সম্পাদকীয়

বদ্ধ ঘর আর ভাল্লাগে না, ফিরিয়ে দাও ওদের স্কুল বাগান

সালমা সুলতানা, টিডিএন বাংলা: টিউশনি পড়াতে বেরিয়ে অটোয় চেপেছি। এমন সময় সামনের স্টপেজে আমার পাশের সিটেই উঠলেন চল্লিশোর্ধ এক ভদ্রলোক। হঠাৎই জিজ্ঞেস করলেন স্কুল কি আর খুলবে না ম্যাডাম? ছেলেটা যে একদমই পড়াশুনা করছেনা। আলাপচারিতায় জানা গেল উনি আমারই এক ছাত্রের বাবা। কিন্তু স্কুল খুলবে কবে সে প্রশ্নের উত্তরটা ওই অভিভাবককে সেদিন দিতে পারিনি। তাই সোজা উত্তর দিলাম সরকারই ভালো জানে। রাস্তায় যেতে যেতে একগুচ্ছ প্রশ্ন মাথার ভেতরে গিজগিজ করতে লাগল। আমি কোন স্কুলে শিক্ষকতা করিনি। টিউশনি পড়াই মাত্র। আর সেই সুবাদে শত শত ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকের সাথে আমার নিয়মিত যোগাযোগ।

বাড়ি ফিরেই সেদিন বিকেলে পড়াশোনার খোঁজ নিতে পার্শ্ববর্তী কিছু ছাত্রের বাড়ি গেলাম। কিছু অভিভাবক দের সাথে কথা বলে  অভিজ্ঞতা হল ভয়ানক। অধিকাংশ পড়ুয়াই শিক্ষা জগৎ থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছে। অনেকে পড়াশোনা ছেড়ে রোজগারের জন্য বাইরে চলে গেছে। কেউবা বাবার দোকান সামলাচ্ছে। এই দুই বছরে অনেক ছাত্রীর বিয়েও হয়ে গেছে। অভিভাবকদের অনেকেই আক্ষেপ করে শোনালেন, ট্যাব পেয়েই ছেলেটার পড়াশুনাটা উচ্ছন্নে গেল।  একদম বই খুলছে না। অনলাইন ক্লাসের নামে রাতদিন খেলছে গেম। কিছু বলতে গেলেই ঝামেলা করছে বাড়িতে। বন্ধ করে দিচ্ছে খাওয়া-দাওয়া। নিচু ক্লাসের ছাত্র ছাত্রীদের অনেকের বই নষ্ট হয়ে গেছে। কেউবা সেইসব বই বিক্রি করে শোনপাপড়িও খেয়েছে। এইসব কথা শুনতে শুনতেই ফিরে এলাম বাড়ি। মনে মনে ভাবলাম মহামারী করোনা বিশ্বজুড়ে সবকিছু ওলোট-পালট করে দিয়েছে।
শিক্ষাক্ষেত্রেও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। এমনকি সব কিছু স্বাভাবিক ছন্দে ফিরলেও ফেরেনি শিক্ষার হাল।

শিক্ষা এখন শিশুদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। অবস্থা সম্পন্ন লোকেরা পার্সোনাল টিউশনির জোরে ছেলেদের পড়াশোনা কিছুটা হলেও চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু নিম্নবিত্ত খেটে খাওয়া ঘরের প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়ারা লেখাপড়া যেটুকু শিখেছিল সেটুকুও যে ভুলতে বসেছে তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। যদিও অনলাইনের মাধ্যমে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য সরকারিভাবে যে উদ্দ্যোগ নেওয়া হয়েছে আদৌও কি তাতে ছেলেমেয়েরা কিছু শিখছে তা নিয়েও কিন্তু দেখা দিচ্ছে নানান প্রশ্ন। বিদ্যালয় থেকে প্রতিমাসে অ্যাক্টিভিটি টাস্ক দেওয়া হচ্ছে। তার উত্তর কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা নিজেরা করতে পারছে না। সহায়তা নিতে হচ্ছে টিউশন আর ইউটিউবের। আর এভাবেই ওরা একপ্রকার টুকলি করেই মূল্যায়নের খাতা জমা দিচ্ছে শিক্ষকের হাতে।

পড়াশোনার খোঁজ না থাকায় ধীরে ধীরে নষ্ট হচ্ছে ওদের ভবিষ্যৎ, ওদের স্বপ্ন, ওদের কল্পনা। দিন-আনা দিন খাওয়া দরিদ্র পরিবারের বাবা মায়েরা চেয়েছিলেন তাদের সন্তানদের একটু পড়াশুনা করিয়ে শিক্ষিত করতে। কিন্তু এই লকডাউনের সময় তাদের অনেকেরই অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় দেখা যাচ্ছে তাদের সন্তানরা দুপয়সা রোজগারের পথে এগুচ্ছে। কেউ আইসক্রিম বিক্রি করছে, কেউ ইঁটভাঁটায় কাজ করছে কেউবা পেটের দায়ে পাড়ি দিচ্ছে ভিন্ন রাজ্যে।

আর এই নিয়ে সেই সব অভিভাবকদেরও মাথা ব্যথা নেই। কারন তাদের হাতও এখন শূন্য। যে দুটো পয়সা আসছে তাতেই ওদের সংসারটা নুনে ভাতে চলে যাচ্ছে। কিন্তু এভাবে তো আর জীবন চলতে পারে না। তাতে নষ্ট হচ্ছে আগামী ভবিষ্যৎ। কেননা বিশ্বের তাবড় তাবড় বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা এনিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগও প্রকাশ করেছে।

নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় সকলেই বলছেন, বাচ্চাদের স্কুলে ফেরাতেই হবে। কিন্তু এদের মধ্যে কতটা স্কুল ফিরবে? স্কুল খুললেই কি তারা ফিরবে? তা নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে। কেননা ইতিমধ্যে অনেকেই পড়াশোনা ছেড়ে বাইরে চলে গেছে। কেউবা আছে কেরল মুম্বাই কলকাতায়। ওদেরকে  কি আর স্বাভাবিক জীবনে ফেরানো সম্ভব হবে? সে প্রশ্নও কিন্তু উঠছে।
সেই সঙ্গে সমাজে বেড়েছে বাল্য বিবাহও। স্কুল বন্ধ মানেই পড়াশুনা বন্ধ। একথা ভেবেই অনেক অসচেতন অভিভাবক তাদের কন্যা সন্তানদের বিয়ে দিয়ে (আঠারোর আগেই) নিজেদের দায়িত্ত্ব মুক্ত হতে চাইছেন।

আর ভয়াবহ চিত্র যখন সামনে উঠে আসছে তখন স্বভাবতই বোঝা যাচ্ছে এর ফলে কতটা ক্ষতি হচ্ছে আগামী প্রজন্মের। সার্বিক ক্ষতি হচ্ছে দেশ দশ ও সমাজের। ছোট্ট শিশুটি সে কিন্তু জানে না তার কি ক্ষতি হচ্ছে। তাকে বোঝানোরও কেউ নেই। আর এখানে বৈষম্যের অভিযোগটাও কম নয়। কেউ বলছেন বড় লোকের ছেলেরা অনলাইনে ক্লাস করে পড়াশুনার প্রক্রিয়াটা দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দরিদ্র পিছিয়ে পড়া প্রত্যন্ত গ্রাম গুলিতে অনেকেই বোঝে না অনলাইন। সেই সঙ্গে আছে নেটওয়ার্কের সমস্যা। সব বাড়িতে মোবাইলও নেই। দিন আনা দিন খাওয়া পরিবারে দশ হাজার টাকায় একটা মোবাইল কেনার সাধ্যও নেই। আর যাদের ঘরে মোবাইল আছে আদৌও কি তার মাধ্যমে পড়াশোনা হচ্ছে? পড়ুয়ারা মোবাইলের অপব্যবহারও করছে। অনলাইন ক্লাসের নামে খেলছে অনলাইন গেম পাবজি। অর্থাৎ সার্বিক সচেতনতার একটা বড্ড অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে বাড়ছে একাকীত্ব। অনলাইন ক্লাসে হাঁপিয়ে উঠেছে ওরা। খেলার সঙ্গী নেই, মেজাজ হয়ে উঠছে খিটখিটে। মা বাবার সাথে ব্যবহারও হয়ে উঠছে রুক্ষ। বদ্ধ ঘর আর ওদের ভাল্লাগছে না। বাবা মায়ের আদরের বাইরেও ওদের চাই খেলার মুক্ত মাঠ, শিক্ষকদের স্নেহ ভালোবাসা। পুজোর পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে সম্প্রতি মুখ্য মন্ত্রীর আশ্বাসে কিছুটা হলেও আশার আলো দেখা যাচ্ছে।
আর এই বিশ্বজোড়া প্যানডেমিক এর মধ্যে শিশুদের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকেই। এগিয়ে আসতে হবে বিভিন্ন সামাজিক, ধর্মীয় সংগঠন এবং এনজিওগুলোকেও। যেভাবে আগে স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের রমরমা ছিল, স্কুল বাগান ছিল কচিকাঁচায় ভরপুর। সেই দৃশ্য দেখতে চাইছে আজকের শৈশব। দু’বছর পর সেই পরিবেশে তাদের আদৌ কি ফেরানো যাবে? নাকি শূন্যতায় ভরে থাকবে স্কুলগুলি। নাকি মিড-ডে-মিলের মাসিক রেশন নিয়েই ব্যস্ত থাকবে মাস্টার মশাইরা? এর উত্তর দেবে ভবিষ্যত।

তবে এমন কিছু পদক্ষেপ সরকারকে নিতে হবে যা মানব সমাজ ও দেশের সার্বিক কল্যাণ হয়। আর এই পড়ুয়াদের শিক্ষাঙ্গনের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনতেই হবে। আর এটা যদি না করা যায় তাহলে আগামীতে দেশের সমূহ বিপদ। নইলে দেশ কবে নিরক্ষর মুক্ত হবে? কবে ড্রপ-আউট মুক্ত হবে? এই প্রশ্ন কিন্তু থাকবেই। আমরা আশা করব এই সমস্যার সমাধান শিক্ষা সচেতন সকলেই অভিভাবকের ন্যায় অগ্রণী ভূমিকা নেবে। যে যেভাবে পারে করোনা উদ্ভূত এই ভয়ানক সমস্যা সমাধানে শিক্ষিত সমাজকেই এগিয়ে আসতে হবে। সব দায় সরকারের উপর চাপিয়ে সাথে পাঁচে না থাকার মনোভাব ত্যাগ করতে হবে। সমাজের প্রতি তাদেরও একটা দায়িত্ব আছে। তাদের আশেপাশে কেউ পড়ছে কি না, স্কুলে যাচ্ছে কিনা সে খোঁজ নিতে হবে। সর্বোপরি সরকার সহ বেসরকারি সংস্থা ও শিক্ষা সচেতন সমাজ সকলে মিলে একটা শিক্ষিত সুসভ্য সমাজ বাংলা ভারতবর্ষ গড়ে তোলার অঙ্গীকার করতে হবে।

লেখিকা: গৃহ শিক্ষিকা

Related Articles

Back to top button
error: