ী ছাউনিতে থাকতে বাদ্য হয়। সব মিলিয়ে কর্তৃপক্স যে মানসিক চাপ সৃষ্টি করে তা রোহিতে মত সংবেদনশীল মনকে বিপর্যস্ত করে তোলে। এভাবেই ভারতের উচ্চবর্ণ শাসিত প্রতিষ্ঠান ও উচ্চবর্ণের কর্তৃপক্ষ দলিতদের প্রাতিষ্ঠানিক বাবে হত্যা করে।

২০১৯ সালের মে মাসের ২২ তারিখে মুম্বাই-এ ডা: পায়েল তাদভি স্নাতকোত্তর চিকিৎসা শাস্ত্র পড়ার সময়ে তাঁর শিক্ষকদের দ্বারা  ক্রমাগত জাতি বিদ্বেষী আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে অবশেষে আত্মহত্যা করেন। ডা: তাদভি ভিল আদিবাসী গোষ্ঠির অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি তাঁর জাতিগোষ্ঠি ও সংরক্ষণের জন্য ক্রমাগত অপমানিত হচ্ছিলেন। তিনি অপমানিত ও অত্যাচারিত হয়েছিলেন মুম্বাইএর টোপিওয়ালা ন্যাসনাল মেডিক্যাল কলেজে। তার আগে ২০১০ সালে দিল্লির এইমসে বালমুকুন্দ ভারতি নামে একজন দলিত এমবিবিএস ছাত্র তার ঘরে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্ম হত্যা করেন। যদিও এইমসের প্রশাসন তাঁর মৃত্যুর জন্য বালমুকুন্দের মানসিক অবসাদকে দায়ী করে, কিন্তু শোনা যায় যে, তিনি অধ্যাপক ও সিনিয়রদের দ্বারা ক্রমাগত অপমানিত ও অত্যাচারিত হয়েছিলেন। ২০১২ সালের মার্চে অনিল কুমার মীনা নামে একজন আদিবাসী ছাত্র দিল্লি এইমসেই আত্মহত্যা করেন। এক্ষেত্রেও তাঁর প্রতি বৈষম্য করা হয়েছিল বলে তার পরিজন অভিযোগ করেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে চুণী কোটাল, একজন লোধা স্নাতকোত্তর ছাত্রীর আত্মহত্যা সেই ১৯৯২ সালে আলোড়ন ফেলেছিল। তাঁর শিক্ষকদের দ্বারা কেবল জাতের জন্য ধারাবাহিকভাবে অপমানিত হতে হতে তিনি ১৯৯২ সালের ১৬ আগস্ট আত্মহত্যা করেন। এরকম প্রাতিষ্ঠানিক অত্যাচার ও হত্যা দলিতদের জন্য বরাদ্দ রেখেছে ভারত রাষ্ট্র।

এদেশে প্রতি ১৫ মিনিটে দলিত নাগরিকদের উপরে একটি অপরাধ সংঘটিত হয়, প্রতিদিন ৬ জন দলিত নারী ধর্ষিত হয়, এবং প্রতি বছর বস্তিতে বসবাসকারী ৫৬ হাজার শিশু অপুষ্টির দরুণ মারা যায়। অনেকেই ভাবতে পারেন যে, এই ভয়ঙ্কর কোভিড অতিমারির সময়ে হয়তো এই সব অপরাধ অত্যাচার কমবে কারণ অত্যাচারীরাও ভাইরাসের থেকে নিজেদের সুরক্সিত রাখতে ব্যস্ত থাকবে। কিন্তু তেমনটা তো ঘটেনি। উত্তর প্রদেশের হাথরাসে ধর্ষণ, হত্যা ও মাঝরাতে ধর্ষিতার শবদেহ পুড়িয়ে দেওয়া তার নিদর্শন।

সমাজে শত শত বছর ধরে যে ভাইারাসটিকে লালন পালন করা হচ্ছে তার নাম জাতিবাদ। ‘সামাজিক দূরত্ব’ কথাটির মধ্যেই এক ধরণের সামাজিক অস্পৃশ্যতা লুকিয়ে আছে। কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ আদালতের মহামান্য বিচারপতিরা ‘সামাজিক দূরত্ব’ শব্দবন্ধের মধ্যে কোনো আপত্তিজনক কিছু খুঁজে তো পানই নি, উপরন্তু ওই শব্দ পরিহার করে শারীরিক দূরত্ব শব্দদ্বয় ব্যবহারের জন্য আবেদনকারীকে ১০ হাজার টাকার জরিমানাও করেছে। উচ্চবর্ণের হিনদুরা মনে করে যে দলিতদের সঙ্গে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে তারা তাদের পবিত্রতা রক্ষা করতে পারছে এবং মারাত্মক সামাজিক ভাইরাসের হাত থেকে নিজেদের জাতকে রক্ষা করেছে। তাদের কাছে অস্পৃশ্যতা হল সেই প্রকরণ যার মাধ্যমে তারা দলিতদের দূরে সরিয়ে রাখে।

উত্তরপ্রদেশ ও নৈনিতালের উচ্চ বর্ণের কোভিড-১৯ রোগীরা আইসোলেশন কেন্দ্রে দলিত রাঁধুনির রান্না করা  খাবার খেতে অস্বীকার করে। অন্যান্য রাজ্যেও তেমন অস্বীকৃতি ঘটেছে। লকডাউনের জন্য চেন্নাই থেকে গ্রামে ফিরে এম সুধাকর তার ৬ মাসের বিবাহিত স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে তাঁর শ্বশুর তাকে খুন করে কারণ শ্বশুর পরিবার উচ্চ বর্ণের ছিল আর সুধাকর ছিলেন দলিত।

দলিতদের উপর অত্যাচার করা হয়, তাদের বহিস্কৃত করা হয়, খুন করা হয়। মূলধারার প্রচার মাধ্যমে খবর হয় কম বা হলেও চোখে পড়ার মত জায়গা পায় না। ফলে এমন একটা আবহ তৈরী করা হয যে, ভারতে জাতিবাদ আর বর্তমান নেই। অতিমারির মধ্যেও সেই অত্যাচার বা খুনের খামতি হয় না। গত মে মাসে বঞ্চিত বহুজন আগাড়ির একজন উচ্চশিক্ষিত সমাজ কর্মী, অরবিন্দ বাঁসোড়ের সন্দেহজনক মৃত্যু ঘটে। অরবিন্দ সমাজ কর্মী, নিজ পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ছিলেন; তাঁর বন্ধুবান্ধবরা ভাবতেই পারেন না যে তিনি আত্নহত্যা করবেন। কেন্তু পুলিশ যথাযথ তদন্ত ছাড়াই মৃত্যুটিকে আত্মহত্যা বলে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। প্রকাশ আম্বেদকারের বক্তব্য অনুসারে ক্ষমতাসীন এনসিপি দলের মিথিলেশ উমারাকরকে বাঁচানোর জন্যই পুলিশ এমনটা করছে। গত জুন মাসের ৬ তারিখে ১৭ বছরের দলিত তরুণ বিকাশ কুমার জাটভকে কেবল উত্তরপ্রদেশের আমরোহাতে মন্দিরে ঢোকার অপরাধে ৪ জন উচ্চবর্ণের যুবক গুলি করে হত্যা করে।

এভাবেই দলিত ভারতবাসীর উপরে উচ্চবর্ণ তার নখ দাঁত বের করে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অত্যাচার করে চলেছে।

(লেখক: সিপিআইএমএল লিবারেশনের রাজ্য কমিটির সদস্য )

Related Articles

Back to top button
error: